ভোলা নিউজ২৪ডটকম।। আলোচিত জেকেজি হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান চিকিৎসক সাবরিনা আরিফ চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত আজ সোমবার দুপুরের দিকে এই রিমান্ডের আদেশ দেন।সিএমএম আদালতের হাজতখানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসআই শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, সাবরিনাকে আদালতে হাজির করে ৪ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানায় পুলিশ। শুনানি শেষে আদালত তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদে ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।করোনার নমুনা পরীক্ষার জালিয়াতির অভিযোগে সাবরিনাকে গতকাল রোববার গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার, সংক্ষেপে জেকেজি কাজ শুরু করেছিল ২০১৫ সালে। ওই বছরই চিকিৎসক সাবরিনা শারমিন হুসেইনকে বিয়ের পর ব্যবসায়ী আরিফুল হক চৌধুরী তাঁর দাদির নামে এই ‘অলাভজনক’ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছিলেন।
ওভাল গ্রুপ লিমিটেডের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান জেকেজি। এটি একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্ম। প্রতিষ্ঠানের প্রধান আরিফুল হক চৌধুরী হলেও চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচয় দিতেন সাবরিনা। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দিবসের কাজ পেয়ে আসছিল ওভাল। এমনকি গত অক্টোবরে ঢাকা এক্সপোর আয়োজন উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনেও ওভালের চেয়ারম্যান হিসেবে বক্তব্য দেন সাবরিনা।
জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত দুজন মিলেই জেকেজি চালাচ্ছিলেন। কিন্তু দাম্পত্য কলহের জেরে সাবরিনা শারমিন হুসেইন ওরফে সাবরিনা আরিফ চৌধুরীর জেকেজি থেকে সরে আসেন। ওই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পুলিশ জেকেজিতে অভিযান চালায়।
জানা যায়, বিনা মূল্যে পরীক্ষার অনুমতি নিয়ে জাল-জালিয়াতি করছিল জেকেজি। গ্রেপ্তার হন আরিফুল হক চৌধুরীসহ প্রতিষ্ঠানের আরও চারজন কর্মকর্তা-কর্মচারী। তখন থেকেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান সাবরিনা আরিফ চৌধুরী কেন ধরাছোঁয়ার বাইরে?
আর সেই সময় সাবরিনাও পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানান, তিনি সরকারি কাজের অবসরে প্রতিষ্ঠানটিতে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছেন।
ফলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, এই জালিয়াতির দায় আসলে কার?
ডিএমপির উপকমিশনার হারুন অর রশিদ জানিয়েছেন, এর আগে করোনাভাইরাস পরীক্ষার নামে জালিয়াতির অভিযোগে জেকেজির যেসব সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছেন তাঁরা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, সাবরিনাই এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। কাজেই প্রতিষ্ঠানের জাল জালিয়াতির দায় তিনি এড়াতে পারেন না।
প্রায় একই ভাষ্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। এক বিজ্ঞপ্তিতে মন্ত্রণালয় জানায়, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক সাবরিনা আরিফ চৌধুরীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সরকারি চাকরি করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকা এবং অর্থ আত্মসাতের মতো শাস্তিযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাঁকে সাময়িক বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেয়।
জেকেজি হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান চিকিৎসক সাবরিনা আরিফ চৌধুরীর ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)। ব্যাংক হিসাব জব্দ করার তালিকায় সাবরিনার স্বামী জেকেজির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুল হক চৌধুরীও আছেন।
এ ঘটনার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা মাহমুদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওভাল গ্রুপের সিইও আরিফুল চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদে জানান, করোনার নমুনা পরীক্ষার জালিয়াতির সঙ্গে আমাদের অফিসের কিছু লোক জড়িত ছিল। যখন আমি এই বিষয়টি জানতে পারি, তখন তাদের আমি টার্মিনেট করেছি। কাকে কাকে টার্মিনেট করেছেন জানতে চাইলে আরিফ বলেন, আমার ওয়াইফ (সাবরিনা আরিফ চৌধুরী), যিনি চেয়ারম্যান ছিলেন, তাঁকে আমি টার্মিনেট করেছি। আমি তখন বললাম, আপনি (আরিফুল) যদি সিইও হন, তাহলে কীভাবে আপনার ওয়াইফকে টার্মিনেট করবেন। সিইও তো চেয়ারম্যানকে টার্মিনেট করতে পারেন না।’
তবে পুলিশ গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয় কেউই সাবরিনার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ তোলেনি। বরং প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেছে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের একটি সূত্র প্রথম আলোকে বলে, জেকেজি কতগুলো নমুনা সংগ্রহ করতে পারবে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তা বেঁধে দেয়নি। ফলে প্রতিদিন অনেক নমুনা তারা পরীক্ষার জন্য পাঠাচ্ছিল। একদিন ৭৮১টি নমুনা পাঠায়। প্রভাবশালীদের আশীর্বাদ থাকায় তারা কেন দ্রুত প্রতিবেদন তৈরি হচ্ছে না, এসব নিয়ে হাঙ্গামাও করত। এ বিষয়ে অধিদপ্তরকে জানানো হয়েছিল।
এই প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক শামসুজ্জামান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে সাবরিনা তাঁকে হোয়াটসঅ্যাপে একটি খুদে বার্তা পাঠান। জানান, তিনি আর জেকেজির সঙ্গে নেই। এই প্রতিষ্ঠানের কোনো কিছুর দায়দায়িত্ব আর তিনি নেবেন না। তবে অধিদপ্তরের নির্দেশ না আসা পর্যন্ত তিনি প্রতিষ্ঠানটির নমুনা পরীক্ষা করে দিয়েছেন।
ওভাল গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত একজন ব্যক্তি নাম না প্রকাশ করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর আরিফুল বলেন, তিনি বিএমডব্লিউ গাড়ি কেনার জন্য টাকা জমিয়েছিলেন। সেই টাকাটা মহামারিতে খরচ করতে চান। অনেকেই তাঁর দিকে তখন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। সাবরিনার চেষ্টায় ৪৪টি বুথ থেকে নমুনা সংগ্রহের কাজ শুরু হয়। এর মধ্যে হঠাৎ করে একদিন আরিফুল জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে গিয়ে সাবরিনাকে মারধর করেন বলে অভিযোগ। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সাবরিনা শেরেবাংলা নগর থানায় গত ৮ জুন স্বামীর নামে একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। তারপর বিবাহবিচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু করেন। বন্ধুবান্ধবকে জানান, তিনি আর জেকেজির সঙ্গে নেই।
করোনার নমুনা সংগ্রহ ও ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগে গত ২৩ জুন জেকেজি হেলথ কেয়ারের কর্মচারী হুমায়ুন কবির ও তাঁর স্ত্রী তানজিনা পাটোয়ারিকে গ্রেপ্তার করে তেজগাঁও থানা-পুলিশ। পরের দিন ২৪ জুন হুমায়ুন কবীর ও তানজিনা ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে হুমায়ুন কবীর জেকেজি হেলথ কেয়ারে চাকরি করার সময় কীভাবে করোনার নমুনা সংগ্রহ এবং ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করেছেন, সে ব্যাপারে সবিস্তারে তুলে ধরেন। হুমায়ুন কবির বলেছেন, আরিফুল চৌধুরীর নির্দেশেই তিনি জেকেজি হেলথ কেয়ারের অফিসে বসে করোনার ভুয়া রিপোর্ট বানাতেন।
তেজগাঁও থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেকেজির অফিস থেকে জব্দ করা করোনার নমুনা পরীক্ষার ফলাফল যে ভুয়া, সেটি আমরা নিশ্চিত হয়েছি। ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপিং সায়েন্স অ্যান্ড হেলথ ইনিশিয়েটিভ (আইদেশি) ল্যাবটি আমাদের জানিয়েছে, জেকেজি যে নমুনার পরীক্ষার ফলাফল দিয়েছিল, এমন কোনো ফলাফল তাঁরা দেননি। জেকেজি জালিয়াতি করে ভুয়া পরীক্ষার ফলাফল দিয়েছে।’
শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, জেকেজি তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।