বঙ্গবন্ধু ও বিজয়ের স্মৃতি

0
91

স্মৃতির পাতায় বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের অনেক ছবি ভেসে ওঠে। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর প্রিয় মাতৃভূমিকে হানাদারমুক্ত করে ৩০ লক্ষাধিক প্রাণ আর ২ লক্ষাধিক মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে মহত্তর বিজয় আমরা অর্জন করি। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন সামনে নিয়ে দীর্ঘ ২৪টি বছর সংগ্রাম পরিচালনা করে, নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে ধাপে ধাপে অগ্রসর হন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে তত দিন মানুষের হৃদয়ে মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী গৌরবগাথা অম্লান থাকবেতিনি এমন একজন মহামানব যাঁর হৃদয় ছিল মানুষের প্রতি ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। বাংলার মানুষকে তিনি গভীরভাবে ভালোবাসতেন। বঙ্গবন্ধুর কাছে থেকে আমি তা দেখেছি। বাংলাদেশের এমন কোনো স্থান নেই যেখানে আমি বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হয়ে যাইনি। হৃদয়ের গভীরতা থেকে ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে যখন ডাক দিতেন মানুষের হৃদয় প্রবলভাবে আলোড়িত হতো। রাস্তার পাশে গভীর রাতে আধো-অন্ধকারে মানুষ দাঁড়িয়ে থাকত তাঁকে একনজর দেখার জন্য। তিনি গাড়ি থামাতেন।

 

মানুষটিকে বুকে টেনে নিতেন। তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করতেন, তাকে মনে রাখতেন। সেই মানুষটিও বঙ্গবন্ধুর স্পর্শ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করতেন। তিনি ছিলেন এমন নেতা যিনি কখনো কাউকে ছোট মনে করতেন না। কাউকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য হেয় প্রতিপন্ন করতেন না। পরকে আপন করতেন। যে তাঁর নীতি-আদর্শে বিশ্বাসী নয় সে-ও তাঁর সান্নিধ্যে আপন হয়ে উঠত। ব্যক্তিত্বের অমোঘ এক মানবিক আকর্ষণ ছিল বঙ্গবন্ধুর। সাগর-মহাসাগরের গভীরতা মাপা যাবে, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর যে অকৃত্রিম ভালোবাসা এটি কোনো দিনই পরিমাপ করা যাবে না। তিনি ছোটকে বড় করতেন, বড়কে করতেন আরও বড়।

আওয়ামী লীগের প্রত্যেক কর্মীকে তিনি বড় করে তুলতে চাইতেন। কোনো নেতা-কর্মীর নির্বাচনী এলাকায় গেলে তাঁর নাম ধরে সম্বোধন করে মানুষের কাছে পরিচয় করিয়ে দিতেন। মনে পড়ে ’৭০-এর ২৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ভোলা সফরের স্মৃতি। বরিশাল-পটুয়াখালী-ভোলা একসঙ্গে সফরের কর্মসূচি নির্ধারণ করে ২১ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করে প্রথমে ২২ তারিখ বরিশাল, ২৩ তারিখ পটুয়াখালী এবং ২৪ তারিখ ভোলার জনসভায় বক্তৃতা করেন। স্নেহমাখা ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে আমাকে ভোলার মানুষের কাছে তুলে ধরেছিলেন। সেই বক্তৃতার কথা বলতে আজ আমার হৃদয় ভাবাবেগে আপ্লুত হয়। আমি যা না তার থেকেও বেশি ঊর্ধ্বে তুলে ধরে- ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের কথা, কী করে কারাগার থেকে আমরা তাঁকে মুক্ত করেছি, ভোলার মানুষের কাছে তা বলে আমাকে বড় করার চেষ্টা করেছেন। এমন একজন মহান নেতার নেতৃত্বেই ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর দেশকে আমরা হানাদারমুক্ত করেছি।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয়নি। একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদেরই হতে হবে। সে লক্ষ্য সামনে নিয়েই প্রথমে নিজকে, পরে দলকে এবং বাংলার মানুষকে প্রস্তুত করে তাঁর স্বপ্ন পূরণ করেছেন। তিনি লক্ষ্য নির্ধারণ করে রাজনীতি করতেন। সে লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য জেল-জুলুম-হুলিয়া-অত্যাচার-নির্যাতন এমনকি ফাঁসির মঞ্চকেও তুচ্ছ করেছেন। কোনো দিন লক্ষ্যচ্যুত হননি।

 

 

দলীয় প্রয়োজনে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন, আবার জাতীয় প্রয়োজনে দলের শীর্ষ পদ ছেড়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছেন। পৃথিবীতে অনেক নেতা এসেছেন, আসবেন; কিন্তু মানবদরদি এমন নেতা অতুলনীয়। আজ বিজয়ের এই দিনে হৃদয়ের সবটুকু অর্ঘ্য ঢেলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে- যাঁর স্নেহে আমার জীবন ধন্য; যাঁর আদরে আমি বড় হয়েছি; যাঁর সঙ্গে বিদেশ সফরে গিয়ে বিদেশি রাষ্ট্রনায়কদের তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা-ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হয়েছি- বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি।

১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪টা ৩০ মিনিটে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ আর আমাদের মহান বিজয় সূচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি ছুটে গিয়েছিলাম কলকাতাস্থ থিয়েটার রোডে অবস্থিত প্রথম বাংলাদেশ সরকারের সদর দফতরে। সেখানে অবস্থান করছিলেন শ্রদ্ধেয় নেতৃবৃন্দ- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য সর্বজনাব ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামানসহ অন্য নেতৃবৃন্দ। সবাই আনন্দে আত্মহারা! প্রিয় মাতৃভূমিকে আমরা হানাদারমুক্ত করেছি। মনের গভীরে উচ্ছ্বাস আর আনন্দ; সে আনন্দ-অনূভূতি অনির্বচনীয়! স্বাধীন বাংলার যে ছবি জাতির পিতা হৃদয় দিয়ে অঙ্কন করে নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র করে বজ্রকণ্ঠে বলেছিলেন, ‘কেউ আমাদের দমাতে পারবে না। ’ পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে অদম্য বাঙালি জাতি নেতার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে সমগ্র বিশ্ববাসীকে বুঝিয়ে দিয়েছে, জাতীয় মুক্তির ন্যায্য দাবির প্রশ্নে কেউ আমাদের ‘দমাতে’ পারে না।

 

’৭১-এর ডিসেম্বরের ৩ তারিখ থেকে সার্বিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ চূড়ান্তরূপ অর্জন করে। আমরা তখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। মুক্তিবাহিনীর চতুর্মুখী গেরিলা আক্রমণে বিধ্বস্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ দিন উপয়ান্তর না দেখে একতরফাভাবে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। পাকিস্তান বিমানবাহিনী পশ্চিম ভারতের বিমান ঘাঁটিগুলো এমনকি দিল্লির কাছে আগ্রার বিমানক্ষেত্র এবং পূর্ব ফ্রন্টের আগরতলা বিমানঘাঁটিতে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি শ্রী ভি ভি গিরি ও ঊর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দের সঙ্গে জরুরি বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী রাত ১০টা ৩০ মিনিটে সারা ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করেন। রাত ১২টা ২০ মিনিটে ইন্দিরা গান্ধী বেতার ভাষণে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে সাফ জানিয়ে দেন, ‘আজ এই যুদ্ধ ভারতের যুদ্ধ হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করল। ’ পরদিন ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যৌথভাবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি অর্জনে চিঠি লেখেন।

 

চিঠির মূল বক্তব্য ছিল, ‘যদি আমরা পরস্পর আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্কে প্রবেশ করি, তবে পাকিস্তান সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আমাদের যৌথ অবস্থান অধিকতর সহজতর হয়। অবিলম্বে ভারত সরকার আমাদের দেশ এবং আমাদের সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করুক। ’ এর পরপরই ভারত পাল্টা আক্রমণ চালায় এবং ৬ ডিসেম্বর, সোমবার, ভারতীয় সময় সকাল সাড়ে ১০টায় ভারত সরকার স্বাধীন ও সার্বভৌম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’কে স্বীকৃতি প্রদান করে। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ’৭১-এর ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে গৃহীত রাষ্ট্রের নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ উদ্ধৃত করে লোকসভার অধিবেশনে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘বাংলাদেশ “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ” নামে অভিহিত হবে। ’ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তৃতার পর লোকসভার সব সদস্য দাঁড়িয়ে তুমুল হর্ষধ্বনির মাধ্যমে এ ঘোষণাকে অভিনন্দন জানান। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভারত সরকার ও জনসাধারণের ভূমিকা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি।

স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ও মুজিববাহিনীর জন্য ৭ ডিসেম্বর ছিল এক বিশেষ দিন। এদিন মুজিববাহিনীর অন্যতম প্রধান হিসেবে আমার দায়িত্বপ্রাপ্ত অঞ্চল যশোর হানাদারমুক্ত হয়। যশোরের সর্বত্র উত্তোলিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। সেদিন সরকারের নেতৃবৃন্দ ও মুজিববাহিনীর কমান্ডারগণসহ আমরা বিজয়ীর বেশে স্বাধীন বাংলাদেশের শত্রুমুক্ত প্রথম মুক্তাঞ্চল যশোরে প্রবেশ করি। জনসাধারণ আমাদের বিজয়মাল্যে ভূষিত করে। সে আনন্দ অনুভূতির কথা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। মনে পড়ে, মেজর জেনারেল ওবানের কথা। তিনি দেরাদুনে আমাদের ট্রেনিং দিতেন। আরও মনে পড়ে মেজর জেনারেল সরকার ও ডি পি ধরের (শ্রীদুর্গাপ্রসাদ ধর, শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর উপদেষ্টা) কথা। যাঁরা প্রতি মাসেই কলকাতার হিন্দুস্তান ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে মুজিববাহিনীর চার প্রধানের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করে ভারত সরকারের সঙ্গে আমাদের কাজের সার্বিক সমন্বয় করতেন। মুজিববাহিনীর হেডকোয়ার্টার ছিল কলকাতা। দেরাদুনের ট্রেনিং ক্যাম্পে আমরা বক্তৃতা করতাম। ট্রেনিং শেষে মুজিববাহিনীর সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের দেশের অভ্যন্তরভাগে প্রবেশে সহায়তা করতেন মেজর জেনারেল সরকার। ভারত সরকার-প্রদত্ত অস্ত্র, অর্থ সহায়তায় সমন্বয় করতেন শ্রী ফণীন্দ্রনাথ ব্যানার্জি তথা পিএন ব্যানার্জি। তাঁকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। তিনি ভারতের পূর্বাঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। যিনি মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই অর্থাৎ ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পর অক্টোবরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে লন্ডনে দেখা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভারত সরকারের ভূমিকা কী হবে তা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেন। আমরা তাঁকে ‘মিস্টার নাথ’ বলে সম্বোধন করতাম। আমাদেরও ভিন্ন নাম ছিল। মণি ভাইয়ের নাম ‘মণি দে’, সিরাজ ভাইয়ের নাম ‘সরোজ বাবুু’, রাজ্জাক ভাইয়ের নাম ‘রাজেন দে’ এবং আমার নাম ‘তপন’। অনেকে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে মুজিববাহিনীর ভুল বোঝাবুঝির কথা বলেন। এটা সঠিক নয়। এখানে কারও ব্যক্তিগত খামখেয়ালির অবকাশ ছিল না। সবাই সুসংগঠিত-সুশৃঙ্খল। বাংলাদেশকে চারটি বৃহৎ অঞ্চলে বিভক্ত করে রাজনৈতিকভাবে অগ্রসর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সংগঠিত ছিল মুজিববাহিনী। প্রধান সেনাপতি আতাউল গনি ওসমানীর নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর (এফএফ) সঙ্গে একত্রে যুদ্ধ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মোকাবিলা করাই ছিল মূলত মুজিববাহিনীর কাজ। মুজিববাহিনীর অন্যতম প্রধান হিসেবে শ্রদ্ধেয় নেতা শেখ ফজলুল হক মণি ভাইয়ের দায়িত্বে ছিল তৎকালীন চট্টগ্রামের নোয়াখালী, কুমিল্লা, সিলেট, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও ঢাকা ডিভিশন (ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর বাদে); রাজশাহী বিভাগ (পাবনা ও সিরাজগঞ্জ বাদে) এবং উত্তরাঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন সিরাজ ভাই; রাজ্জাক ভাইয়ের দায়িত্বে ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল এবং সিরাজগঞ্জসহ এক বিরাট অঞ্চল আর আমার দায়িত্বে ছিল পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, বরিশাল এবং পটুয়াখালী জেলা। মুজিববাহিনীর ট্রেনিং হতো দেরাদুনে। দেরাদুনে ট্রেনিং শেষে আমার সেক্টরের যারা তাদের প্লেনে করে ব্যারাকপুর ক্যাম্পে নিয়ে আসতাম। মুজিববাহিনীর সদস্যদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের প্রাক্কালে বুকে টেনে, কপাল চুমু দিয়ে বিদায় জানাতাম। মুজিববাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্পে বক্তৃতায় আমরা বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে বলতাম, ‘প্রিয় নেতা! তুমি কোথায় আছ, কেমন আছ জানি না! যত দিন আমরা প্রিয় মাতৃভূমি তোমার স্বপ্নের বাংলাদেশকে হানাদারমুক্ত করতে না পারব, তত দিন মায়ের কোলে ফিরে যাব না। ’ ১৬ ডিসেম্বর যেদিন দেশ শত্রুমুক্ত হয়, সেদিন আমরা বিজয়ীর বেশে মায়ের কোলে ফিরে এলাম। ১৮ ডিসেম্বর আমি ও রাজ্জাক ভাই হেলিকপ্টারে ঢাকায় আসি। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পদার্পণ করি। চারদিকে সে কি আনন্দ, ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়! প্রথমেই ছুটে গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী পরম শ্রদ্ধেয়া বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল- বঙ্গবন্ধু পরিবারকে যেখানে বন্দী করে রাখা হয়েছিল সেখানে। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীর এডিসি ছিলেন এবং শেখ জামাল দেরাদুনে আমার সঙ্গেই ছিল।

 

কিন্তু বিজয়ের আনন্দ ছাপিয়ে কেবলই মনে পড়ছিল প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর কথা। যে স্বাধীন বাংলার সেøাগান তুলেছিলাম রাজপথে; যে বাংলার জন্য বঙ্গবন্ধুর গতিশীল নেতৃত্বে কাজ করেছি; পরমাকাক্সিক্ষত সেই বাংলাদেশ আজ হানাদারমুক্ত স্বাধীন। বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দ অপূর্ব দক্ষতায় দল-মত-শ্রেণি-নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে আস্থা ও বিশ্বাসে নিয়ে সফলভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন ২২ ডিসেম্বর। বিমানবন্দরে নেতৃবৃন্দকে বিজয়মালা দিয়ে অভ্যর্থনা জানাই। রাজপথে লাখ লাখ মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’ সেøাগানে সর্বত্র মুখরিত। দিকে দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশ আনন্দ মিছিল আর চারদিক থেকে মানুষ ছুটে আসছে আমাদের দেখতে। বিজয়ের সেই সুমহান দিনগুলোয় সাধারণ মানুষের চোখে-মুখে গৌরবের যে দীপ্তি আমি দেখেছি, সে রূপ বিজয়ের গৌরবমন্ডিত আলোকে উদ্ভাসিত। স্বজন হারানোর বেদনা সত্ত্বেও প্রত্যেক বাঙালির মুখে ছিল পরম পরিতৃপ্তির হাসি; যা আজও আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিন্তু বিজয়ের আনন্দ ছাপিয়ে কেবলই মনে পড়ছিল প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর কথা।

যার সঙ্গেই দেখা হয় সবার একই প্রশ্ন- ‘বঙ্গবন্ধু কোথায় আছেন, কেমন আছেন, কবে ফিরবেন?’ বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য সর্বস্তরের মুক্তিকামী বাঙালির ঘরে ঘরে রোজা, উপবাস এবং বিশেষ দোয়ার আয়োজন চলছিল। বঙ্গবন্ধুবিহীন বিজয় অপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অক্টোবরে বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবকে দেশদ্রোহের অভিযোগে শাস্তি পেতে হবে। ’ জাতিসংঘে নিযুক্ত পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগা শাহি বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের বিচার শুরু হয়েছে ১১ আগস্ট এবং দুই সপ্তাহের মধ্যে বিচার সমাপ্ত হবে। ’ দেশ স্বাধীন না হলে ডিসেম্বরেই বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হতো। কিন্তু আমরা জানতাম বীর বাঙালির ওপর নেতার আস্থার কথা। তিনি গর্ব করে বলতেন, ‘ওরা আমাকে হত্যা করতে পারে। কিন্তু বাংলার মানুষকে তারা দাবিয়ে রাখতে পারবে না। ওরা আমাকে হত্যা করলে লক্ষ মুজিবের জন্ম হবে। ’ ১৬ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয়ে বিজয় অর্জন করার পরও আমরা নিজেদের স্বাধীন ভাবতে পারিনি। কারণ, বঙ্গবন্ধু তখনো পাকিস্তান কারাগারে বন্দী। আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি ভারতের মহীয়সী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর কথা, যিনি নিরলসভাবে বিশ্বনেতৃবৃন্দ ও জনমতের কাছে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আবেদন করেছেন। আমরা পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করেছি সেদিন, যেদিন ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি বুকভরা আনন্দ আর স্বজন-হারানোর বেদনা নিয়ে জাতির পিতা তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, জাতীয় সংসদ।

ইমেইল : [email protected]

LEAVE A REPLY