ছাত্রলীগ,আওয়ামীলীগ,বঙ্গবন্ধু,বাংলাদেশ এই চারটি নাম যেন সমার্থক-তোফায়েল আহমেদ

0
74

ভোলা নিউজ২৪ডটকম।।ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ এই চারটি নাম যেন সমার্থক। আধুনিক কালে বাঙালির জাতিসত্তাকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় সত্তায় অভিষিক্ত করতে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার সুদীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, অসীম ত্যাগ ও অবদান অনস্বীকার্য। আর এই ইতিহাস সৃষ্টির ক্ষেত্রে, সর্বব্যাপী রাজনৈতিক গণজাগরণে এক ও অনন্য ভূমিকা পালন করেছিল এদেশের ছাত্র আন্দোলনের বলিষ্ঠ ও লড়াকু সংগঠন ছাত্রলীগ।

১৯৭৩-এর ৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রজত জয়ন্তী পালন উপলক্ষ্যে নেতাকর্মীদের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘ছাত্রলীগের ইতিহাস বাঙালির ইতিহাস।’ কথাটি আক্ষরিক অর্থেই সত্য। ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ এই চারটি নাম যেন সমার্থক। আধুনিক কালে বাঙালির জাতিসত্তাকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় সত্তায় অভিষিক্ত করতে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার সুদীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, অসীম ত্যাগ ও অবদান অনস্বীকার্য। আর এই ইতিহাস সৃষ্টির ক্ষেত্রে, সর্বব্যাপী রাজনৈতিক গণজাগরণে এক ও অনন্য ভূমিকা পালন করেছিল এদেশের ছাত্র আন্দোলনের বলিষ্ঠ ও লড়াকু সংগঠন ছাত্রলীগ। নিজ জাতির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সুদীর্ঘ ইতিহাসের প্রতিটি ধাপে অগ্রণী ভূমিকা পালনের এমন দৃষ্টান্ত আন্তর্জাতিক ছাত্র রাজনীতিতে দুর্লভ। এজন্য বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগকে অভিহিত করেছিলেন অগ্রগামী রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে। অগ্রসর ভূমিকা পালনে দৃঢ়সঙ্কল্পবদ্ধ ছাত্রলীগ গৌরবময় জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রতিটি ধাপেই আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠিত করতে গিয়ে হারিয়েছে অসংখ্য নেতাকর্মী। মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগ হারিয়েছে প্রায় সতেরো হাজার নেতাকর্মীকে। প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা সংগ্রামে এই মহত্তর আত্মদান একটি ছাত্র সংগঠনের জন্য বিরল গৌরবের।

প্রতিষ্ঠালগ্নেই বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল। ’৪০-এর লাহোর প্রস্তাব নিয়ে বাঙালিদের সাথে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিশ্বাসঘাতকতা, মাত্র ৪.৫% লোক যে উর্দু ভাষায় কথা বলে সেই জনবিচ্ছিন্ন ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার উদ্যোগ, বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদে টালবাহানা সর্বোপরি নবীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়নে চরম উদাসীনতা শুরুতেই সদ্যোজাত পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বৈরতান্ত্রিক রূপটিকে স্পষ্ট করে তোলে। শাসক মুসলিম লীগের প্রতারণামূলক অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের তরুণ নেতৃত্ব বিদ্রোহ ঘোষণা করে গঠন করে ছাত্রলীগ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সংগঠিত করে ছাত্র সমাজের মাঝে রাজনৈতিক অধিকারের চেতনাকে জাগ্রত করার লক্ষ্যে ১৯৪৮-এর ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জনে হলে বঙ্গবন্ধু মুজিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় গঠিত হয় ছাত্রলীগ। গঠন প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, নূরউদ্দিন আহমেদ, নঈমউদ্দিন আহমেদসহ ১৪ জন প্রগতিবাদী ছাত্রনেতা। প্রতিষ্ঠার মহতীলগ্নে ১০টি গঠনমূলক আদর্শ-উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ছাত্রলীগের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরী; দেশরক্ষা; স্বার্থান্বেষী মহলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম; ছাত্র সমাজকে দলীয় রাজনীতি মুক্ত রাখা; নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে জেহাদ; আধুনিক ধ্যান-ধারণা ও কৃষ্টির মাধ্যমে উন্নত চরিত্রের অধিকারী বিপ্লবী কর্মী সৃষ্টি; জাতি ও দেশের কল্যাণে ছাত্র সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করা; জনকল্যাণে নিয়োজিত থাকা ও গণস্বার্থবিরোধী কর্মে সংগ্রাম; প্রাপ্ত বয়স্কদের সার্বজনীন ভোটাধিকারের দাবী আদায়; দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও চোরাকারবারীদের উচ্ছেদ সাধন এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক ছাত্র আন্দোলন পরিচালনার যে রেওয়াজ প্রচলিত আছে তার ধ্বংস সাধন। উপরোক্ত আদর্শ-উদ্দেশ্যর ধারক বাহক ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ছাত্র সমাজের অধিকার শুধু নয় গোটা বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রামী চেতনার মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছিল। মূলত মুসলিম লীগের একনায়কতান্ত্রিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে গণমানুষের অধিকার রক্ষার্থে পৃথক দল গঠনের পূর্বে অগ্রগামী সংগঠন হিসেবেই গঠিত হয়েছিল ছাত্রলীগ।

প্রতিষ্ঠার পরপরই মার্চের ২ তারিখে ছাত্রলীগের উদ্যোগে “রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” গঠিত হয়। আহ্বায়ক নির্বাচিত হন ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ছাত্রলীগ নেতা জনাব সামছুল আলম। গঠিত হওয়ার মাত্র ৬০ দিনের মধ্যে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে বাংলার ছাত্রসমাজ ইতিহাস সৃষ্টি করে। রাষ্ট্রের অন্যতম ভাষা বাংলার দাবীতে ১১ মার্চ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে সমগ্র দেশব্যাপী হরতাল, সভা ও বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচী পালনের মাধ্যমে “প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস” পালিত হয়। এ দিন হরতাল কর্মসূচিতে পিকেটিং করতে গিয়ে আহত ও গ্রেফতার হন ছাত্রলীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, দবিরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার শওকত আলী, খালেক নেওয়াজ খান প্রমুখ। রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে এটি ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রে প্রথম হরতাল। এ হরতালে সরকারের নৃশংস ভূমিকার প্রতিবাদে ছাত্রলীগের আহ্বানে ১২ মার্চ সারা দেশে প্রতিবাদ সভা, ১৩ মার্চ সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট, ১৪ মার্চ সারা বাংলায় হরতাল পালিত হয়। ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের ডাকে লাগাতার আন্দোলনে টনক নড়ে সরকারের। ১৫ মার্চ তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন গভর্নর হাউজে (বর্তমানে বাংলা একাডেমীর বর্ধমান ভবন) মুসলিম লীগের সংসদীয় দলের এক বৈঠক ডাকেন। বৈঠক চলাকালে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে ও নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবীতে গভর্নর হাউজের বাইরে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীগণ বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ প্রণীত ও ছাত্রলীগ নেতা বঙ্গবন্ধু মুজিব অনুমোদিত ৭ দফা মেনে নেওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর বরাবরে দাবী জানাতে থাকে। তুমুল তর্ক-বিতর্কের পর শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ৭ দফা দাবী মেনে নিতে বাধ্য হন এবং সরকারের পক্ষে খাজা নাজিমউদ্দিন ও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে ছাত্রলীগ নেতা কামরুদ্দিন আহমেদ একটি চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করেন। ৭ দফা দাবী সম্বলিত চুক্তিনামাটি মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন মেনে নেওয়ার পর উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ তাকে ক্ষমা চেয়ে প্রত্রিকায় একটি বিবৃতি দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। এ নিয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্কের একপর্যায়ে খাজা নাজিমউদ্দিন নিজ হাতে আর একটি দফা যুক্ত করে অষ্টম দফায় লেখেন, ‘সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলোচনার পর আমি এব্যাপারে নিঃসন্দেহ হইয়াছি যে, এ আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা পরিচালিত হয় নাই।’ এটি ছিল পাকিস্তানি শাসকদের নাকে খত্ দেওয়ার শামিল। এরপর বঙ্গবন্ধু মুজিবসহ গ্রেফতারকৃত সব ছাত্রনেতৃবৃন্দকে মুক্তি দেওয়া হয়।

শাসকগোষ্ঠী ছাত্রনেতৃবৃন্দকে মুক্তি দিয়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজকে আপাত শান্ত করেই মেতে ওঠে নতুন চক্রান্তে। ৭ দফা দাবীর অন্যতম ৩ নং দফায় বলা হয়েছিল, ‘১৯৪৮ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদে বেসরকারি বিল আলোচনার জন্য নির্ধারিত তারিখে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার এবং তাকে পাকিস্তান গণপরিষদে এবং কেন্দ্রীয় চাকুরী পরীক্ষা দিতে উর্দুর সমান মর্যাদা দানের নিমিত্তে একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে।’ আর ৪ নং দফায় বলা হয়েছিল যে, ‘পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদে এপ্রিল মাসে একটি প্রস্তাব তোলা হবে যে, প্রদেশের অফিস-আদালতের ভাষা ইংরেজীর স্থলে বাংলা হবে।’ এই দু’টি দফা নিয়ে কর্তৃপক্ষের চক্রান্ত পরিস্থিতিকে পুনরায় অশান্ত করে তোলে। চক্রান্তের প্রতিবাদে ১৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু মুজিবের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল আইন পরিষদের সামনে অবস্থান নিলে পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জ করে। এতে বঙ্গবন্ধু মুজিবসহ ১৯ জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী আহত হন। ১৯ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন এবং ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমাবেশে ও ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে দু’স্থানেই দম্ভভরে ঘোষণা দেন, ‘…Urdu only Urdu shall be National and State language of Pakistan and none else…’ অর্থাৎ ‘…উর্দু কেবলমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের জাতীয় এবং রাষ্ট্র ভাষা অন্যকিছু নয়…।’ এর প্রতিবাদে বাংলার ছাত্রসমাজের সংগ্রামী সংগঠন ছাত্রলীগ ও এর নেতা বঙ্গবন্ধু মুজিব গর্জে উঠেছিলেন। সভাস্থলেই তাৎক্ষণিক ‘ঘড়’ ‘ঘড়’ অর্থাৎ ‘না’ ‘না’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছিল দশদিক। মাতৃদুগ্ধের মতোই মাতৃভাষা যে ধর্মবোধের চেয়ে অনেক বেশী পরাক্রমশালী তা প্রমাণ করে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানের স্রষ্টা জিন্নাহ সাহেবকে তা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে মাতৃভাষার প্রশ্নে, বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদার ও বর্গদার প্রথার উচ্ছেদে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা তথা বাক্ স্বাধীনতা রক্ষায় ছাত্রলীগের নেতৃত্ব প্রদানের শক্তি নিহিত ছিল সংগঠনের রাজনৈতিক আদর্শ-উদ্দেশ্যর মধ্যে।

’৪৮-এর ১১ মার্চের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্ব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান, ’৪৯-এ আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠায় সহায়ক শক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন, ’৫০-এ গণতান্ত্রিক যুবলীগের প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট তৈরী, ’৫২-এর অমর একুশে ফেব্রুয়ারির মহান ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করায় বাংলার ছাত্রসমাজের পক্ষে ছাত্রলীগই একক নেতৃত্ব প্রদান করে। এক কথায় বললে, ’৪৮ থেকে ’৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত অধ্যায় পর্যন্ত ছাত্রলীগ এককভাবে সেদিন ছাত্রসমাজের মুখপাত্র হিসেবে গুরুদায়িত্ব পালন করেছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নির্দেশিত আদর্শ-উদ্দেশ্যর প্রতি অবিচল নিষ্ঠায় লেগে থেকে ৪ বছরের সংগ্রামের মধ্যদিয়ে ছাত্রলীগ অর্জন করে অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ। যার প্রতিফলন ঘটে ’৫৩ সনে অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের কাউন্সিল অধিবেশনে। বঙ্গবন্ধু মুজিবের নির্দেশে সর্বসম্মতিক্রমে অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে মুসলিম ছাত্রলীগের স্থলে ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’ নামকরণ করা হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগের অসাম্প্রদায়িকরণের পূর্বেই ছাত্রলীগকে অসাম্প্রদায়িক করা হয়। এর পর একই বছরে ডাকসু ও বিভিন্ন হল সংসদের নির্বাচনে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ উদ্যোগে ‘গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট’ নামে একটি নির্বাচনী জোট গঠিত হয়। গঠিত জোট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং হল সংসদ সমূহের নির্বাচনে আশাতীত সাফল্য অর্জন করে এবং মুসলিম লীগ সমর্থিত নিখিল পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করতে বাধ্য করে।

ছাত্রলীগের প্রস্তাবে ও নেতৃত্বে গঠিত ‘গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্টের’ চেতনাই পরবর্তীতে জাতীয় রাজনীতিতে ’৫৪-এর ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠন করার ভিত্তি তৈরী করে এবং হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করে মুসলিম লীগকে বিদায় দেয়। নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে ২২২টি আসনেই যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী বিজয়ী হয়। যুক্তফ্রন্ট গঠনে এবং যুক্তফ্রন্টের বিজয়ে ছাত্রলীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এরপর ১৯৫৫-এর ২১, ২২ ও ২৩ অক্টোবরে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ৩ দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশনে দলের সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ গঠনের ব্যাখ্যাদানকালে বলেন, ‘…বন্ধুগণ! একথা অনস্বীকার্য যে, যে সময়ে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয় তখনকার বাস্তব প্রয়োজন অনুযায়ী আমাদের সংগঠনকে একটি ‘সাম্প্রদায়িক’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হয়েছিল। মুসলিম লীগ পাকিস্তানের জনগণের ধর্ম্মানুরাগের সুযোগে ইসলামকে হাতিয়ার করেই তার শাসন অব্যাহত রেখেছিল। জনগণও তখন লীগ সরকারের বিভ্রান্তি হতে নিজেদেরকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করতে সক্ষম হয়নি। এ অবস্থায় আমাদের সংগঠনকে অসাম্প্রদায়িক করা সম্ভব হলেও মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল প্রভাবের মোকাবিলা করার কাজে তা ব্যর্থ হতো। কিন্তু বর্তমানে সে অবস্থা আর নেই। মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আজ অবসান ঘটেছে। …আমরা দ্বিধাহীন চিত্তে এ-কথা ঘোষণা করতে পারি যে, দেশের সকল ধর্মের, সকল বর্ণের এবং সকল ভাষাভাষী মানুষকে একটি গণপ্রতিষ্ঠানে সমবেত করার প্রয়োজন। বস্তুত, আওয়ামী লীগ দলকে সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য অবারিত করার মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের প্রগতিশীল ভূমিকাকে অক্ষুণ্ন রাখতে সক্ষম হবো।’ ১৯৪৮-এ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৫৫ পর্যন্ত কালপর্বে ৭ বৎসরের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত চেতনার বলে ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু মুজিব অগ্রগামী বাহিনী ছাত্রলীগের মাধ্যমেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবসান ঘোষণা করে রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ ঘটান। যে ১০টি আদর্শ-উদ্দেশ্য ধারণ করে ছাত্রলীগের শুভ সূচনা হয়েছিল তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার মধ্য দিয়েই ছাত্রলীগের মতাদর্শিক চেতনার ভিত্তি স্থাপিত হয়। ’৫৮তে জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারী করে বিভিন্ন ফরমান-আদেশ বলে রাজনীতি করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্তদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে বিভিন্ন মেয়াদে যেমন, ১৪ বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ড, বেত্রাঘাত, অর্থ জরিমানাসহ বিভিন্ন ধরনের দণ্ড প্রদানের ব্যবস্থা করে। ফলে সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ হয়ে যায়। এমতাবস্থায় ছাত্রলীগ ‘শিল্প-সাহিত্য সংঘ’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গঠন করে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে সংগঠনের আদর্শিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। একদশকের সংগ্রামী অভিজ্ঞতায় শাণিত বঙ্গবন্ধু মুজিব নির্দেশিত আদর্শিক ভিত্তিভূমিতে দাড়িয়েই পরবর্তীকালে সমগ্র ষাটের দশক জুড়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সারা বাংলার ছাত্র-জনতা জেগে উঠেছিল জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে।

’৬০-এর দশকের শুরুতে স্বৈরশাসক আয়ুব বিরোধী আন্দোলনে বিশেষ করে শরীফ কমিশন ও হামুদুর রহমান কমিশনের শিক্ষানীতি, রবীন্দ্র চর্চা নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ছাত্রলীগ বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রদান করে। ’৬৪তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রুখতে ছাত্রলীগ সমমনা সংগঠনগুলোকে নিয়ে সাহসী ভূমিকা পালন করে। জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের অভিপ্রায় থেকে বঙ্গবন্ধু ’৬৬-তে জাতির উদ্দেশে ছয় দফা কর্মসূচী প্রদান করলে আইয়ুব খান গৃহযুদ্ধের এবং অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগের হুমকি প্রদান করেন। এরপর শুরু হয় ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের উপর দমন নীতি। বঙ্গবন্ধু জানতেন, ‘ছয় দফা’ই কেবল বাঙালীর স্বাধিকার তথা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত কর অখণ্ড পাকিস্তানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে। পক্ষান্তরে, পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ পাঞ্জাবীরা ‘ছয় দফা’ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সংখ্যাগুরু বাঙালীর রাষ্ট্র ক্ষমতায় আরোহন ঠেকাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে-যা পরিণামে স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। সফলভাবে সমাপ্ত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের পর বঙ্গবন্ধু সারা দেশ চষে বেড়ান। ২৬ মার্চ সন্দ্বীপ এবং ২৭ মার্চ সাতকানিয়ার বিশাল জনসভায় ‘ছয় দফা কর্মসূচী’ ব্যাখ্যা করে বক্তৃতা করেন। এরপর উত্তরাঞ্চল সফরে যান ’৬৬-এর ৭ এপ্রিল। ওইদিন পাবনা ও নগরবাড়ির  জনসমাবেশে বক্তৃতা করেন। একই মাসের ৮ তারিখ বগুড়া, ৯ তারিখ রংপুর, ১০ তারিখ দিনাজপুর, ১১ তারিখ রাজশাহী, ১৪ তারিখ ফরিদপুর, ১৫ তারিখ কুষ্টিয়া, ১৬ তারিখ যশোর এবং ১৭ তারিখ খুলনায় বিশাল সব জনসভায় ছয় দফার বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ বক্তৃতা করেন। এভাবে সারা দেশে ৩৫ দিনে মোট ৩২টি জনসভায় তিনি বক্তৃতা করেন। বিপুল সংখ্যক জনতার অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত লাগাতার জনসভায় প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতায় ‘ছয় দফা’র সপক্ষে জনমত প্রবল হয়ে ওঠে। ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের উপর নেমে আসে স্বৈরশাসক আইয়ুবের নির্মম গ্রেপ্তার-নির্যাতন। প্রত্যেক জেলায় অনুষ্ঠিত সভায় প্রদত্ত বক্তৃতার প্রতিপাদ্য বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধুকে প্রত্যেক জেলা থেকে জারীকৃত ওয়ারেন্ট বলে লাগাতার গ্রেফতার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এপ্রিলের ১৭ তারিখ রাত্রি ৪টায় খুলনায় এক জনসভায় ভাষণদান শেষে ঢাকা ফেরার পথে রমনা থানার জারীকৃত ওয়ারেন্ট অনুযায়ী পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৪৭ (৫) ধারা বলে পুলিশ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। যশোর মহকুমা হাকিমের এজলাস হতে তিনি জামিন পান। সেদিনই রাত ৯টায় সিলেটে গ্রেপ্তার, পুনরায় জামিনের আবেদন এবং ২৩ তারিখ জামিন লাভ। ২৪ এপ্রিল ময়মনসিংহে গ্রেপ্তার, ২৫ এপ্রিল জামিন। ‘ছয় দফা’ প্রচারকালে তিন মাসে বঙ্গবন্ধুকে সর্বমোট ৮ বার গ্রেফতার করা হয়। এভাবেই আইয়ুবের দমন নীতি অব্যাহত থাকে। একই বছরের ৮ মে নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ায় ঐতিহাসিক ‘মে দিবস’ স্মরণে শ্রমিক জনতার এক বিরাট সমাবেশে শ্রমিকরা বঙ্গবন্ধুকে বিপুল সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে এবং পাটের মালায় ভূষিত করে।  ভাষণদান শেষে রাত ১টায় তিনি যখন বাসায় ফেরেন তখন পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৩২ (১) ‘ক’ ধারা বলে তাঁকে সহ তাঁর ঘনিষ্ট রাজনৈতিক সহকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়। ‘ছয় দফা’ দেওয়াকে অপরাধ গণ্য করে স্বৈরশাসক আইয়ুব বঙ্গবন্ধুকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে অভিহিত করে দেশরক্ষা আইনের আওতায় আওয়ামী লীগের উপর অব্যাহত গ্রেপ্তার-নির্যাতন চালায়। সামরিক সরকারের এহেন কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের আহ্বানে ১৩ মে সমগ্র প্রদেশে ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালিত হয়। প্রতিবাদ দিবসের জনসভায় ‘ছয় দফা’র প্রতি গণমানুষের বিপুল সমর্থন প্রকাশ পায়। হাজার হাজার শ্রমিক এদিন স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালন করে এবং পল্টনে অনুষ্ঠিত জনসভায় উপস্থিত হয়ে সরকারের দমন নীতির তীব্র প্রতিবাদ করে। দলের নব-নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদকে গ্রেফতার করা হলে সাংগঠনিক সম্পাদক মিজান চৌধুরী অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নেতৃবন্দের গ্রেপ্তার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ২০ মে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ‘সাতই জুন’ সর্বব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। সাতই জুনের হরতালে সমগ্র পূর্ব বাংলা যেন অগ্নিগর্ভ। বিক্ষুব্ধ মানুষ স্বাধিকার ও বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবীতে সোচ্চার হয়।

আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছাত্রলীগের সার্বক্ষণিক কর্মী, ইকবাল হল (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি। সর্বজনাব শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, আমীর হোসেন আমু, সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী, আব্দুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, নূরে আলম সিদ্দিকীসহ আরো অনেকে-আমরা সেদিন হরতাল কর্মসূচী পালনের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করি। সেদিনের হরতাল কর্মসূচীতে ধর্মঘটী ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য সরকারের নির্দেশে পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। পুলিশের গুলিতে তেজগাঁয় শ্রমিক মনু মিয়া, মুজিবুল্লাহসহ এগারো জন শহীদ হন এবং প্রায় আটশ’ লোককে গ্রেফতার করা হয়। তেজগাঁ শিল্পাঞ্চলে হরতাল সফল করার দায়িত্বে ছিলেন ছাত্রনেতা খালেদ মোহাম্মদ আলী ও নূরে আলম সিদ্দিকী। তাঁরা সেখানে বক্তৃতা করেন। প্রকৃতপক্ষে সাতই জুন ছিল স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার পথের আরম্ভস্থল তথা যাত্রাবিন্দু। আর আমরা যারা ছাত্রলীগের কর্মী ছিলাম, আমাদের স্বাধীনতার চেতনার ভিত্তিও স্থাপিত হয়েছিল এদিনটিতেই।

১৯৬৭ সালের ১৭ জানুয়ারি। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)’র সহ- সভাপতি নির্বাচিত হই। তখন ৬ দফার আন্দোলন চলছে। বঙ্গবন্ধু কারাগারে অন্তরীণ। সেদিন রাতেই তাঁর কাছ থেকে একটা গোপন পত্র পাই। সেটাই বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া প্রথম চিঠি। তিনি লিখেছেন, ‘স্নেহের তোফায়েল, তুই ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হওয়ায় আমি খুব খুশি হয়েছি। আমি বিশ্বাস করি, এই ডাকসুর নেতৃত্বে বাংলাদেশে একটি আন্দোলন গড়ে উঠবে – মুজিব ভাই।’ একই বছরের শেষে সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করার জন্য তাঁকে প্রধান আসামী করে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের করে ঢাকা সেনানিবাসের একটি রুদ্ধদ্বার কক্ষে আটকে রাখে। এর প্রতিবাদে ১৯৬৮-এর ২৬ ডিসেম্বর ডাকসুর পক্ষ থেকে আমি সহ-সভাপতি এবং নাজিম কামরান চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমরা সমগ্র পাকিস্তানে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে কালো পতাকা উত্তোলন ও প্রদর্শনের কর্মসূচী গ্রহণ করেছিলাম। বাঙালির মুক্তি আন্দোলনে আমাদের সেদিনকার সিদ্ধান্ত ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে অক্ষয় হয়ে আছে। স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, ঐতিহাসিক ৬ দফার বিপুল জনপ্রিয়তা এবং সর্বোপরি ’৪৭ থেকে বঞ্চিত নির্যাতিত বাঙালির জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে হতাশা, শঠতা ও ভাওতাবাজির বিপরীতে একমাত্র ছাত্রলীগই বঙ্গবন্ধু মুজিবের নির্দেশে সমমনা অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলোকে একটি প্ল্যাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ করে পালন করেছিল এক ঐতিহাসিক ভূমিকা। এরই ধারাবাহিকতায় ’৬৯-এর ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে ‘ডাকসু’ কার্যালয়ে আমার সভাপতিত্বে এবং চার ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে এক সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম ‘কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে ছয় দফা দাবী আদায়ে এবং বঙ্গবন্ধুকে কারামুক্ত করতে বাংলার সর্বস্তরের মানুষসহ আমরা যারা ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম তারা ছয় দফাকে দাড়ি, কমা, সেমিকোলনসমেত এগারো দফায় অন্তর্ভূক্ত করে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি ঘোষণা করি। আমরা জানতাম আমাদের ১১ দফায় ধারিত আছে গণমানুষের আকাক্সক্ষাবোধ। আমরা অনেক নেতার কাছেই গিয়েছিলাম এই ১১ দফা সমর্থন করার আবেদন নিয়ে। আমার এখনো মনে আছে আহমেদুল কবীর সাহেবের বাসভবনে যখন ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটির (ডাক) সভা চলছিল সেদিন আমরা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কয়েকজন সেখানে উপস্থিত ছিলাম। আমরা তাঁদের কাছে বলেছি যে, ‘আমরা সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেছি। আমরা বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সহ সকল রাজবন্দীর মুক্তির জন্য, আইয়ুব শাহীর পতনের জন্য এবং গণতন্ত্রের জন্য ১১ দফা প্রণয়ন করেছি। আমরা আপনাদের সমর্থন চাই।’ সেদিন ডাকের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের আইয়ুব বিরোধী নেতা মাহমুদ আলী কাসুরী। তিনি সব দেখে শুনে বললেন, তোমরা শেখ মুজিবের ৬ দফাও তোমাদের ১১ দফায় অন্তর্ভুক্ত করেছো, সুতরাং তোমাদের ১১ দফা গ্রহণ করার বিষয়টি প্রশ্ন সাপেক্ষ। সরাসরিই তিনি বলতে গেলে আমাদের প্রত্যাখ্যান করলেন। আমরাও সাথে সাথে জানিয়ে দিলাম যে, আমরা আপনাদের সমর্থন চাইবার জন্য এসেছিলাম মাত্র। এর অর্থ এই নয় যে, আপনারা সমর্থন না করলে আমাদের ১১ দফা ভিত্তিক সংগ্রাম চলবে না। অবশ্যই চলবে এবং আমরা ১১ দফার সংগ্রাম অবশ্যই চালিয়ে যাবো। আমি বলেছিলাম, বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ যখন কোন দাবীর জন্য দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয় তখন পৃথিবীর কোন শক্তি নেই যে তা স্তব্ধ করতে পারে। ’৫২তেও দেশের সংগ্রামী ছাত্র সমাজ এমনি একবার ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে এবং তা অর্জিত হয়েছিল। তেমনি তথাকথিত আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে আমাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে যতদিন মুক্ত না করতে পারবো ততদিন ঘরে ফিরে যাবো না-আমরা অবশ্যই রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে ১১ দফা বাস্তবায়ন করবো। প্রয়োজনে আমরা আমাদের বুকের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে লড়াই করে যাবো। সেদিন সেই বৈঠক থেকে বেরিয়ে এসে সৈয়দ নজরুল ইসলাম-যিনি আজ আমাদের মধ্যে নেই, স্বাধীন বাংলাদেশে যাঁকে কারাপ্রকোষ্ঠে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে-তিনি বেরিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, অশ্রুসিক্ত চোখে তিনি আমাকে বুকে টেনে নিলেন এবং বললেন, ‘আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আমরা ছাত্রদের ১১ দফার প্রতি সমর্থন জানাচ্ছি। তোমরা এগিয়ে যাও। তোমরা একা নও। তোমাদের পাশে আর কেউ না থাকুক আওয়ামী লীগ থাকবেই।’ আওয়ামী লীগই প্রথম রাজনৈতিক দল আমাদের ১১ দফা দলীয় সিদ্ধান্ত অনুসারে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন জানিয়েছিল।

’৬৯-এর ৮ জানুয়ারি আমরা প্রয়াত নেতা মাওলানা ভাসানী সাহেবের কাছে গিয়েছিলাম। সব দেখে শুনে তিনি গম্ভীর থাকলেন কিছুক্ষণ। অতঃপর তিনি আমাদের বললেন, ‘আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি খুলনায় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সম্মেলন। সেই সম্মেলনে আমরা সিদ্ধান্ত নেবো ১১ দফা সমর্থন করবো কি করবো না। অবশ্য ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি, তার আগেই তারা আমাদের ১১ দফা সমর্থন করেছিলেন এবং সংগ্রামের মাঝপথে অংশগ্রহণও করেছিলেন। সম্ভবত, আমাদের আন্দোলনের দৃঢ়তা, দ্বিধাদ্বন্দ্বহীন উত্তালতা ও সফলতা পর্যবেক্ষণ করেই তারা আমাদের সমর্থন করতে এগিয়ে এসেছিলেন। আমরাও ১১ দফার মাধ্যমে ছাত্র সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে চরম সংগ্রামের দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। ৮ জানুয়ারি সম্মিলিত বিরোধী দল সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ৮টি বিরোধী দলের ঐক্যফ্রন্ট কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে ৮ দফা ভিত্তিক এক ঘোষণাপত্র প্রকাশ করে। ৯ জানুয়ারি দেশের ৮টি বিরোধী রাজনৈতিক দলের ঐক্যের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ তথা  Democratic Action Committee সংক্ষেপে ডাক গঠন করে। ১২ জানুয়ারি ডাক প্রাদেশিক সমন্বয় কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং ৮ দফা দাবীর ভিত্তিতে ১৭ জানুয়ারি দাবী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৭ জানুয়ারি বায়তুল মোকাররমে ডাক-এর আর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জমায়েত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের বটতলায় অনুষ্ঠিত হয়। ১১ দফা প্রণয়নের পর এটা ছিল প্রথম প্রত্যক্ষ কর্মসূচী। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে মোনেম খাঁ ১৪৪ ধারা জারী করে রেখেছেন। সভাপতি হিসেবে আমার উপর দায়িত্ব ছিল সিদ্ধান্ত দেওয়ার আমরা ১৪৪ ধারা ভাঙবো কি ভাঙবো না। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে পুলিশের লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস এমনকি গুলিও চলতে পারে গ্রেফতার তো আছেই। জমায়েতে উপস্থিত ছাত্রদের চোখেমুখে ছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গের দৃঢ়তা। যাঁরা বক্তৃতা করেছিলেন প্রায় সকলেই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষেই ছিলেন। শেষ পর্যন্ত আমি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে পাঁচ ’শ জন নিয়েই রাজপথে এলাম। মুহূর্তের মধ্যে পুলিশ বাহিনী ক্ষিপ্রগতিতে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বেপরোয়া লাঠিচার্জ শুরু করলো। আমরাও যতদূর সম্ভব প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করলাম। ফলে শুরু হলো কাঁদানে গ্যাস আর ফায়ারিং। ছাত্রলীগের সভাপতি জনাব আবদুর রউফ ঘটনা স্থলেই আহত হলেন।

উনসত্তরের আঠারোই জানুয়ারি, বটতলায় জমায়েত। যথারীতি আমি সভাপতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট ছিল। সকালে বটতলায় ছাত্র জমায়েতের পর খণ্ড খণ্ড মিছিল এবং সহস্র কণ্ঠের উচ্চারণ, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, আইয়ুব খানের পতন চাই।’ অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম গতকালের চেয়ে আজকের সমাবেশ বড়। সেদিনও বাইরে ১৪৪ ধারা। যথারীতি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজপথে নেমে এলাম। সেদিনও দাঙ্গা পুলিশ বেধড়ক লাঠিচার্জ আর টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করলো। ফিরে এলাম ক্যাম্পাসে। আবার জমায়েত। এবার মনে হলো ক্রমেই ভয় ভাঙছে এবং ছাত্রদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরদিন ছিল রবিবার। সে সময় রবিবার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকতো। কিন্তু প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় খোলা ছিল। কর্মসূচী নেওয়া হলো উনিশে জানুয়ারি আমরা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল শুরু করবো এবং ১৪৪ ধারা ভাঙবো। রবিবার প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই মিছিল শুরু হলো। শুরু হলো লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস। কিন্তু আজ আর কিছুই মানছে না ছাত্ররা। শঙ্কাহীন প্রতিটি ছাত্রের মুখ। গত দু’দিনের চেয়ে মিছিল আরো বড়। পুলিশ শেষপর্যন্ত গুলি চালালো। একজন ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়লো রাজপথে। ছাত্রলীগের এই কর্মীর নাম আসাদুল হক। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাড়ি দিনাজপুর। একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। পুলিশের বর্বরতা ও গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে বিশে জানুয়ারি সোমবার আবার বটতলায় সমাবেশের কর্মসূচী দেই।

বিশে জানুয়ারি উনসত্তরের গণআন্দোলনের মাইলফলক। এদিন ১১ দফার দাবীতে ঢাকাসহ প্রদেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণধর্মঘট পালিত হয়। সভাপতির আসন থেকে বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার পরিসর সমাবেশের তুলনায় ছোট মনে হচ্ছে। তিনদিনে আমরা সাধারণ ছাত্র ও বিপুল সংখ্যক জনসাধারণের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছি। আরো লক্ষ্য করলাম বটতলায় শুধু ছাত্র নয়, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ এসেও ভিড় করেছে। তারা সংগ্রামের কর্মসূচী চায়। আসাদুল হকের রক্তের প্রতিশোধ চায়। আমরা ভাবতেও পারিনি এতো ছাত্র এবং সাধারণ মানুষ আমাদের সমর্থন করবে। আমি যখন সভাপতির ভাষণ দিচ্ছি তখনও দলে দলে মানুষ আসছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা প্রাঙ্গণে। গুঞ্জন শোনা গেল মিল-কারখানা, অফিস-আদালত থেকে দলে দলে আরো মিছিল আসছে। সভাপতির ভাষণে আমি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঘোষণায় সেদিন বলেছিলাম, ‘যতদিন আগরতলা মামলার ষাড়যন্ত্রিক কার্যকলাপ ধ্বংস করে শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দীদের মুক্ত করতে না পারবো, ততদিন আন্দোলন চলবে। স্বৈরশাসক আইয়ুব-মোনায়েম শাহীর পতন না ঘটিয়ে বাংলার ছাত্রসমাজ ঘরে ফিরবে না।’ মুহূর্তে ফুঁসে উঠলো মিছিল! কোথায় গেল ১৪৪ ধারা! লক্ষ মানুষের মিছিলের ঢল নেমে এলো রাজপথে। মিছিলের এক প্রান্ত চলে গেল কতদূর আগে কে জানে! আমরা ছিলাম মাঝে। মিছিল যখন আগের কলাভবন বর্তমান মেডিকেল কলেজের সামনে ঠিক তখনই গুলি শুরু হয়। আমি, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী ও আসাদুজ্জামান আমরা তিনজন একসাথে ছিলাম। আমাদের লক্ষ্য করেই একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর গুলি ছোঁড়ে। গুলি লাগে আসাদুজ্জামানের বুকে। সাথে সাথে ঢলে পড়ে আসাদ। আমি আর খালেদ আসাদকে ধরাধরি করে মেডিকেল কলেজের দিকে নেওয়ার পথে আমাদের হাতের উপরেই সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। একজন শহীদের শেষনিঃশ্বাসটি আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। মৃত্যু এতো কাছে হাতের উপর! আমার শরীর তখন আগ্নেয়গিরির লাভায় পরিণত হয়েছে! মেডিকেলের সিঁড়িতে আসাদের লাশ রাখা হলো। এরপর আসাদের মৃতদেহ নিয়ে সকলে ছুটে যাই শহীদ মিনার চত্বরে। তাঁর গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত শার্টটি সংগ্রামের পতাকা করে আকাশে উড়িয়ে, আসাদের রক্ত ছুঁয়ে শপথ গ্রহণ করে সমস্বরে বলি, ‘আসাদ তুমি চলে গেছো। তুমি আর ফিরে আসবে না আমাদের কাছে। তোমার রক্ত ছুঁয়ে শপথ করছি, আমাদের দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাবো না।’ এরপর শহীদ আসাদের মত্যুর খবর ঘোষণা করলাম বিক্ষুব্ধ শোকার্ত জনতার মাঝে। আসাদের রক্তাক্ত পতাকা সামনে রেখে সমাবেশের উদ্দেশে বললাম, ‘আসাদের এই রক্ত আমরা বৃথা যেতে দেবো না।’ আমাদের সত্তা ও অস্তিত্ব আসাদের রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ হলো। শহীদ মিনার থেকে শুরু হলো শোক মিছিল। সকলের সামনে আমি এবং অন্যান্য ছাত্র নেতৃবৃন্দ।  হাজার হাজার মহিলা, গৃহবধূ, তরুণী, ছাত্র-ছাত্রী, শ্রমিক, কর্মচারী। শোক মিছিল মুহূর্তেই লক্ষ মানুষের বিক্ষোভ মিছিলে পরিণত হলো। আসাদের মৃত্যুর খবর ঢাকা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। চারদিক থেকে মানুষের স্রোত আসছে। ইতোমধ্যে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। শোক মিছিলের সম্মুখভাগ যখন তিন নেতার সমাধি সৌধের কাছে তখন মাইকে সেনাসদস্যদের কণ্ঠস্বর ‘ডোন্ট ক্রস, ডেঞ্জার-ডেঞ্জার, ডোন্ট ক্রস!’ কিন্তু শোক মিছিল শোকে আর ক্ষোভে উত্তাল। ‘ডেঞ্জার’ শব্দের কোন মূল্যই নেই সেই মিছিলের কাছে। মিছিল থামলো না, নির্ভয়ে এগিয়ে গেল। সামনে তাক করা অগণিত রাইফেল আর রাইফেলের সামনে পেতে দেওয়া লক্ষ মানুষের বুক। ডেঞ্জার ক্রস করে রক্তাক্ত লাল পতাকা নিয়ে এগিয়ে যায় আমাদের মিছিল। পল্টনে পৌঁছলাম আমরা। সেখানেও হাজার হাজার মানুষ আমাদের অপেক্ষায়। পল্টনে ঠাঁই নেই। লোকে লোকারণ্য। মজলুম নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মহিউদ্দীন আহমেদ, আবদুল মান্নানসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দের অংশগ্রহণে পল্টনে শহীদ আসাদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সবকিছুই ছিল অনির্ধারিত। মঞ্চ বা মাইক কিছুই ছিল না। কিন্তু সবাই চায় সংগ্রামের কর্মসূচী। অতঃপর শোকসভায় সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার পর একুশে জানুয়ারি অর্ধদিবস হরতাল এবং হরতালের পর পল্টনে সমাবেশের কর্মসূচী ঘোষণা করি।

একুশে জানুয়ারি পূর্বঘোষিত হরতালের কর্মসূচী পালনকালে কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটে। চারদিক থেকে স্রোতের মতো মানুষের ঢল নামে পল্টন ময়দানে। এদিনও মাইক, মঞ্চ কিছুই ছিল না। পল্টনে চারাগাছের ইটের বেস্টনির উপর দাঁড়িয়ে আমাকে বক্তব্য রাখতে হলো। বক্তৃতার পর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে তিনদিনের কর্মসূচী ঘোষণা করি-বাইশে জানুয়ারি শোক মিছিল, কালো ব্যাজ ধারণ, কালো পতাকা উত্তোলন। তেইশে জানুয়ারি সন্ধ্যায় মশাল মিছিল, পরে কালো পতাকাসহ শোক মিছিল। চব্বিশে জানুয়ারি দুপুর দুটো পর্যন্ত হরতাল। বাইশে জানুয়ারি, ঢাকা নগরীতে আমি এমন কোনো বাঙালী দেখিনি যাঁর বুকে কালো ব্যাজ নেই। বাড়িতে, অফিসে সর্বত্রই কালো পতাকা উড়ছে। সেদিনের কালো পতাকা ছিল শোকের, ঘাতকদের প্রতি ঘৃণার এবং সংগ্রামের দৃঢ় প্রত্যয়ের। একমাত্র ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া ঘৃণা প্রকাশের এই প্রতীকি প্রতিবাদ ছিল সর্বত্র। তেইশে জানুয়ারি, সন্ধ্যার পর শহরের সমস্ত অলিগলি থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বের হয় একটির পর একটি মশাল মিছিল। সমগ্র ঢাকা পরিণত হয় মশালের নগরীতে। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। চোখে না দেখলে বলে বোঝানো যাবে না।

চব্বিশে জানুয়ারি, অর্ধদিবস হরতাল পালিত হলো। সর্বাত্মক হরতাল। সাধারণ অচেনা-অজানা মানুষগুলো বঙ্গবন্ধুকে এতো ভালোবাসে, এতো গভীর সম্পর্ক তাঁর সাথে। সকলের মুখে মুখে একটিই প্রশ্ন ‘শেখ মুজিব কবে মুক্তি পাবে’? ‘কবে আগরতলা মামলা তুলে নেওয়া হবে?’ ‘যদি সরকার না মানে তাহলে কি হবে?’ ‘এমন সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে যেন আমরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে তাঁকে মুক্ত করে নিয়ে আসতে পারি।’ ‘এখনই আমাদের তুমুল সংগ্রাম শুরু করা উচিত যেন আইয়ুবের পতন ঘটে।’ ‘আইয়ুব-মোনায়েমের পতন না হলে শেখ মুজিব মুক্তি পাবে না।’ ঢাকা শহরের সর্বত্র এ ধরনের আলোচনাই চলছিল। হরতালের পরও মিছিলের বিরাম নেই। যেখানেই পুলিশ বিক্ষোভকারীদের বাধা দিচ্ছে সেখানেই খণ্ড যুদ্ধ। জনগণ এতোই ক্ষিপ্ত ও সাহসী হয়ে উঠেছিল যে, পুলিশ-ইপিআর-সেনাবাহিনীর গুলির ভয় কেটে গেছে তাদের। মিছিলে শরীক তখন শ্রমিক, কৃষক, দিনমজুর, হকার, রিক্সা চালক, ঠেলাগাড়ি চালক, ঘাটের কুলি, বৈঠা হাতে নৌকার মাঝি, ছোট দোকানদার, আড়তের কর্মচারী, হোটেল শ্রমিক আরো কত শত পেশার মানুষ। এ আন্দোলনের চেহারা অন্যরকম। অন্যরকম এ কারণে যে, এ আন্দোলনে ছিল বিপ্লবের প্রকৃতি ও প্রবণতা। কিন্তু নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে তারা ছাত্রদের তথা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের। এ দিকটায় আমি অত্যন্ত সচেতন ছিলাম। ডাকসু সহসভাপতি হিসেবে আমার স্কন্ধে তখন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়কের দায়িত্ব। সমগ্র বাংলাদেশ তখন আসন্ন গণঅভ্যুত্থানের বিস্ফোরণে প্রকম্পিত, অগ্নিগর্ভ। জনরোষ নিয়ন্ত্রণ করে নিয়মতান্ত্রিকতা বজায় রাখা যে কত কঠিন সেদিন মর্মে মর্মে অনুভব করেছি। হরতাল চলাকালে একজন মন্ত্রীর বাড়ীতে আগুন লাগিয়ে দিলো বিক্ষুব্ধ জনতা। কিছুক্ষণের মধ্যে ইপিআর এবং পুলিশ মরিয়া হয়ে ওঠে বিক্ষোভ দমনে। যত্রতত্র গুলি চালাতে থাকে। সে গুলিতেই নিহত হয়ে শহীদদের তালিকায় যুক্ত হয় মতিউর, মকবুল, আনোয়ার, রুস্তম, মিলন, আলমগীরসহ আরো অনেক নাম। আবদুল গনি রোডে এক মন্ত্রীর বাসভবনের সামনে গুলিবিদ্ধ হয় ঢাকার নবকুমার ইন্সটিটিউটের দশম শ্রেণীর ছাত্র মতিউর রহমান। আমরা তার লাশ নিয়ে পল্টনে যাই। এ হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। পল্টন, মতিঝিল, তৎকালীন জিন্নাহ এভিনিউ (বর্তমান বঙ্গবন্ধু এভিনিউ), বায়তুল মোকাররম, জিপিও, স্টেডিয়াম এলাকাসহ গোটা ঢাকা শহরের মানুষ তখন রাজপথে। তারা গভর্নর হাউস আক্রমণ করতে উদ্যত। ঢাকা তখন মিছিলের নগরী। চারদিকে বিক্ষোভ আর গগনবিদারী স্লোগান। তখনই শুনতে পাই মোনায়েম খান শহরের নিয়ন্ত্রণ ভার ছেড়ে দেবে সেনাবাহিনীর হাতে এবং অচিরেই কারফিউ জারী হবে। আমরা পল্টন থেকে ইকবাল হলে এলাম মতিউরের লাশ নিয়ে। যখন ইকবাল হলে পৌঁছলাম তখনই রেডিওতে ঘোষণা করা হলো ঢাকা শহরে কারফিউ বলবতের কথা। আন্দোলন যখন তুমুল আকার ধারণ করে তখন আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম যে, ‘যারা রাজপথে নামবে, মিছিলে আসবে, তাদের প্রত্যেকের পকেটে যেন নাম-ঠিকানা লেখা থাকে। কারণ কার কখন মৃত্যু হয়, কার বুকে কখন গুলি লাগে, এটা কেউ বলতে পারে না।’ সুতরাং, প্রত্যেকের পকেটে নাম-ঠিকানা লেখা ছিল। অপূর্ব সুন্দর দেখতে একটি ছেলে মতিউর। তার পকেটে হাত দিয়ে একটি কাগজ পেলাম। সেখানে লেখা ছিল, ‘মা আমি মিছিলে যাচ্ছি। যদি কোনদিন ফিরে না আসি মা, মনে করো, তোমার ছেলে মতিউর বাংলা মায়ের জন্য, প্রিয় নেতা শেখ মুজিবের জন্য জীবন দিয়ে গেলো। ইতি-মতিউর রহমান, দশম শ্রেণী, নবকুমার ইন্সটিটিউট, পিতা-আজহার আলী মল্লিক, ন্যাশনাল ব্যাংক কলোনী, মতিঝিল।’ সান্ধ্য আইনের মধ্যেই যখন আমরা মতিউরের লাশ নিয়ে ন্যাশনাল ব্যাংক কলোনীতে গেলাম, সে-এক করুণ দৃশ্য! সেখানেও হাজার-হাজার মানুষ। ক্রন্দনরত অবস্থায় শহীদ মতিউরের মায়ের কাছে যখন তার লাশ পৌঁছালাম, তিনি বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘আমার ছেলে চলে গেছে দুঃখ নাই, কিন্তু তোমাদের কাছে অনুরোধ, আমার ছেলের রক্ত যেন বৃথা না যায়।’ এখানে একটি কথা না উল্লেখ করলেই নয়, মতিউরের পিতা তখন বলেছিলেন, একুশে জানুয়ারি যেদিন পল্টনে জানাজা হয়, সেদিন মতিউর সেই জানাজায় ছিল। জানাজা থেকে ফিরে এসে বলেছিল, ‘বাবা, কেউ যদি শহীদ হয়, তার জানাজায় লক্ষ লক্ষ লোক হয়।’ তখনই মতিউরের পিতা উপলব্ধি করেছিলেন, আমার এই ছেলের মনের মধ্যে মিছিল ও দেশপ্রেম জাগ্রত হয়েছে। তাকে আর মিছিলে যেতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু চব্বিশে জানুয়ারি বাবা-মাকে ফাঁকি দিয়ে সেই মিছিলে যোগদান করে তিনি শহীদ হয়েছেন। তার পিতা আজ বেঁচে নেই। ২০১৭ সালের সতেরোই জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। মৃত্যুর আগে উত্তরাতে তাঁর নামে পাঁচ কাঠা জমি আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দিয়েছেন। সেদিন শহীদ মতিউরের রক্ত আমরা বৃথা যেতে দেইনি। ঢাকা শহরের বিবেক নড়ে উঠেছিল। কারফিউ কোথায়? মানুষ নেমে এসেছে রাজপথে। ক’জন মারবে ওরা? একসাথে হাজার হাজার, লাখ, লাখ! কটা গুলি ছুঁড়বে ওরা? ওরাও স্তম্ভিত হয়ে গেল। মানুষের পুঞ্জিভূত ঘৃণা এমন ভয়ঙ্কর ক্ষোভে পরিণত হয়, ওরা প্রচণ্ড বিস্ময়ে দেখলো শুধু! একদিকে কারফিউর কথা রেডিওতে বারবার ঘোষণা হচ্ছে, অপরদিকে রাজপথে বিক্ষুব্ধ মানুষের ভয়াল গর্জন এবং সরকারী ভবনগুলোতে আগুন জ্বলছে। ‘দৈনিক পাকিস্তান’, ‘মর্নিং নিউজ’ এবং ‘পয়গাম’ পত্রিকা অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয় উন্মত্ত জনতা। জ্বালিয়ে দেয় আগরতলা মামলার প্রধান বিচারপতি এস রহমান, নবাব হাসান আসকারীর বাড়ি, তৎকালীন এমএনএ এনএ লস্করের বাড়ি এবং রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধকারী খাজা সাহাবুদ্দিনসহ আরো কয়েক মন্ত্রীর বাসভবন।

উনসত্তরের চব্বিশে জানুয়ারি গণআন্দোলন-গণবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয় সর্বব্যাপী গণঅভ্যুত্থান। এরপর থেকে ছিল লাগাতার বিক্ষোভ। কারফিউর মধ্যে একদিনও থেমে থাকেনি আমাদের সংগ্রাম। ইতোমধ্যে দেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানী প্রশাসন বর্জন করেছে। কল-কারখানা, অফিস-আদালত, সচিবালয় সর্বত্র প্রশাসন ভেঙে পড়েছে। পুলিশ দ্বিধাগ্রস্ত। বড় বড় সরকারী কর্মকর্তাগণ জনগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সিদ্ধান্তের জন্য ধর্ণা দিতেন তখন ইকবাল হলে। কিছুদিনের জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্র তথা ইকবাল হলের ৩১৩ নম্বর কক্ষ। চব্বিশে জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা ১১ দফার প্রতি ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীসহ বাংলার সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন আদায় করতে পেরেছিলাম। ১১ দফার পক্ষে নারী-পুরুষ-শিশু-যুবক-বৃদ্ধ সবাই তখন ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে এসেছিল।

মনে পড়ে, নয়ই ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ‘শপথ দিবস’ পালনের কথা। সেদিনের শপথ দিবসের সভা আমার সভাপতিত্বে শুরু হয় এবং আমরা ১০ জন ছাত্রনেতা ‘জীবনের বিনিময়ে হলেও ১১ দফা দাবী বাস্তবায়ন করবো’-জাতির সামনে এই অঙ্গীকার ব্যক্ত করার শপথ নিয়ে স্লোগান তুলি, ‘শপথ নিলাম শপথ নিলাম মুজিব তোমায় মুক্ত করবো, শপথ নিলাম শপথ নিলাম মাগো তোমায় মুক্ত করবো।’

সারাক্ষণ

উনসত্তরের চৌদ্দই ফেব্রুয়ারি ছিল আন্দোলনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। যেদিন ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি তথা ডাকের মিটিং ছিল পল্টন ময়দানে। ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। আমাদের আজকের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা-যেখানে বঙ্গবন্ধুর বিচারকার্য চলছিল সেখানে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। গাড়ি চালিয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় ডক্টর ওয়াজেদ মিয়া। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রয়াত স্বামী। বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখেই বুকে টেনে নিয়ে আদর করে বলেছিলেন, ‘আজকে তুই পল্টনে বক্তৃতা করিস।’ আমি তখন বলেছিলাম, আমরা তো রাজনৈতিক দলের নেতাদের সভায় বক্তৃতা করি না। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘সাংবাদিকরা যেখানে বসা থাকবে তুই সেখানে থাকবি। তোকে দেখলেই মানুষ চাইবে। তুই বক্তৃতা করিস।’ একজন মানুষ প্রায় ৩৩ মাস কারাভ্যন্তরে বন্দী, অথচ তিনি যা বলেছেন অক্ষরে অক্ষরে তাই হয়েছে। জনসভা শুরু হলো আমরা ছাত্রসমাজ গেলাম, সাংবাদিকরা যেখানে বসেন, তার কাছাকাছি থাকলাম। ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি’র সভাপতি ছিলেন নুরুল আমিন। যখন সভামঞ্চ থেকে নুরুল আমিনের নাম প্রস্তাব করা হলো, তখন সমস্ত মানুষ সে-নাম ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলো। আমি ব্যক্তিগত কথা বলছি বলে দুঃখিত, ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। জনসভার মানুষ সমবেত কণ্ঠে চিৎকার করে বলে উঠলো, ‘আমরা তোফায়েল আহমেদকে চাই।’ আমি মঞ্চের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারিনি, মঞ্চ থেকে জননেতা আবদুস সামাদ আজাদসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ আমাকে মঞ্চে তুলে নিলেন। বুকে প্রিয়নেতা বঙ্গবন্ধুর ছবি ধারণ করে আমি বক্তৃতা করে বলেছিলাম, সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন আমাদের প্রিয়নেতা আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন। উল্লেখ্য যে, আইয়ুব খান তখন সর্বদলীয় গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করেছিলেন। আমাদের মধ্য থেকে প্রশ্ন উঠেছিল গোলটেবিল বৈঠকে যাওয়া হবে কিনা। আমরা বলেছিলাম, ‘যাওয়া হবে। তবে নেতৃত্ব দেবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি আমাদের প্রিয়নেতা শেখ মুজিব।’ এই পরিস্থিতি সামনে রেখে জনতার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি ছাড়া আপনারা কী গোলটেবিল বৈঠক চান?’ লক্ষ লক্ষ মানুষ গগনবিদারী কণ্ঠে বলেছিল, ‘না, চাই না, চাই না।’ ইতিমধ্যে প্রিয়নেতাকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে নেওয়ার একটি ষড়যন্ত্র চলছিল। আমি সেই বিষয়টিও জনতার সামনে তুলে ধরে প্রশ্ন রেখেছিলাম, ‘আপনারা কী শেখ মুজিবের প্যারোলে মুক্তি চান?’ মানুষ বললো, ‘না না, চাই না।’ তখন নেতৃবৃন্দকে আমরা বললাম, ‘নেতৃবৃন্দ, আপনারা যাবেন। কিন্তু প্রিয়নেতা শেখ মুজিবকে ছাড়া আপনারা গোলটেবিল বৈঠকে বসবেন না।’ এটি ছিল প্যারোলে মুক্তি নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে যাওয়া-না-যাওয়া প্রশ্নে জনতার ম্যান্ডেট। বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে গোল টেবিল বৈঠকে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা হয়েছিল। পাকিস্তানের তথ্য মন্ত্রী কাজী সাহাবুদ্দিন, নেভাল চীফ এআর খানসহ আরও অনেকেই এসেছিলেন। কিন্তু সে-সব প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রিয় সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে বলেছিলেন, ‘মানুষ তোমার সম্পূর্ণ মুক্তি চায়। তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে, তোমকে প্যারোলে মুক্তি দেবার জন্য। তুমি কোনদিন প্যারোলে রাজী হবে না।’ বঙ্গবন্ধুকে যখন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, তখন তিনি ঘৃণাভরে সে প্রস্তাব প্রত্যাখান করে বলেছিলেন, ‘আমি মুক্ত মানুষ হিসেবেই গোল টেবিল বৈঠকে যাবো।’ যে কারণে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দল সৈয়দ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে লাহোরে গিয়েছিলেন গোল টেবিল বৈঠকে। কিন্তু তাঁরা শর্তারোপ করেছিলেন, ‘আমাদের দলের নেতৃত্ব দিবেন শেখ মুজিবুর রহমান। যতক্ষণ তিনি না আসবেন, ততক্ষণ আমরা গোল টেবিল বৈঠকে বসবো না।’

চৌদ্দই ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত তথা পনেরোই ফেব্রুয়ারি ক্যান্টনমেন্টে আটকাবস্থায় সার্জেন্ট জহুরুল হক ও সার্জেন্ট ফজলুল হককে গুলি করা হয়। সার্জেন্ট জহুরুল হক শহীদী মৃত্যুবরণ করেন এবং সার্জেন্ট ফজলুল হক গুরুতর আহত হন। পনেরো তারিখ সার্জেন্ট জহুরুল হকের লাশ আমরা প্রথমে এলিফ্যান্ট রোডে তাঁর বাসভবনে এবং পরে ইকবাল হলে নিয়ে এলাম। বিক্ষুব্ধ মানুষ রাজপথে নেমে এলো। পুনরায় সান্ধ্য আইন জারী হলো। সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে রাজপথে প্রতিবাদ মিছিল করি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডঃ শামসুজ্জোহাকে আঠারোই ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানী সেনারা বেয়নেট চার্জে নির্মমভাবে হত্যা করে পুনরায় সান্ধ্য আইন জারী করে। যথারীতি আমরা সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে প্রতিবাদ কর্মসূচী অব্যাহত রাখি। একজন শিক্ষক ছাত্রদের রক্ষার জন্য বুলেট-বেয়োনেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছিলেন। সেদিনের স্মৃতি আমার মানসপটে ভেসে ওঠে। তারপর বিশে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সান্ধ্য আইন। সান্ধ্য আইনের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা সান্ধ্য আইন ভাঙবো এবং শহরকে মিছিলের নগরীতে রূপান্তরিত করবো। সংগ্রামী ছাত্র-জনতা আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও প্রিয়নেতা বঙ্গবন্ধু মুজিবের মুক্তির দাবীতে উত্তাল হয়ে ওঠে। ছাত্র-জনতা ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করতে উদ্যত হয়। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব জনাব সালাহউদ্দিন, ঢাকার ডিসি এমকে আনোয়ার, তথ্য সচিব ওবায়দুল্লাহ খান, তারা ইকবাল হলে এসে আমাদের সাথে আলাপ করে বললেন, আমরা যেন মিছিল না করি। আমরা বলেছি, ‘মিছিল আমরা করবোই। বরং আপনারা কার্ফ্যু প্রত্যাহার করুন।’ তখন জিওসি জেনারেল মুজাফফরউদ্দিনের সাথে পরামর্শ করে, তারা সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করলেন। বিশে ফেব্রুয়ারি সমগ্র ঢাকা নগরীকে মশাল আর মিছিলের নগরীতে পরিণত করলে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।

পরদিন একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে পল্টনে আমরা বিশাল জনসভা করেছি। যে জনসভায় বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী অজিত রায় তাঁর দরাজ কণ্ঠে গেয়েছিলেন সেই বিখ্যাত গান, ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে এই জনতা…।’ সেদিন আমরা ১০ জন ছাত্রনেতা বক্তৃতা করেছি। পল্টনের জনসমুদ্রে আমি সভাপতির ভাষণে প্রিয় নেতা শেখ মুজিবসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক সকল রাজবন্দীর নিঃশর্ত মুক্তির দাবীতে আল্টিমেটাম প্রদান করে বলি, ‘২৪ ঘন্টার মধ্যে শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দীর নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। নইলে বাংলার ঘরে ঘরে আগুন জ্বলে উঠবে।’ সেদিন সমগ্র দেশ প্রচণ্ড গণবিস্ফোরণে প্রকম্পিত হয়। জনরোষের ভয়ে ঠিকই পরদিন বাইশে ফেব্রুয়ারি দুপুর বারোটায় প্রিয়নেতাকে তথাকথিত লৌহমানব স্বৈরশাসক আইয়ুব খান বাধ্য হয়ে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়ে তাঁর বাসভবনে পৌঁছে দিয়েছিলেন। দেশজুড়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। আমি ছুটে যাই। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনের সামনে তখন হাজারো মানুষ প্রিয়নেতাকে একনজর দেখতে চায়, তাঁর কথা শুনতে চায়। ওদিকে পল্টন ময়দানে তখন লক্ষ লক্ষ লোক। সকলেই প্রত্যাশা করছে প্রিয়নেতা সেখানে যাবেন। কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, পল্টনে না, আমরা আগামীকাল তেইশে ফেব্রুয়ারি আমাদের প্রিয়নেতাকে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে রেসকোর্স ময়দানে গণসংবর্ধনা জ্ঞাপন করবো। আমরা রওয়ানা করেছিলাম। পরে পথে গাড়ি ঘুরিয়ে শেরেবাংলা নগর হয়ে তাঁকে বাসভবনে পৌঁছে দিয়ে পল্টনে গিয়ে প্রতীক্ষারত জনতাকে আমাদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে বললাম, ‘আগামীকাল গণসংবর্ধনা হবে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)।’ সেখানে তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত কমরেড মণি সিংহসহ অন্যান্যরা অবস্থান করছিলেন। উল্লেখ্য যে, বঙ্গবন্ধুর মুক্তির আগেই সকল রাজবন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। কারাগারে আর কোন রাজবন্দী ছিল না। কারণ বঙ্গবন্ধুর শর্ত ছিল, ‘একজন রাজবন্দীও যদি কারাগারে থাকে তাহলে আমি মুক্তি নেবো না।’

প্রিয় নেতাকে কারামুক্ত করার মধ্য দিয়ে শপথ দিবসের স্লোগানের প্রথম অংশ ‘মুজিব তোমায় মুক্ত করবো’, এবং ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে হাতিয়ার তুলে নিয়ে যুদ্ধ করে প্রিয় মাতৃভূমিকে হানাদার মুক্ত করে স্লোগানের দ্বিতীয় অংশ ‘মাগো তোমায় মুক্ত করবো’ বাস্তবায়ন করেছিলাম। বস্তুত, ’৬৬-এর আটই মে’র গভীর রাতে ৬ দফা কর্মসূচী প্রদানের অভিযোগে দেশরক্ষা আইনে যে মুজিব গ্রেফতার হয়েছিলেন, ৩৩ মাস পর ’৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি যে মুজিব মুক্তিলাভ করেন-নাম বিচারে এক হলেও, বাস্তবে ওই দুই মুজিবের মধ্যে ছিল গুণগত ফারাক। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তথা ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ মামলাটি ছিল সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য অগ্নিপরীক্ষার মতো। সেই অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ফাঁসিকাষ্ঠের বন্দীদশা থেকে মুক্ত মানব হয়ে তিনি বেরিয়ে আসেন। বাইশ তারিখ আমরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেই, আমাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে আমরা সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা জানাবো। সেই সিদ্ধান্ত অনুসারে রেসকোর্স ময়দানে তেইশে ফেব্রুয়ারি বিকাল ৩টায় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়। সেদিনের রেসকোর্স ময়দান যারা দেখেননি তাদের বলে বোঝানো যাবে না সেই গণমহাসমুদ্রের কথা। আমরা যখন সেখানে পৌঁছেছি, তখন রেসকোর্স ময়দানে মানুষ আর মানুষ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্রেন, বাস, ট্রাক, লঞ্চ-স্টিমার বোঝাই হয়ে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, কৃষক-শ্রমিক, সাধারণ মানুষ ছুটে এসেছে। ঢাকার মানুষ তো আছেই। অভিভূত হয়ে পড়লাম। এর পূর্বে এতবড় জনসভা দেখিনি। এটা জনসভা ছিল না, ছিল গণমহাসমুদ্র। সেই জনসমুদ্রে লক্ষ লক্ষ লোক এসেছে প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে একনজর দেখতে, তাঁর কথা শুনতে। প্রিয় নেতাকে নিয়ে আমরা মঞ্চে উঠলাম। তখন একটা রেওয়াজ হয়েছিল যে, প্রত্যেকটি সভায় আমি সভাপতিত্ব ও সভা পরিচালনা করতাম। কে বক্তৃতা করবেন সেই নামটিও ঘোষণা করতাম। সেদিন ঐ মঞ্চে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রেখেছিলেন। চিরাচরিত প্রথা ভঙ্গ করে আগেই সভাপতির ভাষণ দেওয়ার জন্য মঞ্চে দাঁড়িয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনুরোধ জানিয়ে বলেছিলাম, ‘সবার শেষে বক্তৃতা করার কথা থাকলেও আপনাদের অনুমতি নিয়ে আমি আগেই বক্তৃতা করতে চাই।’ দশ লক্ষাধিক লোকের সম্মতি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আগেই বক্তৃতা করি। আমার জীবনে এই বক্তৃতাটির কথা চিরদিন মনে থাকবে। সেদিন যে ভালোবাসা মানুষের কাছ থেকে পেয়েছি তা বলে বোঝাতে পারবো না। বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে বলেছিলাম, ‘প্রিয় নেতা তোমার কাছে আমরা ঋণী, বাঙালি জাতি চিরঋণী। এই ঋণ কোনদিনই শোধ করতে পারবো না। সারা জীবন এই ঋণের বোঝা আমাদের বয়ে চলতে হবে। আজ এই ঋণের বোঝাটা একটু হালকা করতে চাই জাতির পক্ষ থেকে তোমাকে একটা উপাধি দিয়ে।’ ১০ লক্ষাধিক লোক ২০ লক্ষাধিক হাত তুলে সম্মতি জানিয়েছিল। তখনই ঘোষিত হয়েছিল, “যে নেতা তাঁর জীবনের যৌবন কাটিয়েছেন পাকিস্তানের কারাগারে, ফাঁসির মঞ্চে দাড়িয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন সেই নেতাকে কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞ চিত্তে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হলো।” সংগ্রামী জনতা তুমুল করতালির মধ্য দিয়ে এই প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করে প্রিয় নেতাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে লক্ষ লক্ষ কণ্ঠে ধ্বনি তুলেছিল, ‘জয় বঙ্গবন্ধু।’ এভাবেই আমরা চূড়ান্ত বিজয়ের বীজ রোপণ করেছি এবং ‘মুক্ত মানব শেখ মুজিব’ গোল টেবিল বৈঠকে যোগ দিয়ে বাংলার মানুষের সার্বজনীন ভোটাধিকার ও সার্বভৌম পার্লামেন্ট নির্বাচনের দাবি তুলে ধরেছেন।

বাংলাদেশে অনেক আন্দোলন হয়েছে-বায়ান্নের মহান ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ৬ দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মহত্তর মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের মানুষ মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্য জীবন দিয়েছে। একেকটি আন্দোলনের একেক রকম চারিত্র্য-বৈশিষ্ট্য। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের বৈশিষ্ট্য এমন ছিল যে, তখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর বিচারের কাজ চলছিল। বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামী করে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ মামলা দায়ের করে ’৬৮-এর ১৯ জুন বিচারের কাজ শুরু হয় এবং বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলাবার জন্য আইয়ুব খান পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। আইয়ুব খানের তথ্য সচিব আলতাফ গওহর ‘আইয়ুব খান’ শিরোনামে একটি বই লিখেছেন। সেই বইয়ে উল্লেখ আছে কিভাবে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু উনসত্তরের গণআন্দোলনের শহীদদের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগ সেই ষাড়যন্ত্রিক প্রচেষ্টাকে সমাধিস্থ করে এবং আসাদ-মতিউর-মকবুল-রুস্তম-আলমগীর-সার্জেন্ট জহুরুল হক-ডঃ শামসুজ্জোহাসহ অগণিত শহীদের জীবনের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আন্দোলন সফল হয়। জানুয়ারির প্রথম দিকে নারায়ণগঞ্জের এক জনসভায় দম্ভোক্তি করে আইয়ুব খান বলেছিলেন তিনি আবার পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হবেন। অথচ সতেরোই জানুয়ারি আন্দোলন শুরু হলো, বিশে জানুয়ারি আসাদ শহীদ হলো, চব্বিশে জানুয়ারি শহীদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হলে সর্বব্যাপী গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হলে, সেই আইয়ুব খান একদিন পরই বলেছিলেন, ‘আমি আর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবো না।’ তার মানে কতো বড় আন্দোলন হতে পারে! একটি আন্দোলন সাত দিনের মধ্যে গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে, ছাত্র সমাজের নেতৃত্বে! এর তুলনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। আমরা সংখ্যাসাম্যের বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরুর অবস্থান থেকে ‘এক মাথা এক ভোট’ ও ‘সার্বভৌম পার্লামেন্ট’-এর দাবী তুলে তা আদায় করেছিলাম। ফলত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে আসন বণ্টনে সংখ্যাধিক্য আসন আমরা লাভ করেছিলাম। সেদিনের সংবর্ধনা সভার বক্তৃতায় আরো বলেছিলাম, ‘৬ দফা ও ১১ দফা কর্মসূচী বাস্তবায়নে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের রক্তের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আমরা ফিরে পেয়েছি। তাদের সে রক্ত যেন বৃথা না যায়, তার জন্য জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানাই। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্রসহ সকল মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য এই আন্দোলন শুরু হয়েছে।’ বক্তৃতা শেষ করে ঘোষণা করেছিলাম, ‘এখন বক্তৃতা করবেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।’ তুমুল করতালির মধ্যে তিনি বক্তৃতা করতে দাঁড়ালেন। চারদিকে তাকিয়ে উত্তাল জনসমুদ্রের উদ্দেশে বললেন, “রাতের অন্ধকারে সান্ধ্য আইনের কঠিন বেড়াজাল ছিন্ন করে যে মানুষ ‘মুজিবকে ফিরিয়ে আনতে হবে’ বলে আওয়াজ তুলে গুলির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে তাদের দাবীর সাথে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না।” সংগ্রামী ছাত্র সমাজকে আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ছাত্রদের ১১ দফা শুধু সমর্থনই করি না, এর জন্য আন্দোলন করে আমি পুনরায় কারাবরণে রাজী আছি। ছাত্রদের ১১ দফার মধ্যে আমার ৬ দফা দাবীও নিহিত রয়েছে। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি যদি এদেশের মুক্তি আনতে ও জনগণের দাবী আদায় করতে না পারি, তবে আন্দোলন করে আবার কারাগারে যাবো।’ সেদিন বঙ্গবন্ধু আরো বলেছিলেন, ‘আমি গোল টেবিল বৈঠকে যাবো, সেখানে আমার ৬ দফাও পেশ করবো, ১১ দফাও পেশ করবো।’ তিনি জীবদ্দশায় কোনদিন ১১ দফার কথা ভুলেননি। তাঁর বক্তৃতায় সবসময় উনসত্তরের গণআন্দোলনের কথা থাকতো। সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে আছে, ‘১৯৬৯-এর আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম।’ পরিশেষে স্বভাবসুলভ কণ্ঠে কৃতজ্ঞচিত্তে বলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, তোমরা যারা রক্ত দিয়ে জীবন দিয়ে আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করেছো, যদি কোনদিন পারি নিজের রক্ত দিয়ে আমি সেই রক্তের ঋণ শোধ করে যাবো।’ তিনি একা রক্ত দেননি, ’৭৫-এর পনেরোই আগস্ট সপরিবারে রক্ত দিয়ে বাঙালি জাতির রক্তের ঋণ তিনি শোধ করে গেছেন।

সেদিনের ছাত্রসমাজ সুনির্দিষ্ট আদর্শ ও লক্ষ্য নিয়ে সংগ্রাম করেছে। গণআন্দোলন চলাকালে ও পরে আমরা দেশের বহু জায়গা সফর করেছি। ডাকসু’র ভিপি ও পরে ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে দেশের বহুজায়গায় গিয়েছি। ট্রেনে যখন সফর করতাম আসন ছিল তৃতীয় শ্রেণীর কামরায়। তখন এতো বিলাস-বহুল সুদৃশ্য আধুনিক বাস বা যানবাহন ছিল না। আমরা বাসে করে বিভিন্ন সভাস্থলে যেতাম। ট্রেন, বাস থামিয়ে মানুষ আমাদের কথা শুনতে চেয়েছে। সেদিনের কথা ভাবলে গর্বে আমার বুক ভরে ওঠে। শিক্ষক সমাজ আমাদের নিকট পিতৃতুল্য ছিলেন। তারাও আমাদের সন্তানতুল্য গণ্য করতেন। তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল রাজনৈতিক নেতা তৈরীর কারখানা। ষাটের দশকের অনেক ছাত্রনেতাই আজ জাতীয় নেতা। তখনকার দিনে নিয়মিত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নূতন নূতন নেতা নির্বাচিত হতো। আমাদের সময়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভেদ থাকলেও নেতা-কর্মীদের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল মধুর। যে চারটি ছাত্রসংগঠন আমরা একত্রিত হয়ে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠন করে জাতির সামনে ১১ দফা দাবী পেশ করেছিলাম তাদের মধ্যে মত ও পথের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আমরা একই টেবিলে বসে ১১ দফা দাবী প্রণয়ন করেছি। নিজদের মধ্যে ঐক্যের দিকগুলো প্রাধান্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছি। ছাত্রসমাজের সাধারণ সমস্যাগুলো আমরা সামনে নিয়ে এসেছি। সকলের চিন্তাধারাকে সমন্বিত করেছি। ৬ দফা সকলে সমর্থন করতো না। ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপ ৬ দফা সমর্থন করতো না। অপরদিকে ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপ ৬ দফা সমর্থন করতো। আবার উভয়গ্রুপই বঙ্গবন্ধুর মুক্তির প্রশ্নে এককভাবে তাঁর নাম দিতে রাজি হয়নি। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তির দাবীতেই আন্দোলন কেন্দ্রীভূত হয়েছে, গতিশীলতা লাভ করেছে। আমাদের লক্ষ্যই ছিল ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। মত ও পথের পার্থক্যকে বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে দূরে রেখেছি। সহনশীল ও পরমতসহিষ্ণু থেকে সামাজিক সম্পর্ককে অটুট রেখেই রাজনীতি করেছি। এসব সত্ত্বেও দেশব্যাপী এমন একটি জনসমর্থিত তুমুল গণআন্দোলন সংগঠিত করতে পেরেছিলাম কেবল মানুষের সুবিপুল আস্থা আর বিশ্বাস আমাদের উপর ছিল বলেই। আমরা মানুষের বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়েছি। শহীদ মতিউরের মা ক্রন্দনরত অবস্থায় বলেছিলেন, ‘আমার সন্তানের রক্ত যেন বৃথা না যায়।’ আমরা মতিউরের রক্ত বৃথা যেতে দেইনি। বিশে জানুয়ারি আসাদের রক্তের মধ্য দিয়ে যে আন্দোলন রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল সেই আন্দোলনের সফল পরিণতি,-বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজবন্দীর নিঃশর্ত মুক্তি, প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার প্রাপ্তি, ’৭০-এর নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ এবং ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে মহত্তর বিজয় অর্জন। এই সবকিছু অর্জনের ড্রেস রিহার্সাল ছিল ঊনসত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলি-যা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে এবং থাকবে চিরদিন।

পঞ্চাশের দশক থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের লক্ষ্যে গড়ে তোলা সকল আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্রলীগ। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে ছাত্রলীগের আদর্শ-উদ্দেশ্যতে ছিল বাংলার মানুষের রাজনৈতিক অধিকার ‘প্রাপ্ত বয়স্কদের সার্বজনীন ভোটাধিকার’-এর দাবী। ’৬৯-এর মহান গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা তা অর্জন করেছিলাম। আমাদের অর্জিত সাফল্যের পথ ধরেই ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচন ও ’৭১-এর মহত্তর মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরী হয়েছিল। ’৭০-এর নির্বাচনে বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফা এবং ছাত্র সমাজের ১১ দফার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করে। এ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু আমাকে জাতীয় পরিষদে মনোনয়ন দেন এবং মাত্র সাতাশ বছর এক মাস পনেরো দিন বয়সে আমি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হই। যা আমি স্বপ্নেও কল্পনা করি নাই। ১৯৭১-এর জানুয়ারির ৩ তারিখে ঐতিহাসিক রেসকোর্সে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নব-নির্বাচিত সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। শপথ গ্রহণ করান স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। সেদিন বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘৬ দফা ও ১১ দফা আজ আমার নয়, আমার দলেরও নয়। এ-আজ বাংলার জনগণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। কেহ যদি এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে বাংলার মানুষ তাঁকে জ্যান্ত সমাধিস্থ করবে। এমনকি আমি যদি করি আমাকেও।’ সেদিন যে শপথনামা পাঠ করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা শপথ গ্রহণ করেছিলাম সেটি এখন এক ঐতিহাসিক দলিলে পরিণত হয়েছে। নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন ও শাসনতন্ত্র তৈরী করার জন্য অধিবেশনে মিলিত হতে না দিয়ে ’৭১-এর ১ মার্চ দুপুর ১টা ৫ মিনিটে এহিয়া খান এক বেতার ভাষণে পূর্বঘোষিত ৩ মার্চ ঢাকায় আহুত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছাত্র নেতৃবৃন্দকে ডেকে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের নির্দেশ দেন। নেতার নির্দেশে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আসম আব্দুর রব, আব্দুল কুদ্দুস মাখন এক বৈঠকে বিকেলে ছাত্রলীগ ও ডাকসুর সমন্বয়ে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। একমাত্র ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দই সবধরনের ঝুঁকির মধ্যে এ সিদ্ধান্ত নেয়। ২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয় এবং তাঁর নির্দেশে কলাভবনে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় স্বাধীন বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলিত হয়। ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ও উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পল্টনে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। আর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু মুজিব ঘোষণা করেন স্বাধীনতার অমোঘ মন্ত্র, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ আর ৮ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলনের রক্তঝরা দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর সর্বমোট ৩৫টি ঐতিহাসিক নির্দেশাবলী প্রতিটি বাঙালির কাছে হয়ে উঠেছিল অবশ্য পালনীয় অলঙ্ঘ্য বিধান। এরপর ২৫ মার্চ কাল রাতে নজীরবিহীন গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কর্তৃক ২৬ মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের সাবেক ও তৎকালীন নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে গঠিত হয় মুজিব বাহিনী। মুজিব বাহিনী  গঠন করে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে ৩০ লক্ষ প্রাণ আর ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে আনে।

১৯৪৮-এর ১১ মার্চের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগের যে জয়যাত্রা সূচিত হয়েছিল, ’৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারির মহান ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ’৫৬-এর সংবিধান বিরোধী আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৪-এর সাম্প্রদায়িক-দাঙ্গা প্রতিরোধ আন্দোলন, ’৬৬-এর ৭ জুনে স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের জন্য ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর মহান গণআন্দোলন-গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচন এবং ’৭১-এ মহত্তর মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগ পালন করে অগ্রগামী কাণ্ডারীর ভূমিকা। বিশেষ করে মাতৃভাষার অধিকার, স্বাধিকার, সার্বজনীন ভোটাধিকার ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের একচ্ছত্র নেতৃত্ব ইতিহাস হয়ে আছে। এসব মহিমান্বিত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগ অর্জন করেছিল গণতান্ত্রিক তথা  নিয়মতান্ত্রিক আচরণ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং জয় করে নিয়েছিল বাংলার মানুষের হৃদয় আর সৃষ্টি করেছিল ইতিহাস। সুনির্দিষ্ট আচরণ বিধি, নিয়মানুবর্তিতা, সংগঠনের আদর্শ-উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে নেৃতত্বের প্রতি আনুগত্যের মধ্যদিয়ে ছাত্রলীগ সৃষ্টি করেছিল অসংখ্য বিপ্লবী ও সংস্কৃতবান নেতাকর্মী। অতীতে আমাদের সময়ে কোনো বহিরাগত-অছাত্র ছাত্রলীগের সদস্য হতে পারতো না, নেতৃত্বের পর্যায়ে যাওয়া তো অসম্ভব। ছাত্রলীগের সম্মেলন গঠনতন্ত্র মোতাবেক প্রতি বছর ২১ মার্চের মধ্যে সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা ছিল। তা না হলে তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটির কাছে নেতৃত্ব তুলে দিতে হতো। এটাই ছিল বিধান এবং গঠনতান্ত্রিক বিধি-বিধানের অন্যথা হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। বিধান মোতাবেক ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পরে আমি ছাত্রলীগের সভাপতি এবং আসম আব্দুর রব সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে এক বছর পরে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ২১ মার্চের মধ্যে সম্মেলন করে নূরে আলম সিদ্দিকী এবং শাজাহান সিরাজের কাছে নেতৃত্বের দায়িত্ব অর্পণ করে আমাদের কমিটি বিদায় নেই এবং ২২ মার্চ হল ত্যাগ করি। সমগ্র ’৫০ ও ’৬০-এর দশক জুড়ে ছাত্রলীগ জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে শামিল হয়ে যে রাজনৈতিক আদর্শ ও চেতনা অর্জন করেছিল তা সংরক্ষণ, লালন ও অব্যাহত চর্চা আজ সময়ের দাবী। আজ অতীতের সেই সোনালী দিনগুলোর দিকে যখন ফিরে তাকাই স্মৃতির পাতায় দেখি, সেদিনের ছাত্রলীগ ছিল বাংলার গণমানুষের অধিকার আদায়ের, মুজিবাদর্শ প্রতিষ্ঠার অগ্রবর্তী সংগঠন। আমি ছাত্রলীগের একজন কর্মী ছিলাম বলে গর্ববোধ করি। সংগঠনের কর্মী হিসেবে ছাত্রলীগ আমাকে মুজিবাদর্শ ধারণ করে রাজনীতি করার পথই শুধু উন্মুক্ত করে দেয়নি, সেইসাথে দেশসেবার ও দেশগঠনের মহতী কর্মে আজীবন প্রয়াসী থাকার সুযোগ অবারিত করে দিয়েছে। ছাত্রলীগ করার দরুনই গরীব-দুঃখী-নিরন্ন মানুষের সেবায় নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছি। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের আজ একটি কথাই বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, এ সংগঠনের অতীত গৌরবময়। এর বর্তমানকে করে তুলতে হবে আরও তাৎপর্যপূর্ণ। আর ভবিষ্যতের জন্য নিজেদেরকে গড়ে তুলতে হবে প্রতিশ্রুতিশীল হিসেবে। দুঃখের সাথে বলতে হয়, অতীতে ছাত্র রাজনীতির যে মর্যাদা আমরা পেয়েছি, বর্তমানে সে মর্যাদার অনেকটাই এখন আর নেই। এও এক ষড়যন্ত্রের ফল। ছাত্র সমাজ অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক নির্লোভ ত্যাগী শক্তি বলে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রী মহল তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করার নানা ষড়যন্ত্র করেছে। দু’বারের সামরিক শাসন মাদক, অস্ত্র আর অর্থ ঢেলে ছাত্রসমাজের চরিত্র হননের চেষ্টা করেছে। আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশ ছাত্রলীগসহ অপরাপর সমমনা প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনসমূহ এ কুৎসিত ষড়যন্ত্র থেকে নিজেদের রক্ষা করে ছাত্র আন্দোলনের সুমহান ঐতিহ্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে এগিয়ে যাবে।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, জাতীয় সংসদ

ই- মেইল: [email protected]

LEAVE A REPLY