ধৃষ্টতা দেখাবেন না, বিশৃঙ্খলা করতে দেবো না: প্রধানমন্ত্রী

0
67

ভোলা নিউজ২৪ডটকম।। ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার না করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকারকে ভ্রুকুটি দেখানোর পর্যন্ত ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে। ধর্মের নামে কোনো ধরনের বিভেদ-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে দেবো না।একাত্তরের পরাজিত শক্তির একটি অংশ সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করতে মাঠে নেমেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

১৯৭১-এর পরাজিত শক্তির একটি অংশ মিথ্যা, বানোয়াট, মনগড়া বক্তব্য দিয়ে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করতে ইদানীং মাঠে নেমেছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, তারা সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করতে চাইছে। জাতির জনক ১৯৭২ সালে বলেছিলেন ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার না করতে। কিন্তু পরাজিত শক্তির দোসরেরা দেশকে আবার ৫০ বছর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। রাজনৈতিক মদদে সরকারকে ভ্রুকুটি দেখানো পর্যন্ত ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে।

মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার রাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টেলিভিশন ও বেতারে সম্প্রচারিত ভাষণে তিনি বলেন, ‘মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান—সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের রক্তের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ, ধর্মান্ধ নয়। ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার করবেন না। প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার রাখেন। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ।’

বিজ্ঞাপন

ধর্মের নামে এ দেশে কোনো ধরনের বিভেদ-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে দেওয়া হবে না জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ বাংলাদেশ লালন শাহ, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দের বাংলাদেশ। এ বাংলাদেশ শাহজালাল, শাহ পরান, শাহ মখদুম, খানজাহান আলীর বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ শেখ মুজিবের বাংলাদেশ; সাড়ে ষোলো কোটি বাঙালির বাংলাদেশ। এ দেশ সকলের। ধর্মীয় মূল্যবোধ সমুন্নত রেখে এ দেশের মানুষ প্রগতি, অগ্রগতি এবং উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে।

করোনা মোকাবিলায় বিশ্বে দৃষ্টান্ত

ইতিহাসের এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে এবারের বিজয় দিবস উদযাপিত হচ্ছে বলে স্মরণ করিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘এ বছর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছি। কয়েক দিন পর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে পদার্পণ করব। স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করেছি। গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমরা করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলা করে সমগ্র বিশ্বের বুকে নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করেছি। প্রমত্তা পদ্মার বুক চিরে নিজেদের অর্থায়নে নির্মাণাধীন পদ্মা সেতু মাত্র সপ্তাহখানেক আগে দেশের দুই প্রান্তকে সংযুক্ত করেছে।’

পৃথিবীর বুকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর প্রত্যয় নিয়ে দেশ ও দেশের বাইরে অবস্থানরত সব বাংলাদেশি নাগরিককে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানান শেখ হাসিনা।

অতীতের কোনো সরকারই করেনি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী জাতির জনক ইসলাম ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষা এবং প্রসারে যা করেছেন, ইসলামের নামে মুখোশধারী সরকারগুলো তা কখনোই করেনি। আইন করে মদ-জুয়া-ঘোড়দৌড় নিষিদ্ধ করা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা, মাদ্রাসা বোর্ড স্থাপন, ওআইসির সদস্যপদ অর্জনের মতো কাজগুলো বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই বাস্তবায়িত হয়েছিল স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে।

জাতির জনক শুধু একজন খাঁটি মুসলমানই ছিলেন না, তিনি ধর্মীয় আচারাদি নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিপালন করতেন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, তিনি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র—এই চারটি মৌলিক বিষয়কে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় ’৭৫-পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী সরকারগুলো মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত মূল্যবোধগুলোকে জলাঞ্জলি দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় নিজেদের আসন চিরস্থায়ী করার পদক্ষেপ নেয়। সামরিক জান্তা সঙ্গীনের খোঁচায় সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করে।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে জানান, তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার ধর্মীয় শিক্ষা প্রচার এবং প্রসারে যত কাজ করেছে, অতীতে কোনো সরকারই তা করেনি। ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, ৮০টি মডেল মাদ্রাসায় অনার্স কোর্স চালু, কওমি মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি, দাওয়ারে হাদিস পর্যায়কে মাস্টার্স মান দেওয়া হয়েছে। মাদ্রাসার শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি জেলা-উপজেলায় দৃষ্টিনন্দন মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। ইমাম-মোয়াজ্জিনদের সহায়তার জন্য কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আওতায় সারা দেশে মসজিদভিত্তিক পাঠাগার স্থাপন করা হয়েছে। লক্ষাধিক আলেম-ওলামায়ে কেরামের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি

সময়োচিত পদক্ষেপ এবং কর্মসূচি গ্রহণ করে মহামারির নেতিবাচক অভিঘাত কিছুটা হলেও সামাল দেওয়া গেছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, প্রায় ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রায় আড়াই কোটি প্রান্তিক মানুষকে নগদসহ নানা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক ধাক্কা সামলিয়ে প্রবাসী আয়, কৃষি উত্পাদন এবং রপ্তানি বাণিজ্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। গত অর্থবছরে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রক্ষেপণ বলছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধি হবে দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশ আজ একটি সমীহের নাম। বাংলাদেশ আর অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর বাংলাদেশ নয়। আজকের বাংলাদেশ স্বাবলম্বী বাংলাদেশ। একটা সময় উন্নয়ন বাজেটের সিংহভাগ আসত বিদেশি অনুদান থেকে। আজ বাজেটের ৯৭ ভাগ মেটানো হয় নিজস্ব অর্থায়নে। বাংলাদেশ কারও দয়া বা করুণার ওপর নির্ভরশীল নয়।

সরকারের বড় প্রকল্পের অবস্থা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, স্বপ্নের ও গর্বের পদ্মা সেতুর সব কটি স্প্যান বসানো শেষ। ঢাকায় মেট্রোরেলের কাজ আবার পূর্ণোদ্যমে শুরু হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ মহামারিতে এক দিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের মহাসড়কগুলো চার লেনে উন্নয়নের কাজও পুরোদমে এগিয়ে চলছে।

স্বাস্থ্যবিধি মেনে উদযাপন

প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে জানান, করোনাভাইরাসের কারণে জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান কর্মসূচিতে কিছুটা পরিবর্তন আনতে হয়েছে। এই মাহামারি না থাকলে যথাযথ উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে আগামী বছর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করা হবে। একই সঙ্গে চলবে জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালা।

করোনাভাইরাসসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে এ বছর যেসব রাজনীতিক, সংসদ সদস্য, বরেণ্য ব্যক্তিসহ সর্বস্তরের মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন; তাঁদের স্মরণ করে আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিজয় দিবস উদযাপনের অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কোনো অবহেলায় একজন মানুষেরও মৃত্যু কাম্য নয়।

স্মরণ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী। স্মরণ করেন জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে। ৩০ লাখ শহীদ এবং ২ লাখ নির্যাতিত মা-বোনের প্রতি শ্রদ্ধা জানান ভাষণে। মুক্তিযোদ্ধাদের জানান সশ্রদ্ধ সালাম। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের হাতে নিহত বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, মুক্তিযোদ্ধা লে. শেখ জামাল এবং ১০ বছরের শেখ রাসেলসহ ওই রাতের সব শহীদের প্রতিও শ্রদ্ধা জানান তিনি। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী দেশি-বিদেশি সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান প্রধানমন্ত্রী।
ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর শহীদদের স্মরণ করে ভারতের তৎকালীন সরকার, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দেওয়া দেশটির সাধারণ জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ভাষণের শেষ দিকে লাখো শহীদের রক্তের ঋণ ভুলে না যাওয়ার শপথ নিতে সবার প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

LEAVE A REPLY