অসামাজিক ও অসৎ কাজের উদ্দেশেই ফুলবিক্রেতা জিনিয়া (৯) কে অপহরণ করেছিলেন নাজমা আক্তার লুপা তালুকদার (৪২)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) এলাকায় ফুচকা খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে শিশুটিকে তার বাড়িতে নিয়ে যান।
শিশু জিনিয়াই শুধু নয়, অসৎ কাজের জন্য ফুসলিয়ে নিয়ে যাওয়ার এমন অনেক অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
শিশু অপহরণের অভিযোগে গ্রেফতার লুপা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিকের লেবাস লাগিয়ে নানা অসৎ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। ব্ল্যাকমেইল করে টাকা আত্মসাৎ, মাদকসহ নানা ধরনের প্রতারণার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক নেতাসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলতেন। সেগুলো ব্যবহার করে নিজেকে প্রভাবশালী দেখিয়ে নানা অপরাধমূলক কাজ করতেন বলেও জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
ঢাবির টিএসসি এলাকা থেকে ফুলবিক্রেতা জিনিয়া অপহরণের সাতদিন পর গত সোমবার (৭ সেপ্টেম্বর) রাতে নারায়ণগঞ্জ থেকে পথশিশু জিনিয়াকে উদ্ধারসহ লুপাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের রমনা বিভাগ। পরদিন রিমান্ডের আবেদন করে তাকে আদালতে পাঠানো হয়। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দু’দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। শুক্রবার (১১ সেপ্টেম্বর) তার দু’দিনের রিমান্ড শেষ হয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আগে রাজধানীর ‘মোতালেব প্লাজার’ পেছনে একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন লুপা। বছরখানেক আগে ওই বাসা থেকে তার এক ছেলের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এরপর থেকে তিনি পটুয়াখালীতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। লুপার দাবি, তার ছেলে আত্মহত্যা করেছে। বর্তমানে ঢাকায় লুপার কোনো বাসস্থান নেই। তার বর্তমান স্বামী কাতার থেকে ফিরে আসেন। গত ২৮ আগস্ট তার স্বামী ও মেয়ের চিকিৎসা করাতে ঢাকার একটি হোটেলে উঠেন তিনি। সেখানে থেকে বিভিন্ন স্থানে ঘোরাফেরা করেন।
দু’দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে লুপা জানায়, মায়ায় পড়ে সে পথশিশু জিনিয়াকে তার সঙ্গে নিয়ে যায়। নারায়ণগঞ্জে তার মায়ের কাছে এক কাজের মেয়ে থাকে। সেখানে জিনিয়াকে নিয়ে রাখেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা আরও জানায়, পটুয়াখালীর গলাচিপা থানায় লুপা ও তার ভাইসহ পরিবারের ১১ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। গলাচিপায় তার বাসায় শাহিনুর নামে এক নারী কাজ করতেন। তার স্বামী ও ভাই ওই গৃহকর্মীর ওপর নিয়মিত যৌন নিপীড়ন চালাতো। পরবর্তীতে শাহিনুর অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ায় বিষয়টি জানাজানি হয়। এরপর লুপা, তার স্বামী, লুপার বাবা ও দুই ভাই মিলে শাহিনুর ও তার শিশুকন্যাকে অপহরণ করে ট্রলারে তুলে শ্বাসরোধে হত্যার পর বস্তাবন্দি করে নদীতে ফেলে দেন। এ ঘটনায় লুপাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে গলাচিপা থানায় হত্যা মামলা হয়। তদন্তে ঘটনার তথ্যপ্রমাণ ও সত্যতার ভিত্তিতে পুলিশ আদালতে একটি অভিযোগপত্র দাখিল করে। মামলায় সহযোগী কয়েকজন আসামির সাজা হয়। পরে ২০১৩ সালে ওই মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি লুপা ও তার স্বজনরা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আদালত থেকে রেহাই পান।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) এইচ এম আজিমুল হক বাংলানিউজকে বলেন, অপহরণকারী লুপার এমন কাজ খুব সন্দেহজনক। ঢাকায় তার কোনো বাসস্থান নেই। তবে কেন সে পথশিশুকে নারায়ণগঞ্জে নিয়ে গেলেন। এখানে অবশ্যই তার অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে বলে আমরা মনে করছি। পথশিশু অপহরণের এ ঘটনার মূল রহস্য উদঘাটনের জন্য আমরা তদন্ত করছি।
তিনি বলেন, লুপার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপরাধের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। অনেকেই বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। তার এলাকা পটুয়াখালীতে আমরা খোঁজ নিয়েছি। তার বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা ছিল। ২০১৩ সালে সেটি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আদালত থেকে অব্যাহতি পেয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, লুপা নিজেকে আওয়ামী পেশাজীবী লীগের সাধারণ সম্পাদক পরিচয় দিতেন। নাম সর্বস্ব ভুঁইফোড় ‘অগ্নি টিভি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক লুপা অসংখ্য মানুষের কাছে ‘সাংবাদিকতার পরিচয়পত্র’ বিক্রি করেও অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া নিজেকে রাজনৈতিক ও সাংবাদিক পরিচয়ের প্রভার দেখিয়ে অনেক মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। রেলওয়েতে চাকরি দেওয়ার নামে সম্প্রতি পটুয়াখালীর দুই ব্যক্তির কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মিশু বিশ্বাস বলেন, লুপার কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আমরা এখনও পাইনি। তিনি রাজনৈতিক যে সংগঠনের পরিচয় জানান সেটি আসলে নিবন্ধিত কোনো সংগঠন নয়। এছাড়া বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে গ্রেফতার লুপার অনেক ছবি আমরা সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে দেখেছি। সেগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
গত ১ সেপ্টেম্বর টিএসসি সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ফটকে অপরিচিত দু’জন নারীর সঙ্গে ফুচকা খাওয়ার পর থেকে নিখোঁজ ছিল জিনিয়া। ট্রাকচালক স্বামী দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর সাত বছর আগে কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে তিন সন্তানকে নিয়ে টিএসসি এলাকায় আসেন সেনুরা। দুই মেয়ে সিনথিয়া (৭), জিনিয়া (৯) ও ছেলে পলাশকে (১৭) নিয়ে টিএসসি এলাকায় থাকেন তিনি। মায়ের সংসারে জোগান দিতে ফুলবিক্রি করে জিনিয়া ও সিনথিয়া। ভাই পলাশ একটা চায়ের দোকানে কাজ করে।