ভোলা নিউজ২৪ডটকম।।কিছু সুবিধাবাদী লোক রাজনীতিকে পেশা বানিয়ে ফেলেছে মন্তব্য করে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, আজ আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করছি। কিন্তু রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন কতটুকু হয়েছে, তা ভেবে দেখতে হবে।
বুধবার (১৭ মার্চ) বিকেলে মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন রাষ্ট্রপতি।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, আজ আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করছি।
এ সময়ে রাজনীতিতে অনেক চড়াই-উৎরাই ঘটেছে। কিন্তু রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন কতটুকু হয়েছে, তা ভেবে দেখতে হবে।
‘ব্যক্তির চেয়ে দল, দলের চেয়ে দেশ বড়- এটাই হচ্ছে রাজনীতির মূল আদর্শ। কিন্তু আজকাল যেন রাজনীতি উল্টো পথে হাঁটছে।
কিছু সুবিধাবাদী লোক রাজনীতিকে পেশা বানিয়ে ফেলেছেন। ’
রাষ্ট্রপতি বলেন, রাজনীতি আর পেশা এক জিনিস নয়। পেশার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি নিজের ও পরিবার-পরিজনের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন। আর রাজনীতি হচ্ছে দেশ ও জনগণের কল্যাণে কাজ করার একটি মহান ক্ষেত্র।
‘তাই রাজনীতিকে পেশা মনে করলে দেশ ও জনগণের কথা ভুলে নিজের ও পরিবারের গণ্ডির মধ্যেই ঘুরপাক খেতে হবে। ’
রাজনীতিবিদদের দেশ ও জনগণের সেবায় নিয়োজিত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ১০১তম জন্মবার্ষিকীর এই দিনে তাই আমি রাজনীতিবিদদের আহ্বান জানাবো, আসুন বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ ও কর্ম থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের দেশ ও জনগণের সেবায় নিয়োজিত করি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামী জীবন ও ত্যাগের কথা তুলে ধরে আবদুল হামিদ বলেন, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বা ভোগ-বিলাস কোনো কিছুই তাকে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু চাইলেই বিত্ত-বৈভবে নিজেকে উজাড় করে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি অবলীলায় এসব প্রত্যাখ্যান করে দেশ ও জনগণের অর্থাৎ বাঙালি ও বাংলাদেশের স্বার্থকেই জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, পাকিস্তান জেলে থাকাকালীন ১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর সকাল ৮টায় বঙ্গবন্ধুকে স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো ও জেনারেল আকবরের সামনে হাজির করা হয়। ইয়াহিয়ার ধারণা ছিল বঙ্গবন্ধু তার কাছে এসে প্রাণের ভয়ে নরম হয়ে যাবেন এবং সেই সুযোগে তার কাছ থেকে আপসের প্রস্তাব পাওয়া যাবে। তিনি এই মানসে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন বঙ্গবন্ধুর দিকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘দুঃখিত, ও হাতে বাঙালির রক্ত লেগে আছে, ও হাত আমি স্পর্শ করতে পারব না। ’ মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে একমাত্র একজন মহানায়কই এমন সাহসী উক্তি উচ্চারণ করতে পারেন। নিজের দেশকে ও নিজের মানুষদের ব্যক্তি ও পরিবারের চেয়ে বেশি ভালোবাসলেই মৃত্যুকে জয় করে স্বাধীনতা ও মুক্তির গান গাওয়া যায়।
বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাসের মহানায়ক উল্লেখ করে আবদুল হামিদ বলেন, পৃথিবী আলোকিত করার জন্য প্রকৃতির নিয়মে পূবাকাশে সূর্য উঠেছিল ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। সেদিন বাঙালি জাতির জন্য সোনালি আভা নিয়ে আরেকটি সূর্য উঠেছিল গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়, সে সূর্যের নাম শেখ মুজিবুর রহমান। যে সূর্যের উজ্জ্বল ও প্রখর রোদ এসে বাঙালি জাতিকে উপহার দিয়েছিল একটি জাতিরাষ্ট্র, লাল-সবুজের একটি পতাকা ও একটি জাতীয় সংগীত। সাথে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার ঠাঁই করে দিয়েছিল বাঙালিকে, এনে দিয়েছিল আত্মপরিচয়ের নতুন ঠিকানা- বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের মহানায়ক।
‘আমাদের স্বাধীনতার স্থপতি ও রূপকার। ইতিহাসের স্বর্ণ শিখরে পৌঁছাতে বঙ্গবন্ধুকে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, অত্যাচার-নির্যাতন ও জেল-জুলুমের শিকার হতে হয়েছে। কোনো জাদুমন্ত্র বা মুরুব্বির ছোঁয়ায় তিনি ইতিহাসে স্থান পাননি। স্কুলজীবন থেকেই তিনি মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন, নিজের বই-খাতা, জামা কাপড়, ছাতা বিলিয়ে দিয়ে শুরু করেছেন আর নিজের জীবন দিয়ে এর পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন। ’
সঠিক ইতিহাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধুর অপরিসীম ত্যাগ ও অসীম সাহসিকতার কথা সুবিদিত হয়ে থাকবে। জাতির পিতার আহ্বানে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তার সহকর্মী ছিলেন, তাকে সরাসরি দেখা ও জানার সুযোগ পেয়েছেন, তারা অধিকাংশই আজ বেঁচে নেই। যারা জীবিত আছেন সকলেই আজ জীবন সায়াহ্নে। তাই শতবার্ষিকী উপলক্ষে গৃহীত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতার অমূল্য স্মৃতি ও স্মারক সংরক্ষণ করতে হবে। যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম বাঙালি জাতির গৌরব এবং পূর্বসূরীদের অসীম সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের অনন্য গাথা জানতে পারে এবং সেই আলোকে নিজেদের আলোকিত করতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ।
অতিথির বক্তব্য অংশে প্রচার করা হয় চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইউশিহিদে সুগা, খ্যাতিমান সাংবাদিক মার্ক টালির ধারণকৃত ভিডিও বার্তা।
মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ, চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইউশিহিদে সুগার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, বক্তব্যে তাঁরা বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁদের নিজ নিজ দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও উন্নয়ন অংশীদারত্বের কথা তুলে ধরেছেন। তাঁদের এসব বার্তা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জন্মশতবার্ষিকীর আনন্দকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। আমি আশা করি, এখন থেকে এসব উন্নয়ন সহযোগী বন্ধু দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ ও সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ ও সুদৃঢ় হবে।
স্বাগত বক্তব্য রাখেন মুজিববর্ষ উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন, মালদ্বীপের ফাস্টলেডি ফাজনা আহমেদ, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের স্ত্রী রাশিদা খানম, বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানাসহ মন্ত্রী পরিষদ সদস্য, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, দেশি-বিদেশি আমন্ত্রিত অতিথি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থা প্রধান, সামরিক ও বেসামরিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
বিকেল সাড়ে ৪টায় রাজধানীর প্যারেড স্কয়ারে ‘ভেঙেছ দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়’ শীর্ষক থিমে শুরু হয় ১০দিনব্যাপী কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠান।
শিশুশিল্পীদের সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত এবং এর পরপরই শত শিশুশিল্পীর সংগীত পরিবেশনার মাধ্যমে উদ্বোধন অনুষ্ঠান শুরু হয়।
মুজিববর্ষের থিম সং-এর মিউজিক ভিডিও পরিবেশনার পর বিমানবাহিনী কর্তৃক ফ্লাই পাস্টের রেকর্ডকৃত ভিডিও প্রচার করা হয়।
আলোচনা পর্বের পর শুরু হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পর্বে ‘ভেঙেছ দুয়ার এসেছো জ্যোতির্ময়’ থিমের উপর ভিত্তি করে নির্মিত অডিও-ভিজ্যুয়ালে তুলে ধরা হবে জাতির পিতার সংগ্রামী জীবনের নানা অধ্যায়।
উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্র সহযোগে অর্কেস্ট্রা মিউজিকের সঙ্গে গান পরিবেশন, বঙ্গবন্ধুকে প্রতীকী চিঠি উৎসর্গ, ‘মুজিব শতবর্ষের কার্যক্রম ফিরে দেখা’ শীর্ষক ভিডিও প্রদর্শন করা হবে।
এছাড়াও বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করে বন্ধু রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় প্রথম দিনে আজকের আয়োজনে থাকছে ভারতের প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী মমতা শঙ্করের নেতৃত্বে একটি বিশেষ পরিবেশনা।
বর্ণিল আতশবাজি ও লেজার শোর মাধ্যমে শেষ হবে প্রথম দিনের জমকালো আয়োজন।
বিকেল সাড়ে ৪টায় শুরু হওয়া এ অনুষ্ঠান শেষ হবে রাত ৮টায়।
বর্ণাঢ্য আয়োজনের এই উদ্বোধন অনুষ্ঠান সব টেলিভিশন ও বেতার চ্যানেল, অনলাইন মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে।
১৭ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত ‘মুজিব চিরন্তন’ প্রতিপাদ্যে প্রতিদিন পৃথক থিমভিত্তিক আলোচনা অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, অডিওভিজ্যুয়াল এবং অন্যান্য বিশেষ পরিবেশনার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে।