-
ভোলা নিউজ২৪ডটকম।। কারওয়ান বাজারের রেললাইন ঘেঁষে গড়ে ওঠা পাইকারি মাছের বাজারে সামনের ফুটপাতে জনা বিশেক বিক্রেতা ডালায় ইলিশ সাজিয়ে বসে আছেন। রুপালি ইলিশের গায়ে সূর্যের আলো পড়ে চিকচিক করছে। চলছে ক্রেতা-বিক্রেতার দর-কষাকষি। বিক্রেতা ইলিশের দর হাঁকছেন প্রতি কেজি এক হাজার ৫০ টাকা। তা শুনে ক্রেতা ক্ষুব্ধ, ‘আরে ভাই, আল্লাহর দরিয়ার মাছের এত দাম!’
করোনাকালের প্রলম্বিত লকডাউনের সুফল দেশের নদ-নদীও পেয়েছে। ঘোলা পানির নদী এখন অনেকটা পরিষ্কার। শিল্পকারখানা কিছুদিন বন্ধ থাকার সুবাদে নদীর দূষণ কমেছে। তাই সাগর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ বুক ভরে অক্সিজেন নিতে নদীতে ঢুকেছে, জেলেদের জালে ধরাও পড়ে। বাজারে তাই ইলিশের সমারোহ। তবে একেক বাজারে একেক রকম দাম।
বিজ্ঞাপনযে দামে বাজারে ইলিশ বিক্রি হয়, তার অর্ধেক দাম পেলে জেলেদের জীবন বদলে যেত।
এক লাখ টাকার ইলিশ ধরা হলে
- অর্ধেক পাবেন জাল ও ট্রলারের মালিক।
- ১৪ শতাংশ পাবেন সারেং বা মাঝি।
- ট্রলারের সঙ্গে যুক্ত অন্যরা পাবেন ৪ শতাংশ।
- জেলেরা পাবেন মাত্র ২ শতাংশ।
- ৩০ শতাংশ ট্রলারের খরচ।
ইলিশের দাম বেশি হওয়ার পেছনে রয়েছে মাফিয়া চক্রের হাত। এই চক্রের জাল বঙ্গোপসাগর থেকে কলকাতা পর্যন্ত ছড়ানো। জেলেদের জিম্মি করে বছরের পর বছর তারা ইলিশের দরদাম ঠিক করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।
ইলিশ নিয়ে গবেষণার জন্য চাঁদপুরে ‘মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট’ নামে সরকারি একটি প্রতিষ্ঠান আছে। প্রতিষ্ঠানটির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মূল আবাস বঙ্গোপসাগরে হলেও দেশের ৪০টির বেশি নদীতে ইলিশ আসে। প্রতিবছর পাঁচ লাখ টনের বেশি ইলিশ ধরা পড়ে। ধরা পড়ার পরিমাণ অনুযায়ী উৎপাদনে হিসাব-নিকাশও ঠিক করা হয়। সেই হিসাবে গেল বছর ৫ লাখ ২৩ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে। আর এ বছরে তা সাড়ে পাঁচ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে। ইলিশের দাম ন্যূনতম পাঁচ শ টাকা কেজি হিসাব করা হলে উৎপাদিত ইলিশের বাজারমূল্য ২৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি। দেশে মোট মাছ উৎপাদনে ইলিশের অবদান সর্বোচ্চ ১১ শতাংশ আর জিডিপিতে জাতীয় মাছের অবদান ১ শতাংশের বেশি।
দেশের মোট উৎপাদিত ইলিশের ৬৬ ভাগের জোগান দেয় বরিশাল বিভাগের জেলাগুলো। সবচেয়ে বেশি ইলিশ ধরা পড়ে ভোলা ও বরগুনায়। ইলিশের সবচেয়ে বড় মোকাম হলো চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, পাথরঘাটা। এসব মোকাম থেকে বিভিন্ন হাত ঘুরে ইলিশ যায় ঢাকাসহ সারা দেশের পাইকারি ও খুচরা বাজারে। ইলিশ কেনাবেচার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, যে দামে বাজারে ইলিশ বিক্রি করা হয়, তার অর্ধেক দামও যদি জেলেরা পেতেন, তাহলে তাঁদের জীবন বদলে যেত।
বিজ্ঞাপনসব ধাপেই মধ্যস্বত্বভোগী
ইলিশ কেনাবেচার হদিস জানতে পক্ষ থেকে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ভোলা, বরিশাল ও চাঁদপুরের জেলে, নৌকার মাঝি, ট্রলারমালিক, দাদনদাতা, আড়তদার ও ইলিশ রপ্তানিকারকদের সঙ্গে কথা বলা হয়। সবার কথায় যা বেরিয়ে আসে তা হলো, সাগরে ইলিশ ধরা থেকে শুরু করে বাজারে বিক্রি পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ নিয়ন্ত্রণ করে সুবিধাভোগীরা। রাতারাতি এই বাধা ভাঙা দুরূহ ব্যাপার। মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে ইলিশ ধরা বন্ধ রাখার মৌসুমে সরকার জেলেদের যে সহায়তা দেয়, তা আসলে তাঁদের খুব একটা কাজে লাগে না। এই জেলেরা মূলত জাল-নৌকাবিহীন দিনমজুর। ‘লাভের গুড়ের পিঁপড়া’ হলেন তাঁরা, যাঁরা ইলিশ ধরা ও কেনার কাজে টাকা লগ্নি করেন।
ইলিশ ধরা থেকে বাজারজাতের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, ইলিশ ধরা জেলেদের সঙ্গে স্থানীয় আড়তের ব্যবসায়ীদের চুক্তি থাকে। সে অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা অমৌসুমে জেলেদের অর্থসহায়তা দেন। ইলিশ ধরার জাল ও খরচ দেন। শর্ত থাকে, ধরে আনা ইলিশ শুধু ব্যবসায়ীদের কাছেই বিক্রি করতে হবে। এই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আবার ঢাকার পাইকারি ইলিশ বিক্রেতাদের যোগাযোগ থাকে। অনেক সময় ঢাকার বড় পাইকারি বিক্রেতা ও রপ্তানিকারকেরা আড়তমালিকদের আগাম অর্থ দেন। পুরো প্রক্রিয়াটি যেহেতু আগাম অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে হয়, সে কারণে ইলিশ কেনাবেচাও বাজারের দামের চেয়ে কিছুটা কম হয়।
ইলিশ মাছ ধরায় খরচ কেমন, তা জানতে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ভোলা, বরিশাল ও চাঁদপুরের মাছ ব্যবসায়ী ও ট্রলারমালিকদের সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের একজন কক্সবাজারের নুনিয়াছটার ট্রলারমালিক গিয়াস উদ্দিন জানান, ইলিশ ধরার কাজে তাঁর পাঁচটি ট্রলার নিয়োজিত আছে। প্রতিটি ট্রলারের বিপরীতে বিনিয়োগ প্রায় কোটি টাকা। একটি ট্রলারে জেলে আছেন ১৮ থেকে ২২ জন। গিয়াস উদ্দিন বলেন, গত দুই মাসে তাঁর পাঁচটি ট্রলার গভীর সাগরে গিয়ে চার দফা ইলিশ ধরেছে। প্রতিটি ট্রিপে সময় লেগেছে ১০-১২ দিন। আহরিত ইলিশ বিক্রি থেকে তিনি আয় করেছেন তিন কোটি টাকা। মালিক হিসেবে তিনি পেয়েছেন দেড় কোটি টাকা। বাকি টাকা কীভাবে ভাগ হয়, তার হিসাবটাও জানা গেল তাঁর কাছ থেকেই। বললেন, যদি এক লাখ টাকার ইলিশ ধরা হয়, তাহলে অর্ধেক পাবেন জাল ও ট্রলারের মালিক। ১৪ শতাংশ টাকা পাবেন ট্রলারের সারেং বা মাঝি। ট্রলার চালানোর সঙ্গে যুক্ত অন্যরা পাবেন ৪ শতাংশ। আর জেলেরা পাবেন মাত্র ২ শতাংশ। বাকি ৩০ শতাংশ টাকা ট্রলারের খরচ হিসেবে ধরা হয়। ইলিশ ধরার কাজে দৈনিক ভিত্তিতে মজুরি দেওয়ার কোনো নিয়ম নেই।
বিজ্ঞাপনদাদনের চোরা ফাঁদ
বরগুনার একজন ট্রলারমালিক সমুদ্রগামী একটি ট্রলারকে সাগরে যাত্রা করতে জ্বালানি, বরফ, বাজার-সদাইসহ আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা খরচ হয়। আবার মৌসুমের শুরুতে জাল, ট্রলার মেরামত ও অন্যান্য খরচ মেটাতে ট্রলারমালিকদের তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়। সব মিলিয়ে একটি ট্রলার সাগরে ভাসতে ৬ থেকে ১০ লাখ টাকা আগাম খরচ লাগে। এই পুরো টাকা লগ্নি করেন আড়তদারেরা। মূলত এটাই হলো দাদন।
বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের আড়তদার বাবুরাম কর্মকার বলেন, ট্রলারমালিক তাঁদের কাছ থেকে ট্রলারপ্রতি অন্তত ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত দাদন নেন। যত দিন ট্রলারের ব্যবসা থাকবে, তত দিন ওই ট্রলার আড়তে মাছ দেবে। প্রতিবছর দাদনের টাকা বাড়ানো হয়। এই দাদনের বদলে অর্থ না দিয়ে মাছ দিতে হয়। যেসব ট্রলারমালিক দাদন নেন, তাঁরা আর কোনো দিনই জাল ছিঁড়ে বের হতে পারেন না। শর্ত থাকে, মাছ ধরার পর তা আড়তদারের কাছেই বেঁধে দেওয়া দরে বিক্রি করতে হবে। আড়তদার তা পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ কমিশন কেটে নেন।
বিজ্ঞাপনদাম ঠিক করে অদৃশ্য হাত
ভোলায় প্রধানত দুটি পদ্ধতিতে মাছ কেনাবেচা হয়। একটি পদ্ধতি হচ্ছে জেলে তাঁর আহরিত মাছ আড়তদারের ডালা বা ঝুড়িতে ফেললে উপস্থিত ক্রেতারা দর হাঁকবেন নিলাম ডাকার মতো। যিনি বেশি দর হাঁকবেন, তিনি মাছ পাবেন। আরেকটি পদ্ধতি হলো আড়তদার ও ফড়িয়ারা সলাপরামর্শ করে একটি দর ঠিক করেন। তবে দর হয় গ্রেড অনুসারে। ওজন ও আকার অনুসারে ইলিশকে চারটি ভাগে ভাগ করে দাম ঠিক করা হয়।
চাঁদপুরের মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বলেন, এত দিন ইলিশ নিয়ে নানা গবেষণা হলেও দাম নিয়ে কেউ মাথায় ঘামাননি। তবে দাম নিয়ন্ত্রণ করা হলে সাধারণ জেলেরা এর সুফল পাবেন। তাঁদের জীবনও বদলে যাবে।
ফোনেই বাজার নিয়ন্ত্রণ
কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ভোলা, বরিশাল ও চাঁদপুরের কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইলিশের দাম ওঠানামা করে ঢাকার বাজারদরের ওপর ভিত্তি করে। ঢাকায় ইলিশের দাম কমে গেলে ঘাটেও দাম কমে যায়। আবার ঢাকায় বাড়লে সেখানেও বাড়ে। সবই হয় মুঠোফোনে।
বিভিন্ন স্থান থেকে ইলিশ মাছ সংগ্রহ করে ঢাকায় বিক্রি করেন, এমন একজন উদ্যোক্তা প্রবীর কুমার সরকার বলেন, যেসব স্থানে ইলিশ ধরা পড়ে, সেখানে একটা ‘সিন্ডিকেট’ আছে। এর বাইরে গিয়ে ইলিশ কেনাবেচা করা যায় না। ঢাকায় যেসব ইলিশ পাওয়া যায়, তার একটা বড় অংশ আসে কোল্ডস্টোরেজ থেকে, যেগুলো সাধারণত ঈদের সময় সস্তায় কিনে রাখা হয়।
উত্তর চট্টলা উপকূলীয় মৎস্যজীবী জলদাস সমবায় কল্যাণ ফেডারেশনের অধীনে প্রায় ৪০ হাজার জেলে রয়েছেন। পতেঙ্গা থেকে সীতাকুণ্ডের সৈয়দপুর পর্যন্ত এই জেলেদের বসবাস। এই সমিতির সভাপতি লিটন দাস বলেন, মৌসুমের শুরুতে জেলেরা দাদন নেন। অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সাগরে যান। তাঁদের কাছে মাছ বিক্রি করতে হয়। আবার মাছ ধরে আসার পর ব্যাপারীদের কাছে বিক্রি করা হয়। দুই হাত বদল হয়ে পরে তা ভোক্তার কাছে যায়। হাত ঘোরার কারণে দাম বাড়ে।
ভোলার আড়তদারেরা জানান, সরাসরি মাছ বিক্রি করলে দাম ভালো পাওয়া যায়। কিন্তু চাঁদপুর ও বরিশাল মোকামে মাছ বিক্রি করলে সিন্ডিকেটের কবলে পড়তে হয়।
বিজ্ঞাপনচোরাই পথে ইলিশ যাচ্ছে ওপারে
কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ভোলা, বরিশাল, চাঁদপুর, সাতক্ষীরা, বেনাপোল, যশোরের মোকামে যেসব ইলিশ যায়, তা কি দেশের বাজারে বিক্রি হয়? এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, যশোর, সাতক্ষীরা, বেনাপোল দেশের বড় কোনো মাছের মোকাম নয়। তাহলে পাথরঘাটা, বরিশাল, পটুয়াখালীর মহীপুরের ইলিশ মোকামের আড়তদারেরা এই তিন মোকামে কেন ইলিশ পাঠাতে বেশি আগ্রহী।
জানা গেল, এই তিন মোকাম থেকেই চোরাই পথে একশ্রেণির ব্যবসায়ী পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ইলিশ পাচার করেন। প্রথমে দেশের বড় মোকাম থেকে এই তিন এলাকায় ইলিশ নিয়ে সংরক্ষণ করার পর নিজেদের সুবিধামতো তা ধীরে ধীরে সীমান্ত পার করেন সেখানের ব্যবসায়ীরা। কলকাতার মাছ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এই অঞ্চলের দাদনদাতা ও আড়তদারদের গোপন যোগাযোগ রয়েছে। মূলত কলকাতার কিছু মাছ ব্যবসায়ী কয়েক হাত ঘুরে দেশীয় আড়তদারদের মাধ্যমে প্রতিবছর ইলিশ মৌসুম ঘিরে বিপুল অর্থ লগ্নি করেন।
বরিশাল পোর্ট রোড আড়তদার সমিতির সভাপতি আশরাফ আলী দাবি করেন, কলকাতায় কিছু মাছ যায় এখান থেকে। অবৈধ পথে যায় কি না, সেটা তাঁর জানা নেই।
জানতে চাইলে নৌ পুলিশের প্রধান আতিকুল ইসলাম বলেন, ইলিশ সিন্ডিকেট শুধু বাজারই নিয়ন্ত্রণ করে না, তারা কারেন্ট জাল তৈরি ও অবৈধভাবে মাছ ধরার সঙ্গেও যুক্ত। বিভিন্ন সময় তাদের বিরুদ্ধে অভিযানও হয়েছে। এই চক্র খুবই শক্তিশালী।
ইলিশ ব্যবসায়ী, ট্রলারমালিক, আড়তদার ও ফড়িয়াদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জীবন বাজি রেখে সাধারণ জেলেরা সাগর ও নদ-নদী থেকে ইলিশ মাছ ধরে আনলেও বাজারের নিয়ন্ত্রণ তাঁদের হাতে নেই। জেলেদের কষ্টের ফসলের নিয়ন্ত্রণ অদৃশ্য মহাজনদের হাতে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বললেন, এটা ঠিক যে ইলিশের বাজার সিন্ডিকেটের হাতে। কিন্তু সেই চক্র থেকে কীভাবে বের হওয়া যাবে, তার পথ তিনি খুঁজবেন। মন্ত্রী মনে করেন, বাজার সিন্ডিকেটমুক্ত হলেই ইলিশের দাম কমে যাবে।