যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা ও ফিলিপিনো কলা

0
583

ভোলা নিউজ ২৪ ডটনেট:পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে চীনের আকাশসীমায় মার্কিন দূরপাল্লার জঙ্গি বিমানের ছিল নিত্য আনাগোনা। চীনের মতে, সেই বিমানগুলো প্রায়ই চীনের আকাশসীমা লঙ্ঘন করত। যখন চীনের নিরাপত্তা বাহিনীর তা নজরে পড়ত, সরকারি পত্রিকা ‘পিপলস ডেইলি’তে তখন ছাপা হতো চীন সরকারের কঠোর সাবধানবাণী। সেই সাবধান বাণীগুলোর আবার ক্রমিক নম্বর থাকত। যেমন আগের প্রদত্ত ক্রমিক নম্বর যদি ১০৯ হয়ে থাকে, তার পরবর্তী ক্রমিক নম্বর হতো ১১০। যেমন চীন তার আকাশসীমা লঙ্ঘনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে ১১০তম সাবধানবাণী জানিয়ে দিচ্ছে। (জীবনের বালুকাবেলায়; ফারুক চৌধুরী)

‘প্রথমা প্রকাশন’ প্রকাশিত এই বইয়ে ঠিক এই অনুচ্ছেদের পরই ফারুক চৌধুরী লিখেছেন, ‘এ নিয়ে কূটনৈতিক মহলে গল্পগুজব, হাসি-মশকরা চলত। একটি গল্প মনে পড়ে। একজন ইংরেজ অপ্রত্যাশিতভাবে ঘরে ফিরে তার স্ত্রীকে একজন পরপুরুষের সান্নিধ্যে দেখতে পেয়ে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়েই বললেন, মাফ করবেন। আমি কড়া না নেড়েই কামরায় চলে এসেছি। আমি জানতাম না আপনারা আছেন।’

অনুরূপ অবস্থায় একজন ফরাসি ভদ্রলোক ঘরে ফিরলেন। দরজায় কড়া নাড়লেন। ‘ভেতরে এসো।’ তাঁর স্ত্রীর কণ্ঠস্বর। ঘরে ঢুকেই দেখলেন, একজন অচেনা পুরুষের সঙ্গে রয়েছেন তাঁর স্ত্রী। স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘মাফ করো। ড্রয়ারে আমার মানিব্যাগটি ফেলে গিয়েছিলাম। আমি আর বসছি না। তাড়া আছে। গাড়িতে আমার বান্ধবী অপেক্ষা করছেন।’

এবার চীনা ভদ্রলোকের পালা। তিনি কামরায় প্রবেশ করে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর গম্ভীর মুখে তর্জনী সংকেতে উচ্চারণ করলেন তাঁর স্ত্রীর প্রতি সাবধানবাণী, ‘আমি এতদ্দ্বারা তোমাকে আমার ১১০তম ওয়ার্নিং প্রদান করিতেছি।’

২.
চীন আর সেই চীন নেই। বেইজিংয়ের সড়কগুলো এখন প্রকাণ্ড। একসময় যেখানে চলত সারি সারি সাইকেল, সেখানে এখন ঝাঁ চকচকে গাড়ি চলে শাঁ শাঁ বেগে। ‘মেড ইন চায়না’ এখন পরাশক্তি। কোথায় নেই দেড় শ কোটি মানুষের চীন? এশিয়ায় আছে, আফ্রিকায় আছে, ইউরোপে আছে। আছে ল্যাটিন আমেরিকায়, প্রবলভাবে আছে ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রেও। জলে-স্থলে-অন্তরিক্ষে আজ মাও সে তুংয়ের চীনের জয়যাত্রা।

বছর পঞ্চাশ আগেও চীনারা ছিল আকৃতিতে খর্বাকার। আজ চীনে পুষ্টির অভাব নেই। বেড়েছে চীনাদের গড় আয়ু ও গড় উচ্চতা। স্বয়ং চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের উচ্চতা ছয় ফুট থেকে এক ইঞ্চি কম।

৩.
একটা সময় ছিল, কূটনৈতিক সম্পর্ক যা-ই হোক, বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়ে কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করত না চীন। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন সচরাচর যেটা করে থাকে।

কিন্তু সেই দিন আর নেই। চীন এখন অনেক দেশের ক্ষেত্রেই ছেড়ে কথা বলে না। যেখানে স্বার্থ বিপন্ন হয়েছে, বেইজিং বাণিজ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়া উত্তর কোরিয়াকে ঠেকানোর জন্য ‘থাড’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মোতায়েন করে। এতে ছিল চীনের তীব্র আপত্তি। আপত্তি অগ্রাহ্য করার প্রতিক্রিয়ায় চীন দেশটির ওপর ব্যাপক অবরোধ আরোপ করে।

গত বছর দালাই লামা মঙ্গোলিয়া সফর করেছিলেন। বেইজিং এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে মঙ্গোলিয়ার পণ্যের ওপর শাস্তিমূলক জরিমানা আরোপ করে।

২০১২ সালে জাপানের সঙ্গে সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে বিবাদের জেরে দেশটির ওপর বাণিজ্য অস্ত্র প্রয়োগ করে চীন।

সবচেয়ে আশ্চর্য ঘটনা ঘটে ফিলিপাইনের ক্ষেত্রে। দক্ষিণ চীন সাগরের স্কারবরো বালুচর নিয়ে দেশটির সঙ্গে চীনের ঝামেলা হয়। কীভাবে শায়েস্তা করা যায় ফিলিপিনোদের। অনেক ভেবে কলা অবরোধ আরোপ করে চীন। কলা উৎপাদনে ফিলিপাইন বিশ্বে তৃতীয়। সেই কলার বড় অংশটি আবার রপ্তানি হয় চীনে। চীনারা ফিলিপাইনের কলা নেবে না, খাবে না। হঠাৎ এমন ঘোষণায় সাড়ে সর্বনাশ লাখো ফিলিপিনো কলাচাষির। ২০১২ সালে করা অবরোধ এখনো চলছে। এখন কিছু কিছু আমদানির অনুমতি মিললেও কীটনাশকের অতিরিক্ত উপস্থিতির কথা বলে প্রায়ই টনকে টন ফিলিপিনো কলা ধ্বংস করে চীনা শুল্ক অধিদপ্তর।

৪.
সিকিম সীমান্তে ভুটানের কাছে অবস্থিত বিরোধপূর্ণ দোকলাম মালভূমি নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে এক মাসের বেশি সময় ধরে উত্তেজনা চলছে। দোকলাম উপত্যকাটিকে নিজের বলে দাবি করে চীন ও ভুটান। উত্তেজনার শুরু দোকলাম অঞ্চলের দোলামে চীনের সড়ক নির্মাণের জোগাড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে। সিকিম-ভুটান সীমান্তের এ জায়গাটি চীনে ‘দংলাং’ নামে পরিচিত। নিজ এলাকায় চীনের এ তৎপরতার বিরোধিতা করে ভুটান। এতে সমর্থন দেয় ভারত।

ভুটানের দাবির পক্ষে ভারত সমর্থন জানানোয় নয়াদিল্লির সঙ্গে বেইজিংয়ের উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশ চীন ও ভারতের সেনারা সেখানে মুখোমুখি অবস্থান করছে। গত ১৮ জুন ভারতীয় সেনাবাহিনী বিরোধপূর্ণ ওই স্থানটিতে অবস্থান নিয়েছে। সীমান্ত এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে সাধারণ মানুষ। এখন উভয় পক্ষের মধ্যে চলছে কথার লড়াই।

এই কথার লড়াই শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা বলা শক্ত।

চীন এখনো ভারতের বিরুদ্ধে কোনো অবরোধ আরোপ করেনি। এর একটি কারণ হতে পারে, চীন ভারত থেকে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি করে, রপ্তানি করে এর পাঁচ গুণ। তাই বলে চীন যে কোনো পদক্ষেপ নেবে না, এমনটা জোর দিয়ে বলা যায় না। চীন যদি দক্ষিণ চীন সাগর অবরোধ করে, তাহলেই সংকটে পড়ে যাবে ভারত। কারণ, এটি ভারতের অন্যতম বাণিজ্য পথ।

মনে রাখা দরকার, চীন-ভারতের মধ্যে যেকোনো ধরনের যুদ্ধ পরিস্থিতির বলি হবে এই অঞ্চলের সাড়ে তিন শ কোটি মানুষ।

যদি আমরা একটু ব্যাখ্যা করি:
প্রথমত, চীন-ভারত সংঘাতের সুযোগ নিতে চাইতে পারে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো। এ রকম হলে পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভারত তার সীমান্তবর্তী অন্য প্রতিবেশীদের সহায়তা চাইবে। চীনের সঙ্গেও এই দেশগুলোর সম্পর্ক মন্দ নয়। তেমন অবস্থায় নতুন এক পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

দ্বিতীয়ত, কাশ্মীর ইস্যু। চীন এরই মধ্যে বলেছে, ভারত যদি তৃতীয় পক্ষ হয়ে ভুটানে এগিয়ে আসতে পারে, তাহলে তারাও পাকিস্তানের হয়ে কাশ্মীরে অবস্থান করবে। তখন পাকিস্তানও হয়তো বসে থাকবে না। অস্থির এ অঞ্চলে জোরদার হয়ে উঠতে পারে বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ড, যা হবে অনাকাঙ্ক্ষিত।

তৃতীয়ত, চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলিমদের মধ্যেও বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা রয়েছে, যা সেনাবাহিনী দমনে রেখেছে কঠোরভাবে। একইভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে ভিন্নমত। নতুন পরিস্থিতিতে সেখানে অস্থিতিশীলতা বাড়তে পারে।

আরও অনেক কিছু ঘটতে পারে, যা ব্যাখ্যাতীত।

প্রাচীন ভারতীয় প্রবাদ, তির একবার ছুড়লে আর ফিরিয়ে আনা যায় না। বিষয়টি নরেন্দ্র মোদি, সি চিন পিংসহ দুই দেশের কর্তারা মনে রাখলেই সবার মঙ্গল।

LEAVE A REPLY