কাশ্মীরিদের জীবন যেন স্তব্ধ

0
13

ঠিক এক বছর আগে ২০১৯ সালের ৫ই অগাস্ট বাতিল করা হয়েছিল ভারতশাসিত কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা।

পূর্বতন জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য পুরোপুরি মুছে ফেলে একে লাদাখ এবং জম্মু-কাশ্মীর নামে দুটি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে রূপান্তরিত করা হয়েছিল।

এর পর দীর্ঘদিন লকডাউন করে সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যকলাপ যেমন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, তেমনই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল শিক্ষা থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন – সবকিছুই ।

বিশেষ সাংবিধানিক ক্ষমতা সরিয়ে নেওয়ার সময়ে কাশ্মীরের যেসব উন্নয়নের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল, তা কতটা কার্যকর হল? একবছরে কি কোন পরিবর্তন হয়েছে কাশ্মীরের?

অনেকেরই চোখ এড়ায় নি যে বৈঠকে হাজির ১৯ জনের মধ্যে মাত্র একজন ছিলেন কাশ্মীরী মুসলমান ।

সামাজিক মাধ্যমে চর্চা শুরু হয়, কাশ্মীরের ৯৭ শতাংশ মানুষ যেখানে মুসলিম, সেখানকার প্রশাসনের শীর্ষে কেন মাত্র একজন কাশ্মীরি মুসলিম?

অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন ওই ছবিটি দেখে, যে ৩৭০ ধারা বিলোপের পর কি তাহলে কাশ্মীরে কাশ্মীরিরাই ব্রাত্য হয়ে গেলেন!

কাশ্মীরে সর্বত্র চোখে পড়বে সেনা উপস্থিতি

শ্রীনগরের প্রশাসন যদি সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করেই থাকত একবছরে, তাহলে তো ৪ আর ৫ই অগাস্ট বিক্ষোভের ভয়ে কারফিউ জারি করতে হত না।

“বিজেপি তো বলেছিল ৫ তারিখ থেকে ১৫ তারিখ অবধি তারা ধুমধাম করে উদযাপন করবে দিনটা। কিন্তু প্রশাসনই আজ আর আগামীকাল কারফিউ জারি করেছে।”

“তাদের এই সিদ্ধান্তেই তো বোঝা যাচ্ছে যে সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারে নি সরকার। সেটা যদি হত, তাহলে তো আজ রাস্তাঘাট শুনশান থাকত না। বিজেপির সদর দপ্তরে ধুমধাম হত!”

রিয়াজ মাসরুর বলছিলেন, মানুষ যে সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নেয় নি, এটা প্রশাসনও বুঝেছে। কাশ্মীরের বিশেষ ক্ষমতা তুলে নেওয়ার পর থেকে দীর্ঘদিন টেলিফোন, মোবাইল, ইন্টারনেট যেমন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, তেমনই বন্ধ থেকেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ব্যবসা বাণিজ্য।

কাশ্মীরিদের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস ছিল যে পর্যটন, তাও বন্ধ। কাশ্মীরের মানুষ লকডাউন প্রত্যক্ষ করেছেন – গত বছরের ৫ অগাস্ট থেকেই — দেশজুড়ে কোভিড মোকাবিলার জন্য লকডাউনের অনেক আগে থেকেই।

মার্চ মাসে করোনা নিয়ন্ত্রণের লকডাউন শুরুর ঠিক আগেই পুলওয়ামায় গ্রামের বাড়িতে পৌঁছিয়েছিলেন কলকাতার একটি কলেজে পড়াশোনা করেন এমন এক কাশ্মীরি ছাত্র।

নিজের নাম প্রকাশ করতে চাইছিলেন না তিনি।

কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তান বিবাদ চলছে সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে

তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম একবছর পরে কাশ্মীরে কী পরিবর্তন দেখছেন তিনি?

ওই ছাত্রটির কথায়, ভালর দিকে কোনও পরিবর্তন তার চোখেই পড়ছে না। ব্যবসা-বাণিজ্য তো ভীষণভাবে মার খেয়েইছে একবছরে, কিন্তু সবথেকে ক্ষতি বোধহয় হয়েছে ছাত্রছাত্রীদের।

“গত একবছরে খুব বেশি হলে ৭ দিন ঠিক মতো স্কুল কলেজে ক্লাস হয়েছে — তারপরেই তো আবার করোনা মোকাবিলার লকডাউন শুরু হয়ে গেল। এখনও ৩ জি, ৪ জি ইন্টারনেট বন্ধ – শুধু ২ জি চলছে। ছাত্রছাত্রীরা তাই অনলাইন ক্লাসও ঠিক মতো করতে পারছে না।”

“সবার চোখেমুখেই একটা উদ্বেগের ছাপ.. কাল কী হবে, কেউ জানে না.. যে নতুন কাশ্মীরের কথা সরকার বলেছিল, তার তো দেখা পাওয়াই যাচ্ছে না, উল্টে এই একটা বছরের মধ্যে কাশ্মীরকে বহু বছর পিছিয়ে দেওয়া হল” ব্যবসা বাণিজ্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেমন করোনার লকডাউনের জন্য এখন বন্ধ, কিন্তু রাজনৈতিক কর্মকান্ড বন্ধ এক বছর ধরেই।

ওমর আবদুল্লা সহ কয়েকজন নেতাকে মুক্তি দেওয়া হলেও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি সহ বহু নেতা-নেত্রী এখনও গৃহবন্দী।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত কাশ্মীরে এক বছর ধরে পর্যটন, ব্যবসাবাণিজ্য, শিক্ষা – সবই বন্ধ

কাশ্মীরে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, তা গণতন্ত্রের ভাবনারই বিরোধী।গত একবছর ধরে নানা নীতি নেওয়া হয়েছে, তাতে কোনও ধরণের রাজনৈতিক কর্মকান্ডেরই আর জায়গা নেই।

“রাজনীতি তো আর শুধুই ভোটের প্রচার নয়.. কিন্তু যেভাবে নির্দিষ্ট রেখা টেনে দিয়ে বলে দেওয়া হচ্ছে যে এই বিষয়ে কথা বলা যাবে না, ওই বিষয়ে নিয়ে কথা বলা যাবে — এটা গণতন্ত্রের মূলভাবনাটাকেই তো অস্বীকার করা হচ্ছে।”

কাশ্মীরে গত একবছরে কী কী পরিবর্তন হয়েছে, কীভাবে বদলিয়েছে সেখানকার মানুষের জীবন — সে প্রসঙ্গে  আন্তর্জাতিক  কয়েকটি গণমাধ্যমের সাথে কথা বলা পর  জানাযায়, কাশ্মীরের জনগণের মাঝে চাপাক্ষোভ রয়েছে।  অনেকে বলেছেন পরিবর্তন তো হয় তখনই, যখন জীবন চলতে থাকে, কাজকর্ম হতে থাকে।

কিন্তু কাশ্মীরে তো জীবন হঠাৎ করেই গত বছরের ৫ অগাস্ট সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে গেছে… যেন সময় থেমে গেছে সেদিনই।”

 

ভারত-শাসিত কাশ্মীর: ‘স্থানীয়রাই এখন বেশি অস্ত্র তুলে নিচ্ছে’

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ভারতশাসিত কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা বিলোপ করে রাজ্যটিকে কেন্দ্রশাসিত দুটি অঞ্চলে বিভক্ত করার পর দুবছর কেটে গেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যুক্তি দেখিয়েছিলেন- বিশৃঙ্খলা প্রতিহত করতে এটার প্রয়োজন ছিল।

কিন্তু দু’বছর পরেও নিরাপত্তা বাহিনীতে কর্মরত স্থানীয়দের এবং বেসামরিক মানুষকে এখনও সন্দেহভাজন স্বাধীনতাকামীরা লক্ষ্যবস্তু করে হামলা চালাচ্ছে।

“তারা এদের বলছে পুলিশের চর বা পুলিশের সহাযোগী। স্থানীয় এই ব্যক্তিরা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা তাই তাদের টার্গেট,” কাশ্মীরে এবছরের জুলাই মাস পর্যন্ত ১৫ জন নিরাপত্তা কর্মী এবং ১৯ জন বেসামরিক মানুষ  হামলায় প্রাণ হারিয়েছে বলে বিভিন্ন রিপোর্টে জানা যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২০১৯-২০ বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, কাশ্মীরে ১৯৯০-এর দশকে সশস্ত্র কার্যকলাপ শুরু হবার পর থেকে ২০১৯-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১৪,০৫৪ জন বেসামরিক মানুষ এবং ৫,২৯৪ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য প্রাণ কাশ্মীরে সশস্ত্র সরকারি সৈন্যদের সাথে বন্দুকযুদ্ধে প্রায়শই মারা যাচ্ছে বিচ্ছিন্নতাকামীরা

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরে ১৯৮৯ সাল থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দিল্লির বিরুদ্ধে তাদের সহিংস আন্দোলন শুরু করে। পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশি দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের এবং এই ভূখণ্ডকে কেন্দ্র করে দুটি দেশের মধ্যে তিনবার যুদ্ধও হয়েছে।

ভারত কাশ্মীরে অশান্তি উস্কে দেবার জন্য বরাবরই পাকিস্তানকে দায়ী করলেও পাকিস্তান এই অভিযোগ সবসময়ই অস্বীকার করেছে।

কাশ্মীরের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো বলছে, কাশ্মীর উপত্যকায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জঙ্গী পাঠানোর যে অভিযোগ ছিল, সীমান্ত সংঘাত বন্ধে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হওয়ার পর থেকে সেটা কমে গেছে, কিন্তু সহিংসতা থামেনি।

কাশ্মীরিদের জীবন।আন্তর্জাতিক কয়েকটি গণমাধ্যম থেকে ভাষান্তর করে তৈরী করেছেন জীবন আহমেদ

 

 

LEAVE A REPLY