ভোলা নিউজ২৪ডটকম।। কোভিড-১৯ মহামারির ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আগামী দিনে কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব প্রশমন এবং পুননির্মাণ পর্বে আরও শক্তিশালী আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জরুরি।
রোববার (০৬ ডিসেম্বর) ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) সই এবং দুই দেশের সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এ আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
ভার্চ্যুয়াল এ অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভুটান প্রান্ত থেকে দেশটির প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং অংশ নেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ক্রমবর্ধমান করোনা মহামারি স্বাস্থ্য সংকটের পাশাপাশি সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং জীবন-জীবিকার ওপর হুমকিতে পরিণত হয়েছে।
এই অজানা শত্রুর প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ, ভুটানসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে দুর্দান্ত সহযোগিতা বিনিময় করছে।
তিনি বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে।
সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় আমাদের অবশ্যই নতুন বাস্তবতা বিবেচনা করতে হবে। সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সম্প্রদায় কোভিড-১৯ মহামারির নতুন ও গভীর মহামারি মোকাবিলা করছে।
ঐতিহাসিক মুহূর্তে বাংলাদেশ ও ভুটান অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) সই করছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম কোনো দেশের সঙ্গে পিটিএ চুক্তি করছে। তাও এটি বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া প্রথম দেশ ভুটানের সঙ্গে।
পিটিএ চুক্তি বাংলাদেশ ও ভুটানের সম্পর্ক বৃদ্ধির পাশাপাশি দুই দেশের অগ্রগতিতে অবদান রাখবে বলে আশা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশ ভুটানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপন করছে। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভুটান বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দেয়। ঐতিহাসিক এ দিনে এই চুক্তি সই হয়।
ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার সেই মুহূর্তের কথা স্মৃতিচারণ করে শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭১ সালের এই সময়টাতে আমার বাবা বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী, কামাল-জামাল পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। আমরা পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে বন্দী। সেই অবস্থায় আমরা যখন এই সংবাদ পেয়েছি আমরা আবেগে আপ্লুত হয়েছি, আনন্দে কেঁদেছি, উচ্ছ্বসিত হয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভুটান সব বাংলাদেশির হৃদয়ে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা এবং স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ভুটানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা।
প্রাচীনকাল থেকে দুই দেশের সম্পর্কের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রাচীনকাল থেকে ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের একই সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, ঐতিহ্য এবং জিও-পলিটিক্যাল সম্পর্ক রয়েছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে বাণিজ্য, পর্যটন, জলবিদ্যুৎ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, স্বাস্থ্য, জীব-বৈচিত্র্য, কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, তথ্য প্রযুক্তি, শিক্ষা, পানি সম্পদ ব্যবস্থাপণাসহ বিভিন্ন সেক্টরে দুই দেশের সহযোগিতার ক্ষেত্র রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুই দেশের অসাধারণ সুসম্পর্ককে আরও অর্থবহ এবং পারস্পরিক লাভ ও উন্নয়নে কাজে লাগানোর এখনই সময়। সেই চেতনা থেকেই দু্ই দেশের মধ্যে এই পিটিএ চুক্তি সই হয়েছে।
‘বাংলাদেশ ভুটান থেকে তাজা ফল আনতে পারে। ভুটানের ফ্যাশন সচেতন জনগণ বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় গুণগত মানের পোশাক নিতে পারে। বাংলাদেশ ভুটান হতে বোল্ডার পাথর আনতে পারে। বাংলাদেশি ওষুধ ভুটানের স্বাস্থ্য সেক্টরে অবদান রাখতে পারে। ’
ভুটানের চতুর্থ রাজা জিগমে সিংগে ওয়াংচুক-এর ‘গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস’ সারা বিশ্বে প্রশংসিত হওয়ার কথা উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলার গড়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্য গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং নাগরিকদের সুখী করা।
এ প্রসেঙ্গ তিনি সরকারের ‘ভিশন ২০২১’ এবং ‘ভিশন ২০৪১’ এর কথা উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ, আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী এবং আমাদের অর্থনীতি সামনে এগিয়ে চলছে। আইনের শাসন, মানবাধিকার সু-প্রতিষ্ঠিত। যেকোনো ধরনের সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোরভাবে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করি।
জ্বালানি নিরাপত্তা, শিক্ষা, দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, আর্ত-সামাজিকসহ বিভিন্ন সেক্টরে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতির কথা তুলে ধরেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ও ভুটান পরস্পরকে সহযোগিতা করার বহু ক্ষেত্র আছে। বাংলাদেশ পারস্পরিক সহযোগিতা করতে সব সময় প্রস্তুত।
ভুটান তাদের প্রয়োজনে চট্টগ্রাম, মোংলা, পায়রা সমুদ্র বন্দর, নারায়ণগঞ্জের পানগাও বন্দরসহ বাংলাদেশের জলপথ ব্যবহার করতে পারে, জানান শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশ চিলাহাটি রেলপথ চালু করছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এটি ভুটানের জন্য আরেকটি সুযোগ হতে পারে।
বাংলাদেশ-ভুটান কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে কেক কাটেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশ-ভুটানের মধ্যে এই চুক্তি সইয়ের ফলে বাংলাদেশের ১০০টি পণ্য ভুটানে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে। আর ভুটানের ৩৪টি পণ্য বাংলাদেশে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা পাবে। পরবর্তী সময়ে আলোচনার মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে পণ্য সংখ্যা বাড়ানো হবে।
বাংলাদেশ-ভুটানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ধীরে ধীরে বাড়ছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ২৬ দশমিক ৫২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা থেকে বেড়ে ৫৭ দশমিক ৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়।
ভুটানে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক, খাদ্যসামগ্রী, প্লাস্টিক, ওষুধ, গৃহসজ্জাসামগ্রী, ইলেকট্রিক্যাল সামগ্রী রপ্তানি করে থাকে। আর ভুটান থেকে বোল্ডার পাথর, সবজি-ফলমূল, নির্মাণসামগ্রী, ক্যামিক্যালস ইত্যাদি পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ।
১৯৭১ সালে ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রথম স্বীকৃতি দেয় ভুটান। ঐতিহাসিক দিনটি সামনে রেখে ৬ ডিসেম্বর চুক্তি সই হয়।
চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন- পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, ভুটানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. টান্ডি দর্জি, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান, এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিমসহ দুই দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী এবং সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দীন।