ভোলা নিউজ ২৪ ডটকম:: চৈত্রের দুর্বিষহ গরমে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা। শুধু রাজধানী নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকদিন ধরে ডায়রিয়ার প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। আর রোগীর চাপ সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) বা কলেরা হাসপাতাল। প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৫০ জনের বেশি রোগী ভর্তি হচ্ছেন বিশেষায়িত হাসপাতালটিতে। এর মধ্যে রোববার রাত ১২টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ভর্তি হয়েছেন ৮৪৩ জন। এর আগের দিন শনিবার ভর্তি হন ১ হাজার ২৯৬ জন। অর্থাৎ চলতি মাসের ১০ দিনে ভর্তি হয়েছেন ১২ হাজার ৭৪৭ জন। যার দৈনিক গড় ১ হাজার ২৭৪ জন।
আর স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, চলতি বছরে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মোট ভর্তি হয়েছে ২ লাখ ৮৫ হাজার ৬৮৭ জন। তবে মার্চ এবং এপ্রিল মাসের কোনো তথ্য জানাতে পারেনি সংস্থাটি। এমনকি কতজনের মৃত্যু হয়েছে সেটাও জানাতে পারেনি তারা। আর আইসিডিডিআরবির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত ১৬ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত এ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৯ হাজার ৩৪০ জন রোগী। তবে রাজধানীর অন্য সরকারি হাসপাতালে তুলনামূলকভাবে রোগী ভর্তি কম হচ্ছে। এ ছাড়া অধিকাংশই শয্যাই ফাঁকা রয়েছে।
আর জনস্বাস্থ্যবিদ ও চিকিৎসকরা বলছেন, মানুষের খাওয়ার অভ্যাস যেমন বাইরের ফুটপাথের কিংবা বাসি খাওয়ার অভ্যাস পরিবর্তন না করলে কমবে না ডায়রিয়ার প্রকোপ। তবে টানা কয়েকদিন বৃষ্টি হলে প্রকোপ কিছুটা কমতে পারে। একই সঙ্গে বিশুদ্ধ পানি পান করা এবং বাসি-পচা খাবার এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
রোববার আইসিডিডিআরবি হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, হাসপাতাল থেকে যত রোগী বেরুচ্ছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ রোগী বেশি ঢুকছে। রোগীর সংকুলান করতে না পেরে হাসপাতালের বাইরে দুটি তাঁবু টানিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কিছুক্ষণ পর পর অ্যাম্বুলেন্স, সিএনজি করে একের পর এক রোগী আসছেন। কাউকে স্ট্রেচারে করে এনে হাসপাতালের বিছানায় শোয়ানো হচ্ছে। কেউ বাইরে অপেক্ষা করছেন। এর মধ্যে জরুরি বিভাগের সামনে রোগী ও স্বজনদের ভিড় বেশি দেখা গেছে। আর ডায়রিয়ায় আক্রান্তদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সরা।
ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে কলেরা হাসপাতালে ভর্তি মাতুয়ালের বাসিন্দা রওশন আরা। তিনি বলেন, আমি দুদিন ধরে অসুস্থ। পাতলা পায়খানা আর বমি হচ্ছে। ডায়রিয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, তাদের বাসার পানি চরম দুর্গন্ধ এবং ময়লা-আবর্জনা আসে, এমনকি মুখেও নেওয়া যায় না। বাড়িওয়ালার কাছে বারবার অভিযোগ করেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। আর দূষিত পানির খাওয়ার জন্যই তিনি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন বলেও জানান।
মুন্সীগঞ্জ থেকে ইয়াসমিন আক্তার তার দুই বছরের ছেলে আরাফ হোসেনকে নিয়ে গত দুদিন কলেরা হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। তিনি জানান, আমার ছেলে তিন দিন ধরে অসুস্থ। প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তির পর কোনো উন্নতি না হওয়ায় এখানে ভর্তি করেছেন। অতিরিক্ত গরমের কারণে তার ছেলের এই অবস্থা হয়েছে বলেও জানান তিনি। রাজধানীর উত্তরা বাসিন্দা মো. সোহেল রানাও তাদের বাসার দুর্গন্ধযুক্ত পানি খেয়ে ডায়রিয়ার আক্রান্ত হয়েছেন বলেও মনে করেন তিনি।
আইসিডিডিআরবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ১৫ হাজার ৯০১ জন ডায়রিয়া আক্রান্তকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে এই সংখ্যা কিছুটা কমে আসে। এই মাসে ১০ হাজার ৩৪৪ জন ডায়রিয়া আক্রান্তকে চিকিৎসা দেওয়া হলেও ১৫ মার্চ থেকে পরিস্থিতি পাল্টায়। প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ২০০ বেশি রোগী ভর্তি হয়। এর আগে গত ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে এ রকমই একটি প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল, যা একেবারে মহামারির রূপ ধারণ করে। সেটি স্থায়ী হয়েছিল মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, শুধু রাজধানী ঢাকায় জানুয়ারি মাসে ভর্তি হয়েছেন ৬ হাজার ৫৮৯ জন এবং ফেব্রুয়ারিতে ৬ হাজার ৭৮৩ জন। আর ঢাকা বিভাগে দুই মাসে মোট ভর্তি হয়েছেন ৯৩ হাজার ২০১ জন। তবে তবে মার্চ এবং এপ্রিল মাসের কোনো তথ্য জানাতে পারেনি সংস্থাটি। সুত্র সময়ের আলো
আইসিডিডিআরবির হাসপাতালের প্রধান ডা. বাহারুল আলম বলেন, আবহাওয়ার পরিবর্তন, অস্বস্তিকর গরমে প্রতিবছরই ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়ে যায়। এখন প্রতিদিনই বারশ’র বেশি রোগী ভর্তি হচ্ছে। রোগীর চাপ আগের মতোই আছে। তবে গত দুদিন ধরে রোগী কমেছে। ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে বয়স্ক রোগীর সংখ্যা বেশি । কারণ গরমের এই সময়ে শিশুরা কম আক্রান্ত হয়। তিনি বলেন, টানা যদি কয়েকদিন বৃষ্টিপাত হয় তা হলে আশা করা যেতে পারে রোগীর কিছুটা কমবে। আর ডায়ারিয়া হলে রোগীকে স্যালাইন খেতে দিতে হবে। স্যালাইনের পাশাপাশি সাধারণ পানি, ডাবের পানি ও অন্যান্য তরল পানীয় দিতে হবে। অবস্থা খারাপ হলে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
গরমের এই সময়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ সম্পর্কে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. মিজানুর রহমান বলেন, আমাদের হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীদের জন্য আলাদা কোনো ওয়ার্ড নেই। বর্তমানে ৪০ জনের মতো রোগী ভর্তি আছে। তিনি বলেন, কেউ যদি এ সময়ে ওয়াসার পানি ফুটিয়ে না খায় এবং বাইরের খোলা খাবার খায় তা হলে তার ডায়রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তাই খাবারের ব্যাপারে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।
কেন ডায়রিয়ার প্রকোপ কমছে না এ ব্যাপারে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গরমকালে বৃষ্টি না হলে ডায়রিয়ার প্রকোপ কমার সম্ভাবনা নেই। আর মানুষ যে হারে বাইরের খাবার বিশেষ করে ফুটপাথের খাবার খাচ্ছে। এসব খাবার খাওয়ার অভ্যাস না পরিবর্তন না করলে ডায়রিয়া হওয়াটাই স্বাভাবিক। প্রকোপ থেকে বাঁচতে বিশুদ্ধ পানি খাওয়ার পাশাপাশি বারবার হাত ধোয়া, বাইরের বাসি, খোলা খাবার এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।