ভোলা নিউজ২৪ডটনেট।। সংগ্রামী চেতনা যেদিন লভিল মুক্তি। প্রত্যেক মানুষের জীবনে উজ্জ্বলতম দিন আছে। আমি দুর্লভ সৌভাগ্যের অধিকারী। ১৯৬৯ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কালপর্ব। এই কালপর্বে আইয়ুবের লৌহ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে বাংলার ছাত্রসমাজ ২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র সংসদের সহসভাপতি, ‘৬৬-৬৭-তে ইকবাল হল (বর্তমান শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্র সংসদের সহসভাপতি, ‘৬৭-৬৮-তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহসভাপতি নির্বাচিত হই। ‘৬৯-এর জুনে ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হই।
বঙ্গবন্ধু যখন ৬ দফা দেন, আমি ইকবাল হলের সহসভাপতি। আমার কক্ষ নম্বর ছিল ৩১৩। এই কক্ষে প্রায়শই থাকতেন শ্রদ্ধেয় নেতা শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাক। ৬ দফা দিয়ে বঙ্গবন্ধু আমাদের বলেছিলেন, ‘সাঁকো দিলাম স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য।’
১৯৬৮-এর ১৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে জেলগেটেই আবার গ্রেফতার করা হয়। আর আমি ওইদিনই ডাকসুর ভিপি হয়েছিলাম। এ বছরের ১৯ জুন আগরতলা মামলার বিচার যেদিন শুরু হয়, আমরা জানতাম আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিকাষ্ঠে মৃত্যুদণ্ড দেবে। আইয়ুব খান প্রদত্ত মামলার নামই ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ মামলা।
ডাকসুসহ চারটি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে ঐতিহাসিক ১১ দফার ভিত্তিতে ‘৬৯-এর ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। আমার কক্ষে বসেই আমরা ১১ দফার ভিত্তিতে গণআন্দোলনের পরিকল্পনা গ্রহণ করি। আজ বারবার মনে পড়ছে ‘৬৯-এর ১১ দফা আন্দোলনের প্রণেতা- ছাত্রলীগ সভাপতি প্রয়াত আবদুর রউফ ও সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী; ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) সভাপতি প্রয়াত সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক ও সাধারণ সম্পাদক সামসুদ্দোহা; ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল্লাহ এবং এনএসএফের একাংশের সভাপতি প্রয়াত ইব্রাহিম খলিল ও সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলাম মুন্সীর কথা। এই ছাত্রনেতাদের প্রত্যেকেই ছিলেন খ্যাতিমান। আমি ডাকসুর ভিপি হিসেবে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক ও মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করি। আমার সঙ্গে ছিলেন ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক নাজিম কামরান চৌধুরী। ‘৬৯-এর ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনের বটতলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। কলাভবন সংলগ্ন বটতলায় আমরা সমবেত হলাম। গভর্নর মোনায়েম খান ১৪৪ ধারা জারি করেছেন। শেষ পর্যন্ত ১৪৪ ধারা ভঙ্গের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে শ’পাঁচেক ছাত্র নিয়ে রাজপথে এলাম। মুহূর্তের মধ্যে পুলিশ বেপরোয়া লাঠিচার্জ শুরু করে। পরদিন ১৮ জানুয়ারি বটতলায় জমায়েত। খণ্ড খণ্ড মিছিল এবং সহস্র কণ্ঠের উচ্চারণ-‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, আইয়ুব খানের পতন চাই।’ গতকালের চেয়ে আজকের সমাবেশ বড়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজপথে নেমে এলাম। দাঙ্গা পুলিশ বেধড়ক লাঠিচার্জ আর টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করল। পরদিন ১৯ জানুয়ারি রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, কিন্তু প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় খোলা। আমরা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৪৪ ধারা ভাঙি। শুরু হয় লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস। গত দু’দিনের চেয়ে মিছিল আরও বড়। পুলিশ গুলি চালাল। একজন ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ল রাজপথে। ছাত্রলীগের এই কর্মীর নাম আসাদুল হক। পুলিশের বর্বরতা ও গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে ২০ জানুয়ারি সোমবার পুনরায় বটতলায় সমাবেশের কর্মসূচি দিলাম। ঢাকাসহ প্রদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করি, বটতলার পরিসর সমাবেশের তুলনায় ছোট! যেন জনসমুদ্র। ফুঁসে উঠল মিছিল! কোথায় গেল ১৪৪ ধারা! মানুষের ঢল নেমে এলো রাজপথে। মিছিল যখন মেডিকেল কলেজের সামনে, গুলিবর্ষণ শুরু হয়। গুলি আসাদুজ্জামানের বুকে বিদ্ধ হয়। তাঁর গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত শার্টটি সংগ্রামের পতাকা করে আকাশে উড়িয়ে, আসাদের রক্ত ছুঁয়ে শপথ গ্রহণ করে সমস্বরে বলি, ‘দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাবো না।’ বিকেলে শহীদ মিনার থেকে শুরু হয় শোক মিছিল। মিছিলের সম্মুখভাগ যখন তিন নেতার সমাধিসৌধের কাছে, তখন মাইকে পুলিশ ও ইপিআরের কণ্ঠস্বর- ‘ডোন্ট ক্রস, ডেঞ্জার-ডেঞ্জার, ডোন্ট ক্রস!’ কিন্তু মিছিল শোকে আর ক্ষোভে উত্তাল। ডেঞ্জার ক্রস করে রক্তাক্ত লাল পতাকা নিয়ে পল্টনে পৌঁছাই আমরা। ২১ জানুয়ারি অর্ধদিবস হরতাল এবং হরতালের পর পল্টনে সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করি। সফল হরতালের পর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করি : ২২ জানুয়ারি শোক মিছিল। ২৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মশাল মিছিল। ২৪ জানুয়ারি দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল। ২৩ জানুয়ারি সমগ্র ঢাকা পরিণত হয় মশালের নগরীতে। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। ২৪ জানুয়ারি অর্ধদিবস হরতাল পালিত হয়। সর্বাত্মক হরতাল। সবার একই প্রশ্ন, ‘শেখ মুজিব কবে মুক্তি পাবে’, ‘কবে আগরতলা মামলা তুলে নেওয়া হবে?’ হরতালের পরও মিছিলের বিরাম নেই। যেখানেই পুলিশ বাধা দিচ্ছিল, সেখানেই খণ্ডযুদ্ধ। জনগণ এতটাই সাহসী হয়ে উঠেছিল যে, পুলিশ-ইপিআরের গুলির ভয় কেটে গেছে। ডাকসু সহসভাপতি হিসেবে আমার স্কন্ধে তখন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক, মুখপাত্র ও আহ্বায়কের দায়িত্ব। জনরোষ নিয়ন্ত্রণ করে নিয়মতান্ত্রিকতা বজায় রাখা যে কত কঠিন, মর্মে মর্মে অনুভব করেছি। হরতাল চলাকালে একজন মন্ত্রীর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। যত্রতত্র গুলি চালাতে থাকে। সে গুলিতেই নিহত হয়ে শহীদদের তালিকায় যুক্ত হয় মতিউর, মকবুল, আনোয়ার, রুস্তম, মিলন, আলমগীরসহ আরও অনেক নাম। ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমানের লাশ নিয়ে আমরা পল্টনে যাই। শুনতে পাই, মোনায়েম খান শহরের নিয়ন্ত্রণ ভার ছেড়ে দেবেন সেনাবাহিনীর হাতে এবং অচিরেই কারফিউ জারি হবে। বিক্ষুব্ধ মানুষের ভয়াল গর্জন আর সরকারি ভবনগুলো এবং দৈনিক পাকিস্তান, মর্নিং নিউজ ও পয়গাম পত্রিকা অফিস তখন আগুনে জ্বলছে। ২৪ জানুয়ারি প্রবল গণআন্দোলন-গণবিস্টেম্ফারণের মধ্য দিয়ে ঢাকা নগরীর মানুষ রাজপথে নেমে এসে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করল। বাংলাদেশে বহু আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু ১৭ থেকে ২৪ জানুয়ারি- মাত্র ৭ দিনের মধ্যে সমগ্র নিরস্ত্র বাঙালি জাতি এক কাতারে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঐতিহাসিক যে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করেছিল, তা আজও আমার স্মৃতির পাতায় অম্লান। কল-কারখানা, অফিস-আদালত, সচিবালয় সর্বত্র প্রশাসন ভেঙে পড়েছে। কিছুদিনের জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের দপ্তর তথা ইকবাল হলের ৩১৩ নম্বর কক্ষ।
আমাদের সময়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভেদ থাকলেও নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল মধুর। যে চারটি ছাত্র সংগঠন একত্র হয়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ১১ দফা দাবি পেশ করেছিলাম, তাদের মধ্যে মত ও পথের পার্থক্য সত্ত্বেও একই টেবিলে বসে ১১ দফা দাবি প্রণয়ন করেছি। ছাত্রসমাজের সাধারণ সমস্যাগুলো সামনে নিয়ে এসেছি। ৬ দফা সবাই সমর্থন করত না। ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপ ৬ দফা সমর্থন করত না। অন্যদিকে ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপ ৬ দফা সমর্থন করত। আবার উভয় গ্রুপই বঙ্গবন্ধুর মুক্তির প্রশ্নে এককভাবে তাঁর নাম দিতে রাজি হয়নি। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতেই আন্দোলন কেন্দ্রীভূত হয়েছে, গতিশীলতা লাভ করেছে। এবারের ‘গণঅভ্যুত্থান দিবসের পাঁচ দশক’ আমার কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে এ কারণে যে, দীর্ঘকাল পরে হলেও গত বছর ‘মহান স্বাধীনতা দিবস’-এ আমরা শহীদ আসাদ, শহীদ মতিউর, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক এবং শহীদ ড. শামসুজ্জোহাকে ‘স্বাধীনতা পদকে’ ভূষিত করতে পেরেছি।
২০ জানুয়ারি আসাদের রক্তের মধ্য দিয়ে যে আন্দোলন রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল, সে আন্দোলনের সফল পরিণতি- ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে নিঃশর্তভাবে ফাঁসির মঞ্চ থেকে মুক্ত করে ২৩ ফেব্রুয়ারি ১০ লক্ষাধিক লোকের বিশাল জনসমুদ্রে গণসংবর্ধনা দিয়ে কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল। সেই সভায় দাঁড়িয়ে জনসমুদ্রের উদ্দেশে স্বভাবসুলভ কণ্ঠে কৃতজ্ঞচিত্তে তিনি বলেছিলেন, ‘যারা রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করেছো, যদি কোনদিন পারি নিজের রক্ত দিয়ে আমি সেই রক্তের ঋণ শোধ করে যাবো।’ তিনি একা রক্ত দেননি, ‘৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে রক্ত দিয়ে বাঙালি জাতির রক্তের ঋণ তিনি শোধ করে গেছেন। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও কর্মসূচি নিয়ে জাতির পিতা সংগ্রামের পথে এগিয়ে ছিলেন। তাঁর দুটি লক্ষ্য ছিল-এক. বাংলাদেশের স্বাধীনতা; দুই. ক্ষুধামুক্ত-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা কায়েম করা। একটি তিনি সফলভাবে সমাপ্ত করেছেন। দ্বিতীয়টি তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা বাংলার মানুষের গণরায় নিয়ে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়ে দক্ষতা, সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করে চলেছেন। আজ ভাবতে ভালো লাগে, জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের যে রক্তঝরা পথ ধরে আজকের এই স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, সেসব কিছু অর্জনের ড্রেস রিহার্সাল ছিল ‘৬৯-এর মহান গণঅভ্যুত্থান, যা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে এবং থাকবে চিরদিন।