সাইবার নিরাপত্তার বিষয়ে আগে থেকে জানা না থাকায় রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। তিনি বলেন, যদি এই বিষয়ে আমাদের কোনও ধারণা থাকতো তাহলে হয়তো ওই ঘটনা ঘটতো না। সোমবার বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারে তিনি গ্রামীণ ও অন্তর্ভুক্তিকরণ অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়েও খোলামেলা আলোচনা করেন। বাংলা মটরস্থ বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন সমুন্বয়-এর অফিসে তার সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সাইবার হামলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার চুরি হয়ে যায়।
রিজার্ভ চুরির ওই ঘটনাকে দুর্যোগের সঙ্গে তুলনা করে ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘যে কোনও দুর্যোগ আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরিকে শিক্ষণীয় মনে করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।’ যেসব কারণে ওই সময় রিজার্ভ চুরি ঠেকানো যায়নি, সেসব কারণ যাতে আর না ঘটে সে ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও সর্তকতা ও প্রস্তুতি থাকার পরামর্শ দেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘ওই ঘটনার পেছনে যেসব দুর্বলতা ছিল, সেসব দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হলে আরও নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। রিজার্ভ চুরির ঘটনার সঙ্গে তিনি রানা প্লাজার দুর্ঘটনাকে উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরেন।’
ড. আতিউর বলেন, রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর তৈরি পোশাক খাতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, একইভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা থেকেও নতুন কিছু উদ্যোগ নিতে হবে।
শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকেরই নয়, বেসরকারি ব্যাংকগুলোরও সাইবার নিরাপত্তা দুর্বল থাকায় গত বছরের শুরুর দিকে এটিএম বুথগুলোতে সাইবার হামলা হয়েছিল।
যে কারণে প্রত্যেক ব্যাংকেরই সাইবার নিরাপত্তা আরও জোরদার করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি উল্লেখ করেন, এটিএম বুথগুলোতে সাইবার হামলার ঘটনায় ওই সময় সব ব্যাংককে সাইবার নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।
ড. আতিউর বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একার পক্ষে সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত সম্ভব নয়। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত, অন্যান্য ব্যাংকগুলোকে সঙ্গে নিয়ে সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও সাইবার নিরাপত্তা অভিজ্ঞ ও ভালো ভালো কর্মকর্তা রয়েছে। সেই কমিটি যদি ঠিকঠাক মতো কাজ করে, তাহলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। সাইবার নিরাপত্তার বিষয়ে দ্রুত পরীক্ষা-নিরীক্ষা (ডায়াগনোস্টিক) হওয়া উচিত। কোনও ব্যাংকের সাইবার নিরাপত্তা কতটুকু আছে, বা কতটুকু দুর্বল সেটা বের করা আগে জরুরি। তারপর সেভাবে ব্যবস্থা নিতে পারলে সাইবার হামলা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।’
উল্লেখ্য, রিজার্ভ চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিনি ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
আতিউর রহমানের বর্তমান দিনকাল কেমন কাটছে সাক্ষাৎকারে সে বিষয়টিও উঠে আসে। তিনি জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করার পর থেকে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানো অর্থনীতির ব্রান্ডিং করছেন। বিশেষ করে বাংলাদেশের ‘অন্তর্ভুক্তিকরণ অর্থনীতি’কে তিনি বিশ্বের দরবারে তুলে ধরছেন। এর মধ্যে এরই মধ্যে তিনি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ফোরাম ছাড়াও ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্বব্যাংকের সেমিনার, অস্ট্রেলিয়ায় সিম্পোজিয়াম, সংযুক্ত আরব আমিরাতে গোল টেবিল বৈঠক, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, নয়াদিল্লি, কলকাতা, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানে অনুষ্ঠিত সেমিনারে বক্তব্য দেন তিনি। জাপান, কলকাতা, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রে কয়েকটি সিম্পোজিয়ামেও তিনি বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। এসব কারণে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং ভারতীয় অর্থনীতিবিদদের কাছেও সমাদৃত হয়েছেন।
ড. আতিউর রহমান জানান, চলতি মাসেই ভারতে বিশ্ব ভারতী ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিতব্য রবীন্দ্রনাথের কৃষি ও সমবায় বিষয়ক এক সম্মেলনে যোগ দিতে যাবেন। একই মাসে তিনি কাটস ইন্টারন্যাশনালের একটি সেমিনারেও অতিথি হিসেবে অংশ নেবেন। আগামী মাসে যাবেন তিনি নেদারল্যান্ডে ‘অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি’ শীর্ষক এক সেমিনারে অংশ নিতে। এরপর যাবেন মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরদের এক সম্মেলনে। সেখান থেকে ফিরে আবার ইউএন এস্কেপ সম্মেলনে অংশ নিতে যাবেন ব্যাংককে।
এক প্রশ্নের উত্তরে আতিউর রহমান বলেন, ‘২০০৯ সালে আমি যখন গভর্নর হলাম, তখন বিশ্বব্যাপী আর্ন্তজাতিক আর্থিক মন্দা চলছিল। মানুষের হাতে তখন টাকা না থাকার কারণেই আর্থিক মন্দা দেখা দেয়। তখন মানুষ বাজার থেকে কিছু কেনার জন্য ব্যাংক থেকে কোনও টাকা পাচ্ছিল না। এমন অবস্থায় গভর্নর হয়েই অনুধাবন করলাম, আমাদের দেশের তৈরি করা জিনিসপত্রের চাহিদা অন্যান্য দেশের বাজারে কমে যেতে পারে। এ কারণে দেশের অভ্যন্তরে জিনিসপত্রের চাহিদা বাড়ানো দরকার। তখন ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুসন কর্মসূচি হাতে নিলাম।’
তিনি জানান, ‘অন্তর্ভুক্তিকরণ অর্থনীতির প্রথমেই বেছে নিলাম দেশের কৃষকদের। এছাড়া ছিল ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা। আরেকটা অংশ ছিল সবুজ অর্থনীতি। এই তিন পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুসন এগিয়ে চলতে লাগলো। ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুসনকে কার্যকর করতে মুদ্রানীতিকে কাজে লাগানো হয়। টাকা যাতে গ্রামের মানুষের হাতে সহজে পৌঁছায় সেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ জন্য পেমেন্ট সিস্টেমকে আধুনিক করা হয়। তিনি বলেন, আগে চেক দিলে টাকা জমা হতে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় লাগতো। এখন সেটি কয়েক সেকেন্ডে জমা। যখন পেমেন্ট সিস্টেম আধুনিক হলো, তখনই মোবাইল ব্যাংকিং আইডিয়া মাথায় আসলো। ২০১১ সালে আমরা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের গাইডলাইন করে ফেললাম। এখন প্রতিদিন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন হচ্ছে এক হাজার কোটি টাকারও বেশি। পাশাপাশি শুরু করা হয়, এজেন্ট ব্যাংকিং। যেখানে ব্যাংক কখনই যেতে পারবে না সেখানে এজেন্ট ব্যাংকিং কাজ করবে।’
তিনি বলেন, এখন তার সময় যাচ্ছে লেখালেখি আর বিভিন্ন দেশের সেমিনার, সম্মেলন বা ওয়ার্কশপে অংশ নিয়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পদত্যাগের পর থেকে এ পর্যন্ত ১৭টি আন্তর্জাতিক সেমিনার, সম্মেলন বা ওয়ার্কশপে অংশ নিয়েছেন তিনি।