আইওএমের অনুসন্ধান সস্তায় বিকোচ্ছে রোহিঙ্গা শিশু, শ্রম

0
371

রয়টার্স: মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা-নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে দেশটির রাখাইন রাজ্যের লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম। এ দেশে তাদের আশ্রয় হয়েছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে। জাতিসংঘের জরিপ মতে, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বেশির ভাগই শিশু। মিয়ানমারে বেড়ে ওঠা এসব শিশু বাংলাদেশে কেমন আছে তা নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসনবিষয়ক সংস্থা (আইওএম)। তাদের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে এসেও রোহিঙ্গা শিশুরা মোটেও ভালো নেই।

আইওএম জানায়, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে চার লাখ ৫০ হাজার শিশু রয়েছে। এসব শিশুদের অনেকই রাখাইনে শারীরিক নির্যাতন ও ধর্ষণ শিকার হয়েছে। বাংলাদেশে এসেও অভাবের দায়ে আর অনিচ্ছা সত্ত্বেও একই পরিস্থিতির শিকার হতে হচ্ছে তাদের।

রোহিঙ্গা শিশুদের নিয়ে অনুসন্ধানে রয়টার্স জানিয়েছে, কক্সবাজারে সস্তা মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে রোহিঙ্গা শিশুদের শ্রম। অর্থের প্রয়োজনে মেয়েদের বাল্যবিবাহ দিচ্ছেন মা-বাবারা। আবার অনেক রোহিঙ্গা শিশু পড়েছে পাচারকারীদের লোলুপ দৃষ্টিতে।

তবে রয়টার্সের এ অভিযোগ অনেকটা এড়িয়ে গিয়ে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফজুরুল হক টুটুল বলেন, রোহিঙ্গা শিশুদের শরণার্থী শিবির ত্যাগ বন্ধ করতে ১১টি চেকপোস্ট থেকে নজর রাখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরপরও যদি কোনো শিশুকে শিবিরের বাইরে শ্রম দেওয়া অবস্থায় পাওয়া যায়, তাহলে তাদের মালিকদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।

অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে গত আড়াই মাসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেছে আইওএম। সরেজমিনে দেখা যায়, শরণার্থী শিবিরগুলোতে দারিদ্র্য ও পুষ্টিহীনতা চরম আকার ধারণ করেছে। এ ছাড়া সেখানকার শিশুদের শিক্ষার সুযোগ-সুবিধাও নেই বললেই চলে।

খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, কক্সবাজারের বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে কাজ করছে রোহিঙ্গা শিশুরা। কর্মক্ষেত্রে সাত বছরের শিশুদেরও খোঁজ পেয়েছে আইওএম। ছেলেশিশুরা সাধারণত স্থানীয় বিভিন্ন কৃষি খামার, নির্মাণশিল্প, মাছ ধরার নৌকায় অর্থের বিনিময়ে কাজ করছে। অনেক শিশুকে আবার চায়ের দোকানে ও রিকশা চালাতে দেখা গেছে।

অপরদিকে মেয়েশিশুদের বিভিন্ন বাসাবাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করতে দেখা গেছে। তাদের অনেকেই কক্সবাজার ছাড়িয়ে কাজ করছে আশপাশের জেলাগুলোতেও।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রোহিঙ্গা দম্পতি জানান, তাঁদের ১৪ বছর বয়সী মেয়েকে এক বাংলাদেশির বাড়িতে কাজ করতে পাঠিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে ভয়ংকর যৌন নির্যাতনের শিকার হয় সে। কাঁদতে কাঁদতে শিশুটির মা বলেন, ‘আমার মেয়েকে যে বাড়িতে কাজ করতে দিই, ওই বাসার গৃহকর্তা একজন মদ্যপ। তিনি রাতে আমার মেয়ের ঘরে ঢুকে তাকে ধর্ষণ করতেন। তিনি এই কাজ ছয়-সাতবার করেছেন। আমার মেয়ে যখন পালিয়ে আসে, তখন সে হাঁটতেও পারছিল না।’

এদিকে কাজ করতে নেমে বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে ছেলেশিশুরাও। আইওএমের কাছে এসব তথ্য দিয়েছেন হয়রানির শিকার ওই শিশুদের মা-বাবারাই।

মো. জুবাইর (ছদ্মনাম) নামের এক রোহিঙ্গা শিশু অভিযোগ করে, দৈনিক ২৫০ টাকার বিনিময়ে নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করে সে। কিন্তু টানা ৩৮ তিন কাজ করার পর তাকে মাত্র ৫০০ টাকা দেওয়া হয়।

১৪ বছর বয়সী জুবাইর জানায়, রাস্তায় ইট সাজানোর কাজ নিয়েছিল সে। কিন্তু মজুরি চাইলেই তাঁকে শারীরিকভাবে হেনস্তা করা হতো। এক সময় তাকে টাকা পরিশোধ না করেই তাড়িয়ে দেওয়া হয়।

এরপর একটি চায়ের দোকানে কাজ নেয় জুবাইর। সেখানে ভোর ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত কাজ করতে হতো তাকে। মাঝে বিশ্রাম নেওয়ার তেমন সুযোগ ছিল না। এমনকি এই কাজের জন্য তাকে কোনো মজুরিও দেওয়া হচ্ছিল না। একপর্যায়ে সেখান থেকে পালিয়ে আসে জুবাইর।

কান্নাভেজা চোখে জুবাইর জানায়, চায়ের দোকানের মালিক ফিরে এসে আবার তাকে নিয়ে যায় কি না এই ভয়েই তটস্থ থাকে সে।

আইওএমের প্রতিবেদনে বলা হয়, নিজেদের আর্থিক অবস্থা একটু সচ্ছল করতে অনেক রোহিঙ্গা মা-বাবাই তাঁদের সন্তানদের বাল্যবিবাহ দিচ্ছেন। এদের মধ্যে অনেক মেয়ের বয়স ১১ বছর বলে জানা গেছে।

আইওএম জানায়, পুরুষরা অনেক রোহিঙ্গা শিশুকে ‘দ্বিতীয় স্ত্রী’ হিসেবে ঘরে তুলছেন। বাংলাদেশে দ্বিতীয় স্ত্রীদের অনেক ক্ষেত্রে খুব শিগগিরই তালাক দিয়ে দেওয়া হয়। অনেকেই বিচ্ছেদের পর সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়ে।

জাতিসংঘের ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে দ্রুততার সঙ্গে বাড়ছে রোহিঙ্গা শিশুর সংখ্যা। চলতি মাসের পরিবারহীন দুই হাজার ৪৬২ রোহিঙ্গা শিশু পালিয়ে এসেছে।  তবে অনেক সংস্থাই বলছে, এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি। পেটের দায়ে এসব শিশুদেরও নামতে হচ্ছে কর্মযুদ্ধে।

LEAVE A REPLY