যেমন ছিল রাম-রহিমের বিরুদ্ধে দীর্ঘ তদন্ত

0
512

ভোলা নিউজ ২৪ ডটনেট: দুই অনুসারীকে ধর্ষণের দায়ে ভারতের ‘ধর্মগুরু’ গুরমিত রাম রহিম সিং দোষী সাব্যস্ত হয়ে এখন বেশ আলোচিত। প্রায় ১৫ বছর আগে, ২০০২ সালের মে মাসে রাম রহিমের এক সাবেক নারী ভক্ত (সাধ্বী) তাঁর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ তুলে বেনামে চিঠি লেখেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি ও পাঞ্জাব-হরিয়ানা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে। ওই নারীর অভিযোগ, হরিয়ানার শহর সিরসায় ডেরা সচ সওদা গোষ্ঠীর প্রধান কার্যালয়ে রাম রহিম তাঁকে যৌন নির্যাতন করেন।

এরপর পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্ট বিষয়টি আমলে নিয়ে জেলা ও দায়রা জজকে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বলেন। কিন্তু বিচারক দেখলেন, কেউ এ বিষয়ে কথা বলতে চান না। তাই বিচারক অভিযোগটি তদন্ত করে দেখতে সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (সিবিআই) নির্দেশ দেন। এরপর হাইকোর্টের নির্দেশে সিবিআই ওই বছরের ১২ আগস্ট অভিযোগটি মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করে।

২০০৫ সালে সিবিআই রাম-রহিমের আশ্রমে থাকা বাসিন্দাদের একটি তালিকা জোগাড় করতে সক্ষম হয়। তারা দেখে, এর মধ্যে ৫৩ জন ‘সাধ্বী’ মেয়েদের হোস্টেলে আর ৮০ জন ডেরা সচ সওদা সিরসা আশ্রমের। তবে তত দিনে তাঁদের ২৪ জন ডেরা ছেড়ে গেছে। এরপর সংস্থাটি ১৩০টি মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিন্তু তারা বাবা গুরমিত সিংহের ‘পার্থিব, মানসিক ও আধ্যাত্মিক শক্তির’ ভয়ে মুখ খুলতে নারাজ।

এরই মধ্যে ১৯৯৭ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে ডেরা ছেড়ে যাওয়া ২৪ জন ‘সাধ্বী’র মধ্যে ২০ জনকে খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁদের বেশির ভাগই এখন বিবাহিত। তাই তাঁরা সংসারজীবনে অশান্তির আশঙ্কায় গুরুজির বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাননি।

পরে আশ্রম ছেড়ে গেছেন, এমন মেয়েদের মধ্যে ১৮ জনকে সিবিআই জিজ্ঞাসাবাদ করে। কয়েকজন জানিয়েছিলেন, ডেরার প্রধান, এর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এবং তাঁর ভক্তরা খুবই ভয়ানক। এমনকি তারা এ বিষয়ে কথা বললে তাদের হত্যা করা হতে পারে বলেও ভয় পাচ্ছিলেন।

২০০৬ সালের মে-জুন মাস। সিবিআই দুজনকে আস্থার জায়গায় নিয়ে তাঁদের কাছ থেকে পুরোপুরি তথ্য নিতে সক্ষম হয়। তারা ওই কথিত ধর্মগুরুর কক্ষে কী হতো তার বিস্তারিত বর্ণনা দেন। ১৯৯৯ সাল থেকে তাঁদের ওই কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। এ দুজনের মধ্যে একজন ২০০৭ সালের মার্চে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।

ওই ভুক্তভোগীর বর্ণনা অনুয়ায়ী, আশ্রম কমপ্লেক্সের ভেতরে পুরোনো ও নতুন ডেরা ছিল। আর রাম-রহিমের ছিল পৃথক আবাসস্থল; যা গুফা (গুহা) নামে পরিচিত। এটি পুরোনো ডেরায় ছিল। এর ছিল তিনটি ফটক। এর মধ্যে দুটি ফটক ছিল যেখানে ধর্মীয় সমাবেশ হতো, সেদিকে আর অন্য দরজাটি ছিলে মেয়েদের হোস্টেলের দিকে। রাত আটটা থেকে মধ্যরাত আর মধ্যরাত থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত পালা করে ‘সাধ্বী’রা এই গুফার প্রবেশ দরজায় পাহারা দিত।

রাম-রহিম তাঁর গুহায় এই সাধ্বীদের ডেকে পাঠাতেন এবং তাদের সঙ্গে জোরজবরদস্তি করতেন। একজন ভুক্তভোগী জানান, এক রাতে সেই গুহায় ডাক পড়ে তাঁর। তিনি বলেন, ‘বাবা আমাকে তাঁর কাছে বিছানায় বসতে বললেন। কিন্তু আমার অস্বস্তি লাগছিল, তাই মেঝেতেই বসতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু মহারাজা আমাকে বিছানাতেই বসতে বললেন। তাই বাধ্য হয়ে বসি। এরপর তিনি ডেরায় আমার জীবন ও অভিজ্ঞতা কেমন জানতে চান। একপর্যায়ে গুরমিত সিং আমাকে স্পর্শ করতে থাকে এবং ধর্ষণ করে।’

এই নারীর বাবা সিবিআইকে বলেন, তাঁর বোনও এই রাম-রহিমের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আরেক ভুক্তভোগীর আত্মীয়ও একই ধরনের বিবৃতি দিয়েছেন; যা রেকর্ড করা হয়েছে। তিনিও ডেরার একজন ‘সাধ্বী’ ছিলেন। কিন্তু পরে ছেড়ে যান।

সিবিআই জানায়, স্থানীয় সাংবাদিক রাম চন্দ্র ছত্রপতী, যিনি তাঁর পত্রিকায় বেনামি এই চিঠিটি ছাপিয়েছিলেন, তাঁকে পরে হত্যা করা হয়। এমনকি ডেরার সাবেক এক অনুসারীকে হত্যা করা হয়েছিল। এ দুটি হত্যা মামলার তদন্তে এই ধর্ষণ মামলার কিছু তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে।

ডেরার সাবেক এক অনুসারীর বাবা সিবিআইকে বলেন, বেনামি এই চিঠি যখন প্রকাশিত হয়, তখন তাঁর ছেলে তাঁকে ঘটনা সত্যি বলে জানায় এবং বলে, রাম-রহিম ও তাঁর সহযোগীদের সন্দেহ, এই বেনামি চিঠির পেছনে সে রয়েছে। ডেরার সাবেক এই অনুসারীকে পরে হত্যা করা হয়।

এই তদন্তে রাম-রহিমের তিন সহযোগী অবতার সিংহ, ইন্দর সেইন ও কৃষাণ লালকে মিথ্যা-যাচাই (লাই ডিটেকশন) পরীক্ষা করা হয়। তাঁরা আগে যে বিবৃতি দিয়েছেন, তার সঙ্গে এর কোনো মিল পাওয়া যায়নি। যার মধ্য দিয়ে গুফায় সাধ্বীদের যৌন নির্যাতনের প্রমাণ মেলে।

১০ বছর ধরে প্রায় ২০০টি শুনানির পর গত শুক্রবার এ মামলার রায় হয়। এই সময়ের মধ্যে অসংখ্যবার উচ্চ আদালত এ মামলার বিচারকাজে স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। গতকাল শনিবার রাত সাড়ে আটটায় হরিয়ানা রাজ্যের রোহতক এলাকার সুনারিয়া কারাগারে নেওয়া হয় রাম রহিম সিংকে।

রাজস্থানের গঙ্গানগর জেলার এক গ্রামে ৫০ বছর আগে জন্ম নেওয়া যে বালককে পড়শিরা ‘মিতা’ নামে চিনতেন, পরবর্তীকালে তিনিই নাম পরিবর্তন করে হয়ে ওঠেন ‘রাম রহিম ইনসান’। হরিয়ানার সিরসা শহরের ডেরা সচ সওদা নামের এক ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রধান হয়ে ওঠেন তিনি। সাদা কুর্তা ছেড়ে শুরু করেন উজ্জ্বল ঝলমলে পোশাক পরা। একাধারে সন্ত, দার্শনিক, ধর্মপ্রচারক, সংগীতশিল্পী, অভিনেতা, লেখক, বাস্তুকার—এককথায় বহু গুণের প্রকাশ ঘটান তিনি। ‘এমএসজি’ বা ‘মেসেঞ্জার অব গড’ নামের এক সিনেমায় অভিনয়ও করেন তিনি। দ্য হিন্দু অবলম্বনে

LEAVE A REPLY