ভোলা নিউজ ২৪ডটনেটঃ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো রকম বিশৃঙ্খলা কোনোভাবেই সহ্য করা হবে না। তিনি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা সমুন্নত রাখারও আহ্বান জানান।
শেখ হাসিনা আজ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম রোকেয়া হলের ৭মার্চ ভবনের উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের তাদের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে হবে এবং কোনোভাবেই কোনো ধরনের উচ্ছৃঙ্খলতা গ্রহণযোগ্য হবে না। বিশ্ববিদালয়ের নিয়ম মেনেই সকলকে চলতে হবে।’
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের স্মরণে ঢাবির এই ছাত্রী হলের ভবনটির নামকরণ করা হয়েছে ‘৭মার্চ ভবন’।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত। এসব প্রতিষ্ঠান নিজেদের উপার্জনে চলবে তারও বিধান রয়েছে। কিন্তু আমাদের এখানকার যারা শিক্ষার্থী তাদের এটা ভাবা উচিত যে, পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে কম খরচে উচ্চশিক্ষা বাংলাদেশে দেওয়া হয়ে থাকে। প্রায় শতভাগ খরচই কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে। এটা পৃথিবীর কোনো দেশে রয়েছে বলে আমার জানা নেই। তিনি বলেন, ‘কাজেই এর মর্যাদাও শিক্ষার্থীদের দিতে হবে এবং বিশৃঙ্খলা কখনো গ্রহণযোগ্য নয়। সবাইকে একটা নিয়ম মেনে চলতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে হলে সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়ম মেনে সেভাবেই আচরণ করতে হবে। এটাই জাতি আশা করে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা চাই সব দিক থেকে আমাদের ছেলে-মেয়েদের জীবনমান উন্নত হোক, তারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাক। প্রজন্মের পর প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশকে গড়ে তুলে জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে।’
শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের ব্যয়কে বিনিয়োগ হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শিক্ষায় যে খরচ আমরা করি সেটা ব্যয় নয়, আমার দৃষ্টিতে বিনিয়োগ, যা আমাদের দেশ ও জাতি গঠনে কাজে লাগবে এবং এ থেকে দেশের মানুষ উপকৃত হবে। সে ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের নিজেদের উপযুক্তভাবে করে গড়ে তুলতে হবে।’ তিনি বলেন ‘আর সেই শিক্ষাটা শুধু কেতাবি শিক্ষা নয়, জীবনমানের উন্নয়নের জন্য শিক্ষা দিতে হবে। আর শিক্ষার্থীরা যে শিক্ষাটা গ্রহণ করবে তার সুফল যেন আমাদের সাধারণ মানুষ পায় সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।’
সরকারপ্রধান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘আমাদের প্রতিটি শিক্ষার্থী ছেলে-মেয়েকে এখন থেকেই শিক্ষা দেওয়া উচিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে। এ ব্যাপারে সকলকে দৃষ্টি দিতে হবে। যে জায়গাটায় থাকব, তার রক্ষণাবেক্ষণ করা সকলের দায়িত্ব।’ তিনি এ সময় বিদ্যুৎ, পানিসহ সরকারি সেবার বিষয়ে সাশ্রয়ী হওয়ার জন্যও সবাইকে পরামর্শ দেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। সেভাবে আমরা শিক্ষাকেও বহুমুখী করার চেষ্টা করছি। সে ক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষাকেও বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। প্রাইমারি থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত বিনা বেতন ও বৃত্তির ব্যবস্থা করেছি। প্রথম শ্রেণি থেকে ডিগ্রি ও পিএইচডি পর্যন্ত ২ কোটি ৩ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে বৃত্তি ও উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রী দেশে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে তাঁর সরকারের পদক্ষেপসমূহ তুলে ধরে বলেন, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে তিনি বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহ কমে যাওয়ার বিষয়টি দেখে চিন্তিত হন। এরপর বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহ বাড়াতে ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিটা জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাঁর সরকার কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রতিটি জেলায় আমরা বিশ্ববিদ্যালয় করে দিচ্ছি। ঘরের ভাত খেয়ে আমাদের ছেলেমেয়েরা যেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে পারে, সে সুযোগটা সৃষ্টি করে দেওয়ার চেষ্টা করেছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা উচ্চশিক্ষার প্রতি জোর দিচ্ছি। শিক্ষাকে বহুমুখী ও বিস্তৃত করার চেষ্টা করছি, যাতে আমাদের শিক্ষার্থীরা এখান থেকে শিক্ষা অর্জনের পর বিভিন্ন দেশে গিয়ে আরও উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘এ জন্য দেশে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়, আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, মেরিটাইম, ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস, ফ্যাশন ডিজাইন এবং ইসলামিসহ আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছি।’ সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমরা প্রথমবার ক্ষমতায় এসেই দেশের প্রথম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় করেছিলাম। এবার আরও দুটি করেছি রাজশাহী ও চট্টগ্রামে। সিলেটেও একটা করে দিচ্ছি। পর্যায়ক্রমে আমরা প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি করে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় করে দেব।’ তিনি বলেন, ‘দেশে একটিমাত্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। এখন সরকারি-বেসরকারি খাতে অনেকগুলো কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় করেছি।’
বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ ট্রাস্ট করে তাঁর সরকার গবেষণার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গবেষণা ছাড়া কখনো উন্নত হওয়া যায় না। আজকে যে বাংলাদেশ খাদ্যে যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বা কৃষিতে যে বিপ্লব, তা গবেষণা ছাড়া হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বহুমুখী গবেষণা হচ্ছে। আমাদের দক্ষ জনগোষ্ঠী দরকার। সেদিকে লক্ষ রেখে আমরা শিক্ষাকে বহুমুখী করার চেষ্টা করছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরি করছি। সেখানে দক্ষ জনগোষ্ঠী দরকার। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে আমরা মহাকাশ জয় করেছি, সেটাও অব্যাহত রাখা দরকার। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট আমরা মহাকাশে পাঠিয়েছি। এরপর বঙ্গবন্ধু-২, বঙ্গবন্ধু-৩ পাঠাব। তখনো আমাদের দক্ষ জনগোষ্ঠী দরকার হবে।’ তিনি বলেন, সেদিকে লক্ষ রেখেই তাঁর সরকার শিক্ষা সম্প্রসারণ এবং উন্নত করার উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে চাই। তবে শিক্ষিত জাতি ছাড়া তা সম্ভব নয়। তাই আমরা শিক্ষা খাতেই সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছি। জাতির পিতা যার শুরুটা করে দিয়ে গেছেন।’
শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মাত্র সাড়ে তিন বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা এনে দিয়েছিলেন। তিনি শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে একটি সর্বজনীন ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতি উপহার দিয়েছিলেন। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের জন্য শিক্ষা অবৈতনিক করেছিলেন। ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পারিবারিক বন্ধন থাকার উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা এবং তিনি নিজে ও তাঁর ভাই শেখ কামাল ছাড়াও পরিবারের অনেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী ছিলেন। যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মনি, শেখ ফজলুল করিম সেলিমও এই বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়েছেন। কেবল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বা তাঁর নিজের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নয়, বাঙালি জাতির মুক্তির প্রতিটি সংগ্রামের সূতিকাগার হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বরাবর অগ্রাধিকার পাবে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ ও বাঙালি জাতির অর্জনে যত সংগ্রাম হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার সূতিকাগার হিসেবেই আন্দোলনের সূচনা করে এগিয়ে নিয়ে গেছে। তাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা আমাদের কাছে অন্য রকম।’ তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ হাজার ১৫৭ কোটি টাকার ১০টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আটটির কাজ শেষ হয়েছে, চলছে আরও দুটির কাজ।
তরুণ প্রজন্মকে আগামী দিনের নেতৃত্ব দিতে সঠিকভাবে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে আমরা মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের আগেই উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করব, ইনশা আল্লাহ।’
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। এ ছাড়া, সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহম্মদ সামাদ, সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরিন আহমেদ, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দীন, রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ ড. জিনাত হুদাও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, জাতীয় অধ্যাপকবৃন্দ, শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
রোকেয়া হলের শিক্ষার্থী লিপি আক্তার এবং শ্রাবণী ইসলাম প্রধানমন্ত্রীকে ‘উত্তরীয়’ পরিয়ে দেন। সংগীত ও নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা অনুষ্ঠানে সংগীত ও নৃত্য পরিবেশন করেন।
প্রধানমন্ত্রী এর আগে নবনির্মিত ৭ মার্চ ভবনের ফলক উন্মোচন করেন। তিনি ওই ভবনে রক্ষিত জাতির পিতার প্রতিকৃতি এবং ৭ মার্চ জাদুঘরও পরিদর্শন করেন এবং রক্ষিত বই স্বাক্ষর করেন।
প্রায় ৮৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এক হাজার ছাত্রীর আবাসন সুবিধা সংবলিত এই ভবনটিতে প্রশাসনিক এবং সার্ভিস ব্লক নামে আরও দুটি ব্লক রয়েছে। ৭ মার্চ জাদুঘরে বঙ্গবন্ধু এবং বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের দুর্লভ আলোকচিত্র এবং তথ্যাদি সন্নিবেশিত করা হয়েছে।