ভোলা নিউজ ২৪ ডটনেট :কারাগারে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত দুর্ধর্ষ খুনি দীপক দত্ত ওরফে ভোলার বসবাস কর্ণফুলী ভবনের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে। আরেক ভয়ঙ্কর খুনি শামীম উদ্দিনের বসবাস পাশের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে। সেও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত। ভয়ঙ্কর এ দুই কয়েদি দীর্ঘদিন সেলে বন্দি ছিল। তবে রহস্যজনক কারণে প্রায় দেড় বছর ধরে তারা সাধারণ ওয়ার্ডে। সেল থেকে সাধারণ ওয়ার্ডে যাওয়ার পর দুই ওয়ার্ডের রাজা হয়ে উঠেছে তারা।
ভোলা ও শামীম ঠিক করে কোন বন্দি কতটুকু জায়গায় ঘুমাবে, কে কতটুকু খাবার পাবে। গোসল করার জন্য পানি বরাদ্দও নির্ধারণ করে দেয় তারা। তাদের কথায়ই এখানে চূড়ান্ত। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, এ দুই ওয়ার্ডে চলছে ভোলা ও শামীমের শাসন।
গুঞ্জন আছে, চট্টগ্রাম কারা বিভাগের এক শীর্ষ কর্মকর্তার আশীর্বাদ থাকায় এসব অপকর্ম চালিয়ে আসছে তারা। তাই কেউ এ নিয়ে মুখ খুলতে সাহস করেন না। চট্টগ্রাম আদালতে দুই খুনির প্রথমে মৃত্যুদণ্ড হলেও উচ্চ আদালতে আপিলে তাদের যাবজ্জীবন হয়।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ভোলা ও শামীম দুটি ওয়ার্ডে বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বলে সম্প্রতি কিছু অভিযোগ এসেছে। সেগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সত্যতা পেলে তাদের বিরুদ্ধে কারাবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারাগারের ভেতরে কারও অন্যায় করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রাম কারাগারে ঝামেলা করায় এর আগে একাধিকবার তাদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে কুমিল্লা কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। কারাগারে তাদের রেকর্ড ভালো নয়।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্পেশাল পিপি অ্যাডভোকেট মেজবাহ উদ্দিন বলেন, কারাগারে সাধারণত দুর্ধর্ষ বন্দিদের সেলে বন্দি রাখা হয়। নিরাপত্তার কারণে তাদের কখনোই সাধারণ ওয়ার্ডে রাখা হয় না। এই প্রথা বহুদিনের পুরনো।
দুই ওয়ার্ডে ২৪ ঘণ্টাই পানি থাকে :চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে সাড়ে পাঁচগুণ বেশি বন্দি থাকায় কার্যত সবসময়ই পানির চরম সংকট লেগে থাকে। ওয়াসা থেকে চাহিদা অনুযায়ী পানি সরবরাহ করা হয় না। দুটি পাম্প দিয়ে কোনোরকমে পানি সংকট সামাল দিচ্ছে কারা প্রশাসন। দুর্ধর্ষ এ দুই কয়েদির খুঁটির জোর এতই শক্ত যে, তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন দুটি ওয়ার্ডে ২৪ ঘণ্টাই পানি থাকে। পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে পাম্প অপারেটর কারারক্ষী মো. সুমনের সহযোগিতায় এখানে এক ইঞ্চি প্লাস্টিকের পাইপ বসানো হয়েছে। উপ-কারা মহাপরিদর্শক কার্যালয়ের পাম্প থেকেই দুটি ওয়ার্ডে এ অবৈধ লাইনটি সরবরাহ করা হয়েছে। তবে চাহিদা অনুযায়ী পানি, খাবার ও থাকার সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে দুটি ওয়ার্ডে বসবাস করা সাধারণ বন্দিদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে ভোলা ও শামীম।
জামিনে মুক্তি পাওয়া নগরীর চকবাজারের ব্যবসায়ী সিরাজ উদ্দিন বলেন, চেক ডিজঅনারের একটি মামলায় প্রায় দুই মাস কারাগারে বন্দি ছিলাম। কর্ণফুলী ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে যাওয়ার পর ভোলা জানায়, মাসে ১২ হাজার টাকা দিলে এখানে চাহিদা অনুযায়ী পানি, থাকা ও খাবার সুবিধাসহ আরাম-আয়েশে থাকার সুযোগ পাবেন। প্রতি মাসে ১২ হাজার টাকা দিয়ে দুই মাস আরাম-আয়েশেই ছিলেন সেখানে। তবে যারা ভোলার চাহিদা অনুযায়ী অর্থ দিতে পারেন না, তাদের ওপর সে অমানবিক অত্যাচার চালায়। মাদক মামলার এক আসামি সিদ্দিক উল্ল্যাহ গত ১৫ অক্টোবর আদালতে হাজিরা দিতে আসেন। আদালতে এ প্রতিবেদককে তিনি জানান, ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিতে না পারায় শামীম তার ওপর নির্যাতন চালায়। পরে কারাগারের এক সুবেদারের হাতেপায়ে ধরে এ ওয়ার্ড থেকে পদ্মা ভবনে চলে গেছেন তিনি। সিদ্দিক বলেন, তাদের চাহিদা যারা পূরণ করতে পারেন না, তাদের ‘ইলিশ ফাইল’ করে ঘুমাতে দেওয়া হয়। নড়াচড়া পর্যন্ত করতে দেয় না। দুপুর ও রাতে খাবারের সঙ্গে মাছ ও মাংস না দিয়ে শুধু ডাল ও সবজি দিয়েই ভাত খেতে বাধ্য করে। আরও বেশ কয়েকজন বন্দিও ভোলা ও শামীমের বর্বরতার চিত্র তুলে ধরেন।
অবৈধ অর্থ লেনদেনে ‘পিসি’:কোনো বন্দি কারাগারে গেলে কারাগারের ক্যান্টিন থেকে উন্নতমানের খাবার, সাবানসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে একটি করে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। এটা পিসি নামে পরিচিত। এই পিসিতে বন্দিদের স্বজনরা অর্থ জমা করেন। সেই অর্থ থেকে কারাবন্দি আসামিরা কারা ক্যান্টিনে পণ্য কিনতে পারেন। ভোলা ও শামীম বন্দিদের পিসির অর্থ অন্য পিসিতে স্থানান্তর করে নিচ্ছে।
বিশৃঙ্খলা ও অপকর্মের হোতা :চট্টগ্রাম কারাগার থেকে মোবাইল ব্যবহার ও বাইরের মানুষকে হুমকির অভিযোগে কারাবিধি অনুযায়ী একাধিকবার শাস্তিও পেয়েছে দুর্ধর্ষ খুনি ভোলা ও শামীম। কারাগারে বিশৃঙ্খলার কারণে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে সাবেক জেলার মাহবুবুর রহমান তাদের দুই দফায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে চট্টগ্রাম কারাগার থেকে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠান। তিনি বদলি হয়ে যাওয়ার পর কুমিল্লা থেকে ফের তারা চট্টগ্রাম কারাগারে ফিরে আসে। ২০১৪ সালের জুনে ভোলাসহ ৯ দুর্ধর্ষ বন্দির সেলে অভিযান চালিয়ে মোবাইল ফোন উদ্ধার করেন তৎকালীন চট্টগ্রাম সিনিয়র জেল সুপার (বর্তমানে ডিআইজি) মো. ছগির মিয়া। মোবাইল ফোন উদ্ধারের ঘটনায় কারাবিধি ও পেনাল কোড অনুযায়ী কয়েদি ভোলাকে ৩০ দিন ডা াবেড়ি ও শামীমকে ৪৫ দিন ডাণ্ডাবেড়ি পরে থাকার শাস্তিও দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া ২০১৩ সালের ১২ অক্টোবর চট্টগ্রাম আদালতের হাজতখানায় মোবাইল ফোন ব্যবহারের সুযোগ না পাওয়ায় পুলিশ কনস্টেবল মাহবুবকে মারধর করে ভোলা। তাদের এসব অপকর্মে অতিষ্ঠ কারা কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম কোর্ট পুলিশের এসআই মোশাররফ হোসেন বলেন, কারাগার থেকে ভোলা ও শামীম আদালতে হাজিরা দিতে এলে নানা ছুতায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। তারা যেদিন হাজিরা দিতে আসে সেদিন খুব টেনশনে থাকতে হয় পুলিশকে।