খালেদার মুক্তিতে আইনি লড়াই আর আন্দোলন

0
414

ভোলা নিউজ ২৪ ডটনেট : দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মসূচি দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপির। দলটি তাদের নেত্রী বেগম জিয়াকে মুক্ত করতে এমন কিছু করবে না, যার মাধ্যমে সরকার লাভবান হতে পারে। সরকারের ফাঁদে পা দেবে না তারা। ঐক্যবদ্ধভাবে দলকে আরো শক্তিশালী করা হবে আগামী নির্বাচনকে টার্গেট করে। রায় ঘোষণার একদিন আগে বুধবার গুলশান অফিসে সংবাদ সম্মেলনের পর কেন্দ্রীয় নেতাদের জিজ্ঞাসার জবাবে এমন নির্দেশনাই যে দিয়ে গেছেন, তা দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা হবে- এমন ধরেই নিয়েই তিনি দলীয় নেতাদের বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়ে রেখেছেন।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দেশনেত্রী খুব স্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, কোনো রকমের কোনো হঠকারী কর্মসূচি দেয়া যাবে না, কোনো রকমের সহিংস কোনো কর্মসূচি দেয়া যাবে না। সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করতে হবে, বিক্ষোভ করতে হবে। এ কথাটা বরাবরই বলেছেন তিনি।

এদিকে জেলে যাওয়ার একদিন আগে ৭ ফেব্রুয়ারি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, আপনাদের খালেদা জিয়া কোনো অন্যায় করেনি। কোনো দুর্নীতি আমি করিনি। ন্যায়বিচার হলে আমার কিছু হবে না, আমি বেকসুর খালাস পাব। আর যদি শাসক মহলকে তুষ্ট করার জন্য অন্য কোনো রায় হয়, তাহলে তা কলঙ্কের প্রতীক হয়ে থাকবে। খালেদা জিয়ার সন্দেহ, তাকে নির্বাচন থেকে বাইরে রাখতেই এ মামলায় সাজানো রায় দেয়া হচ্ছে। তিনি দাবি করেন, তাকে রাজনীতি ও নির্বাচনের মাঠ থেকে দূরে রাখতে আদালতকে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেই দিন তিনি সরকারকে হুঁশিয়ার করে তিনি বলেন, আমি যে কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত। জেল বা সাজার ভয় দেখিয়ে কাজ হবে না। আমি মাথা নত করব না। একদলীয় শাসন দীর্ঘায়িত করার খায়েস পূরণ হবে বলে আমি মনে করি না। দেশে ন্যূনতম আইনের শাসন এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকলে এই জালিয়াতিপূর্ণ মামলা যারা দায়ের করেছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হওয়া উচিত। যারা এই মামলা দায়েরের নির্দেশ দিয়েছে তাদেরও সাজা হওয়া উচিত।

খালেদা জিয়াকে জেল থেকে মুক্ত করতে সরকারের পরিকল্পিত কোনো পাতানো ফাঁদে বিএনপি পা দেবে না বলে জানান দলটির চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম। তিনি বলেন, আসন্ন একাদশ নির্বাচনে বিএনপিকে দূরে রাখতে ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) জেলে যাওয়ার পর সরকার নানা ধরনের উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে আমাদের নেতাকর্মীদের বেপরোয়া করার চেষ্টা করবে। এতে নেতাকর্মীরা বেপরোয়া হয়ে আইনশৃঙ্খলবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ লিপ্ত হলে সেই সুযোগে শত শত মামলা দিয়ে রাজপথ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করবে। তিনি বলেন, ফলে আগামী নির্বাচনে নেতাকর্মী শূন্য মাঠ দখল করে ক্ষমতায় আসীন হতে চেষ্টা করবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তিনি বলেন, আমরা সরকারকে সেই সুযোগ দেব না।

খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পর বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়া প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, আগামী সংসদ নির্বাচনের বৈতরণী পার করতেই শেখ হাসিনা আমাদের নেত্রী বেগম জিয়া ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, যত জেল-জুলুম-নির্যাতন করুন না কেন, দেশের জনগণের কাছে আপনার স্বরূপ উন্মোচিত হয়ে গেছে। কোনো ফর্মুলাতেই আপনার মসনদ রক্ষা করতে পারবেন না। সরকারের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, সারাদেশের মানুষ জেগে উঠেছে। দেখেননি চারিদিকে আওয়ামী লীগের সশস্ত্র মহড়া, পুলিশের গুলি, ব্যারিকেড, তাণ্ডব উপেক্ষা করে বৃহস্পতিবার রাজধানীবাসী দেশনেত্রীর গাড়িবহরে যোগ দিয়েছিল। গতকালও শুক্রবারও পুলিশের নির্দেশ উপক্ষো করে হাজার হাজার জনগণ রাজপথে বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণ নির্দেশ দিয়ে কর্মসূচি পালন করে। রিজভী আরো বলেন, জনগণের প্রতিরোধে শেখ হাসিনা বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে বাধ্য হবেন।

বিএনপির নেতাকর্মীরা মনে করছেন, সামনে একদাশ সংসদ নির্বাচন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে। খালেদা জিয়াকে দুর্নীতি মামলায় সাজা দেয়া তাদের একটি কৌশল। তাই বিএনপির সামনের দিনগুলো হবে কঠিন থেকে কঠিনতর। দলটির সিনিয়র নেতারা বলেছেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে বিএনপির দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত ইতিবাচক। তবে তার আগে সুষ্ঠু নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকটি ইস্যুতে রাজনৈতিক মতৈক্য হতে হবে। নির্বাচনের মাঠ যেমন সমতল করতে হবে, তেমনি নির্বাচনকালীন সরকারের ধরন কেমন হবে তারও ফয়সালা করতে হবে। তারা বলেন, নেত্রীকে জেল থেকে মুক্ত করার পাশাপাশি নির্বাচনপূর্ব এসব দাবি আদায়ে তারা সোচ্চার হবেন। এমনকি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে নির্বাচনকে সুষ্ঠু করতে এসব দাবি আদায় করা হবে।

উল্লেখ্য, সাংবিধানিকভাবে নির্বাচনের আর মাত্র ১০-১১ মাস বাকি থাকলেও এর আগেই দুর্নীতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেলে যেতে হয় খালেদা জিয়াকে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানেরও একই মামলায় ১০ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। এর আগের একটি মুদ্রা পাচার মামলায় সাত বছরের জেল হয় তার। দলের প্রধান দুটি শীর্ষ পদের দু’জনের এমন কারাদণ্ড হওয়ায় বেশ চাপে আছে বিএনপি। তবে দলটির নেতারা মনে করেন, এটা কোনো চাপই নয়। খালেদা জিয়া যে দুর্নীতি করেননি, তা জনগণ ঠিকই বিশ্বাস করে। এজন্য বিএনপি নেত্রীর জনপ্রিয়তা আগের তুলনায় আরো বেড়েছে।

নেতারা বলেন, বিএনপির ‘দরজায় খিল দিয়ে’ সরকারি দল কৌশলে চলমান রাজনীতিকে নির্বাচনী আবরণ দিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আওয়ামী লীগ প্রধান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েক মাস ধরেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জনসভা করছেন। উন্নয়ন আর বিএনপির অতীত ব্যর্থতার কথা তুলে ধরে তিনি ভোট চাচ্ছেন নৌকার পক্ষে। শুধু তাই নয়, দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদেরও তিনি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। জানা গেছে, সরকারি দল আরেকটি একতরফা নির্বাচন করতে তেমন আগ্রহী নয়। সে কারণে বিএনপিকে আন্দোলনের চিন্তা থেকে সরিয়ে এনে নির্বাচনমুখী করতেই আগেভাগে নির্বাচনের আবহ তৈরির একটা কৌশল নেয়া হয়েছে। যাতে করে নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে বিএনপির তৃণমূল থেকেই দলের হাইকমান্ডের ওপর একটি চাপ তৈরি হয় এবং নির্বাচন বর্জনের কোনো চিন্তা তারা চূড়ান্তভাবে করতে না পারে।

এদিকে দলের প্রধান খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার আগেই ৩ ফেব্রুয়ারি বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভায় নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন। সেই সঙ্গে তাকে জেলে নেয়ার পর কঠিন আন্দোলনের ডাক না দিয়ে নিজ নিজ এলাকায় দলকে সুসংগঠিত করার নির্দেশও দেন তিনি। দলটির নির্বাহী কমিটির সভায় অংশ নেয়া দলের উপদেষ্টা পরিষাদের এক সদস্য মানবকণ্ঠকে বলেন, সারাদেশে নিজ নিজ জেলায় নেতাকর্মীদের মধ্যে মতবিরোধ দূর করে আন্দোলন ও নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা। তিনি জানান, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে তাকে জেল থেকে মুক্ত করার পাশাপাশি তৃণমূল বিএনপিকে শক্তিশালী করার জন্য বলেছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

অপরদিকে খালেদা জিয়ার সাজা হওয়ায় বিএনপির সারাদেশে নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষণিক হতাশ দেখা গেলেও ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য অঙ্গীকার করেছেন তারা। এমনটি জানিয়েছেন বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদ। তিনি বলেন, বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানোর দল, ভেঙে পড়ার দল নয়। নেতাকর্মীরা আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের প্রিয় নেত্রীকে জেল থেকে মুক্ত করে আনবে।

অপরদিকে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায় না হওয়ায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি। ওই নির্বাচনে অংশ না নেয়া সঠিক ছিল না ভুল ছিল, তা নিয়ে দলের ভেতরে দ্বৈততা থাকলেও তা অতীত হিসেবে ধরে নিতে চায় দলটি। বিএনপির অভ্যন্তরে এখন আগামী নির্বাচন নিয়ে নানা ভাবনা কাজ করছে। নেতারা বলছেন, বিএনপিতে প্রার্থীর কোনো প্রভাব নেই। নির্বাচনে অংশ নিলে ‘ডু অর ডাই’ ধরে নিয়ে সাংগঠনিক সব সমস্যাও সমাধান হয়ে যাবে। নেতাকর্মীরা সব ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে এসে দল মনোনীত প্রার্থীকেই বিজয়ী করার জন্য কাজ করবে।

গতকাল পর্যন্ত জানা গেছে, বিএনপির চিন্তা মূলত অন্য জায়গায়। সেটি হচ্ছে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’। অনেক নেতাই মনে করেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত আবেগাশ্রিত না হয়ে বাস্তবতার নিরিখেই নিতে হবে। নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচনের মাঠ নিরপেক্ষ না হলে, সে নির্বাচনে গিয়ে কার্যত কোনো লাভ হবে না। আর বিএনপিকেই নির্বাচনের সেই পরিবেশ আদায় করতে হবে বলে জানিয়েছেন দলটির সহ-ফতর সম্পাদক মো. বেলাল আহমেদ।

বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় দেয়ার পর ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার বিচারকাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। এদিকে কমপক্ষে ৫০ শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে মামলা চলমান রয়েছে, চার্জশিটও দেয়া হয়েছে। বিশেষ ট্রাইব্যুনালেও অনেক মামলার বিচার চলছে। কোনো কোনো নেতার বিরুদ্ধে স্থগিত মামলা ফের চালু হচ্ছে। বিএনপির ধারণা শীর্ষ পর্যায়ের বহু নেতাকে আগামী নির্বাচনে অযোগ্য করতেই সরকার মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিচ্ছে।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মীর মো. নাসির উদ্দিন বলেন, নির্বাচনের পথে আগামী দিনগুলোই বিএনপির জন্য মূল চ্যালেঞ্জের। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় না করে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হলে কাজের কাজ কিছুই হবে না।

LEAVE A REPLY