ভোলা নিউজ২৪ডটনেট।। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা বাংলা আমাদের আত্মার অনুপম প্রেরণা। আমাদের যানা উচিৎ ভাষা কি? এর উদ্দেশ্য কি? যার অর্থ ও উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বজাতির সাথে মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যমই হচ্ছে ভাষা। হতে পাড়ে সেটা ইশারা বা বাক বিনিময়। ভাষার সৃষ্টি হয়েছে প্রাচীন কালে। মানুষ প্রথমে ইশারায় ভাব বিনিময় করতো কালের পরিক্রমায় নানা পথ অতিক্রম করে মানুষ প্রতিকি চিহ্নের মাধ্যমে তাদের ভাষা সৃষ্টি করেছে। একেক দেশের ভাষা একেক রকম আর মহা বিশ্বে রকমারি ভাষায় নানান রঙ আর নানান বর্ন ও গোত্রের জাতির আবির্ভাব হয়েছে যা কিনা ভৌগলিক পরিবেশের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয়েছে। ঠিক বাঙ্গালি জাতিও তাদের ভৌগলিক পরিবেশের জন্যই গঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশি মানুষের জাতি গঠন বা এ অঞ্চলের অধিবাসীদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় কি ? আমি ইতিহাস ও নৃবিজ্ঞান পড়ে যতদূর জেনেছি বাংলাদেশ তথা এ অঞ্চলের অধিবাসীদের বাহ্যিক দৈহিক আকৃতি ও বৈশিষ্ট পর্জযালোচনায় কোন বিশুদ্ধ নরগোষ্ঠীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়না। প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মিশ্রণ ও সমন্বয়ের মাধ্যমে বাঙ্গালি জাতিগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের এদেশের মানুষকে দেখে মনে হয় সে যেন ককেশয়েড আবার অনেককে নিগ্রোয়েড আবার কেউ কেউ যেন মঙ্গলয়েড আবার কাউকে দেখে যেন মনে হয় সে ব্যক্তি অস্ট্রোলয়েড আবার অনেকেই এদের কোনোটার মধ্যেই পড়েনা। এ থেকে বুঝা যায় বাঙ্গালিরা একক কোনো নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী না। ঐতিহাসিক ও গবেষকদের মতে বাঙ্গালিরা হচ্ছে সংকর জাতিগোষ্ঠী। বিভিন্ন ধারার নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে আজকের বাঙ্গালি জাতি। বিজ্ঞানীরা বলেন মানুষের দৈহিক বৈশিষ্ট পরিবর্তনের পিছনে মুখ্য দুটি কারণ রয়েছে যথা জৈবিক ও সামান্য কিছু ভৌগোলিক ভাবে। এদেশের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে প্রাচীন ও নব্যপ্রস্তরযুগীয় এবং তাম্র যুগের নিদর্শন পাওয়া গেছে। এসব যুগে বাংলার পার্বত্য সীমান্ত অঞ্চলে মানুষ বসবাস করতো এবং ক্রমে তারা সমতল ভূমিতে ছড়িয়ে পরে।
বাঙ্গালি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে যে সকল নৃতাত্ত্বি রক্তের ধারা এসে মিশেছে সেগুলো হলো ক) আর্য নরগোষ্ঠী (Aryan): আর্যরা এদেশে বহিরাগত জনগোষ্ঠী তারা বাংলায় আগমন করে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের আগে। আর্যরা দুটি নরগোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল যথা : আলপাইন (Alpine) জনগোষ্ঠী ও নর্ডিক (Nordic) জনগোষ্ঠী। খ) অনার্য জনগোষ্ঠী (Non-Aryan): আর্যদের আগমনের পূর্ব থেকে এদেশে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী অনার্য নামে পরিচিত। প্রাচীনকাল থেকেই এরা বঙ্গ বা বাংলা অঞ্চলে বসবাস করে আসছে।এরাই বাংলার আদি জনগোষ্ঠী এরা চারটি শাখায় বিভক্ত যথা : অস্ট্রিক বা অস্ট্রালয়েড, নেগ্রিটো, দ্রাবিড় ও মঙ্গোলয়েড। এছাড়া কালেকালে ধর্মপ্রচার, ব্যবসাবাণিজ্য ও দেশজয় কিংবা দস্যু সম্রদায়ের লুটতরাজ করতে আসার সুবাদে এদেশে বিভিন্ন রক্তধারার লোকজনের আগমন ঘটে। মধ্য এশিয়া, পারস্য, ও তুরস্ক থেকে আসা শক,তুর্কি, পাঠান, মোগল, ইরানি, আবিসিনীয় এবং আরব জনগোষ্ঠী এদেশে এসে বসবাস করে এবং পরবর্তীতে ইংরেজ পর্তুগিজ এবং ওলন্দাজদের সাথে এতদাঞ্চলের মানুষের রক্তধারা মিশেছে। এভাবে দেখা যায় বাঙ্গালি কোন বিশুদ্ধ নৃগোষ্ঠীগত জাতি নয়। এ জাতি গঠনে নানা ধরনের নরগোষ্ঠীর প্রভাব রয়েছে।
বাঙ্গালি জাতির নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য : বর্তমান বাঙ্গালিদের মধ্যে যে নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলো আছে, তা হল বাঙ্গালিরা আকারে খাটো থেকে মাঝারি হয় , মাথার চুল অধিকাংশেরি কালো কিছু কিছুর বাদামী, চুল সোজা, তরঙ্গায়িত ও কুঞ্চিত, গায়ের রং কালো থেকে হালকা বাদামী, চোখের মণি কালো থেকে হালকা বাদামী, এঁদের চেহারার গড়ন সম্পুর্ণ লম্বাও নয় আবার গোলও নয়, মধ্যম আকৃতির নাক, রক্তের গ্রুপে ও,এ,বি’র প্রাধান্যই বেশি পাওয়া যায়। বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর মেলবন্ধনের ফলে বাঙ্গালি জাতির নিজস্ব বৈশিষ্য দাঁড় করানো যায়না। অর্থাৎ কোন একক বৈশিষ্ট্য দ্বারা বাঙ্গালি জাতিকে শনাক্ত করা অসম্ভব কারণ একি ব্যক্তির মাঝে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠী’র নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। আমাদের ভাষা খাদ্যভ্যাস আচার আচরণ ও সংস্কৃতির মধ্যে বৈপরিত্য চরিত্র ফুটে উঠেছে।
ভাষা : মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যমই হচ্ছে ভাষা মানুষ তার মনের ভাব অন্যের কাছে বাগযন্ত্রের সাহায্যে অর্থপূর্ণ ধ্বনি ব্যবহার করে প্রকাশ করে তাকেই ভাষা বলে। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ মনের ভাব প্রকাশের জন্য কিছু সাংকেতিক চিত্র বা চিহ্ন ব্যবহার করত যা ছিল অর্থবোধক চিহ্ন আর এ চিহ্ন দিয়ে শব্দগঠন করে বাক্যবিনিময়ের মাধ্যমে বাগযন্ত্রের দ্বারা বাক্য বা শব্দ উচ্চারণের ধ্বনিতে প্রকাশই আমাদের কথাবার্তা ও যার যার ভাষা বলে অবিহিত করা হয়। আর এ ভাষাই হচ্ছে আমাদের বা একটি জাতির সংস্কৃতির একটি বৈশিষ্ট্য। বাঙ্গালি জাতির এ ভাষার ইতিহাস একদিনের নয়। বলা হয়ে থাকে পৃথিবিতে আড়াই হাজারের অধিক ভাষা আছে।
বাঙ্গালি জাতির ভাষা শুরুর ইতিহাস : বর্তমানে পৃথিবিতে প্রায় ৩৫ কোটি মানুষের বেশি বাংলায় কথা বলে (সুত্র বাংলা ভাষার বিবর্তনের ইতিহাস পৃষ্ঠা – ৪৮) বাংলা একটি আধুনিক ভাষা হলেও এটি প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার অন্তর্ভুক্ত। ভাষা গবেষক ড.মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ’র মতে খ্রিস্টপূর্ব প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব ছিল। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার বিভিন্ন বিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগে ইউরোপের মধ্যভাগ থেকে দক্ষিণ পূর্বাংশে প্রচলিত ভাষার নাম ছিল ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষা। আর এ ভাষাগোষ্ঠী কেস্তম ও শতম নামে দু’ভাগে বিভক্ত ছিল। শতম গোষ্ঠী দক্ষিণ-পূর্বে এশিয়া মাইনরের দিকে এসে বিভিন্ন ভাষার সৃষ্টি করে। তার মধ্যে একটি আর্য ভাষাগষ্ঠী একটি। আনুমানিক ২৫০০ খৃস্টপূর্বে আর্যভাষাগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। আর এ ভাষাগোষ্ঠীর অনর্ভূক্ত ভাষা হলো ভারতীয় আর্যভাষা। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০-১২০০ অব্দের মধ্যে ভারতীয় আর্যভাষার জন্ম হয় যা ৩টি ভাগ লক্ষ্যণীয় যথা ক) প্রাচীন ভারতিয় আর্যভাষা -জন্মকাল খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০-১২০০ অব্দ একে বৈদিক ভাষাও বলে। সংস্কৃত ভাষাও একটি প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা।
খ) মধ্য ভারতীয় আর্যভাষা জন্মকাল খ্রিস্টপূর্ব ৬০০-১০০০ খ্রিস্টাব্দে এ ভাষা বিকশিত হয়, পালি,প্রকৃত ও অপভ্রংশ এ ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। গ) নব্য ভারতীয় আর্যভাষা ১০০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে এ ভাষা গোষ্ঠী বিকাশ লাভ করে। বাংলা হিন্দি মারাঠি অসমিয়া প্রভৃতি নব্য ভারতীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। তবে ভাষার উৎপত্তি নিয়ে ড.মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ মনে করেন গোড়ীয় অপভ্রংশ থেকে বাংলা ভাষার জন্ম হয়।
বাংলা ভাষা উদ্ভবের পর এটি একটি ধারায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। বিভিন্নভাবে এই ভাষা বিকশিত হয়। বাংলা ভাষার বিকাশ ও ক্রমবিবর্তনকে আবার তিনভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যথা প্রাচীন যুগ ( ৬৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ) মধ্যযুগ (১২০১-১৮০০ খ্রিস্টাব্দ) মধ্যযুগ আবার দু’ভাগে বিভক্ত যথা ( আদি মধ্যযুগ ও অন্ত মধ্য যুগ) আধুনিক যুগ (১৮০১-বর্তমানকাল পর্যন্ত বিস্তৃত)
এভাবে দেখা যায় কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী দ্বারা বাংলা ভাষায় আরবি ফার্সি ইংরেজি ও উর্দুর মিশ্রণ ঘটে। বর্তমানে বাংলা আমাদের রাষ্ট্র ভাষা বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত এবং বিভিন্ন দেশের বাঙ্গালিরা এই ভাষায় কথা বলে।বাংলা ভাষাকে এই পর্যায়ে নিয়ে আসতে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করতে হয়েছে। মহাভারতের যুগে বাংলাকে অস্পৃশ্য ভাষা হিসেবে গণ্য করা হতো। বলা হতো যারা বাংলা ভাষায় কথা বলবে তারা রৌরব নামক নরকে শাস্তিভোগ করবে।মধ্যযুগেও উত্তর ভারতের শাসকবৃন্দ বাংলা ভাষাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন। তবে বাংলাভাষা’র উপর সবচেয়ে বড় আঘাত আসে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরপরই পাকিস্তানিরা সংখ্যাগোষ্ঠী বাঙ্গালিদের রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে ধ্বংস করার মানসে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে উর্দু কে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বাংলার জনগণ ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়ে মায়ের ভাষা বাংলার অস্তিত্ব ও মর্যাদা রক্ষা করতে সক্ষম হয়। এমন কি পরবর্তীতে আরবি ও রোমান হরফে বাংলা ভাষার ব্যবহার ও বাংলা ভাষাকে পরিবর্তনের বিভিন্ন প্রয়াসও বাংলার জনগণ রুখে দিতে সক্ষম হয়। (সূত্র – বাংলা ভাষার ইতিহাস ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস)
…..লেখক সাংবাদিক সোহেব চৌধুরী।।