ভোলা নিউজ২৪ডটনেট।।সভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাসে মানুষ যত বেশি নিজেকে উন্নত ও সভ্য বলে দাবি করে এর পিছনে ক্রীয়াশীল থাকে মানুষের শুভ বুদ্ধি ও মুক্ত চিন্তা। পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থায় ভারতবর্ষে নারী নিগৃহ হচ্ছে যুগের পর যুগ ধরে পাশ্চাত্য ভ্রমণে বিশেষ করে শিকাগো সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে স্বামীজী প্রত্যক্ষ করেন সেই উন্নত বিশ্বে সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নারীও অংশীদার। নারী শক্তি জাগরণে রেনেসাঁ এসেছে এই উন্নত বিশ্বে। নারীকে সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে গ্রহণ না করে নারীকে দিয়েছেন সমমর্যাদা। স্বামীজী মনে করলেন ভারতবর্ষেও নারীর জাগরণ অত্যন্ত প্রয়োজন। তাই তিনি মনে করলেন নারীকে ভোগ বিলাসের সাথী নয়, বরং মাতৃরূপে তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে তাতেই জগতের কল্যাণ। এই ক্ষেত্রে তিনি অনুসরণ করলেন প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রের কুমারীকে মাতৃরূপে পূজার বিধানকে। মূলত এই চিন্তা থেকেই ১৯০১ সালে বেলুর মঠে শ্রী মা সারদা দেবীর অনুমতি নিয়ে প্রথম শুরু করলেন কুমারী পূজা। কুমারী মধ্যে সেই মহামায়া আদ্যশক্তির পূজা সম্পন্ন করলেন।
কুমারী পূজা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যমত শ্রেষ্ঠ পূজা যা দুর্গা পূজার অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত। কুমারী পূজা সম্পর্কে ভক্তদের জানার সুযোগ খুব কম। অনেকেই জানে না কুমারী পূজা কী এবং কী তার রহস্য। সাধারণত রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে কুমারী পূজা করে থাকে। প্রথমে দুর্গা পূজায় কুমারী পূজার নিয়ম বহাল থাকলেও পরবর্তীতে এ পূজার প্রচলন একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। স্বামী বিবেকানন্দ এর পুনঃপ্রচলন করেন বেলুর মঠে, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ যাকে মহাশক্তিরূপে পূজা করেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ যাকে মা ভগবতীর জীবন্ত বিগ্রহ মনে করতেন তিনি পরম পূজনীয়া শ্রী শ্রী মা সারদা দেবী।
কুমারী পূজা সম্পর্কে সাধারণের মধ্যে বেশ কৌতূহল দেখা যায়। বালিকা প্রতিমায় মহামায়ার পূজা ঈশ্বরের মাতৃভাবে আরাধনার ফলিতরূপ বলা যায় অগ্নি এবং তার দাহিকাশক্তি যেমন অভিন্ন সে রকম ঈশ্বর এবং তার শক্তি অভিন্ন ঈশ্বর করুণাময় সর্বশক্তিমান এবং তার শক্তি সর্ব শক্তিময়ী। শ্রীরামকৃষ্ণ এই শক্তিকে মা বলতেন, আর সকলে এই সত্তাকে ঈশ্বর বলে থাকে।
নারী জগদ্ধাত্রীর অংশ বিশেষ সমগ্র বিশ্বে তিনি মহামায়ারূপে প্রকাশিতা। প্রত্যেক নারীকে মাতৃভাবে ভাবনা মহামায়ার শ্রেষ্ঠ উপাসনা এবং নারী মর্যাদার সর্বোচ্চ বিধান। এখানে মানুষে ঈশ্বর বোধ আরোপিত। ঈশ্বরের মানবীয় ভাবনা নিম্নস্তরের সর্বভ‚তে ঈশ্বরীয় শক্তি বিরাজমান আর এভাবেই দুর্গা পূজাতে কুমারী পূজার বিধান। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন- কুমারী পূজা করে কেন? “সবস্ত্রী লোক ভগবর্তীর এক একটি রূপ শুদ্ধাত্মা কুমারীতে ভগবতীর বেশী প্রকাশ” ইনিই আমাদের মা।
ঈশ্বরের অনন্তভাব মাতৃভাবে ঈশ্বরের আরাধনাও তার বৈচিত্র্যময় আরাধনার একটি রূপ মাতৃভাবে ঈশ্বরের আরাধনার পরাকাষ্ঠা তখনই যখন সকল নারীতে মাতৃভাব উপলব্ধি হয়। আধ্যাত্মিক সাধনার মূলে সাধক নিজেকে মায়ের কোলে নিরাপদ শিশুর মতোই মনে করে নিশ্চিন্ত হয় এবং শুদ্ধচিত্তে ঈশ্বরের উপলব্ধি করে ধন্য হয়। শ্রীরামকৃষ্ণের ভাষান্তরে ঈশ্বরের স্থিরতা ও দূরবর্তী অবস্থান যেন স্থির চুম্বক ও দূরবর্তী ছুঁচের কম্পমান অবস্থা তার শক্তি সর্বভূতে ক্রিয়াশীল এই শক্তি মাতৃরূপে আবিভর্‚তা অগ্নি ও দাহিকা শক্তির অভিন্নতার মতো তাই তিনি বলেছেন- “মাতৃভাব সাধনার শেষ কথা” শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছেন-মাতৃভাব বড় শুদ্ধভাব। কুমারীর মধ্যে দৈবীভাবের প্রকাশ দেখা বা তাকে জননীরূপে পূজা করা সেই শুদ্ধ সত্ত ভাবেই এক সামর্থ্য প্রকাশ। দুর্গা পূজায় কুমারী পূজার অনুষ্ঠান তারই শাস্ত্রীয় ও বাস্তবায়িত রূপ।
কুমারী পূজা হচ্ছে ধর্মীয় সৌরভে নারী জাতির মর্যাদা সমুন্নত করার সামাজিক আন্দোলন। স্বামীজীর এই কর্মটি তার গুরু ভক্তির নিদর্শন স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ যে তাকে জিতেন্দ্রিয় বলে অভিহিত করেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দের মাতৃ বন্দনা বা পূজার সর্বশ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত বোধ করি শ্রী মা সারদা দেবীকে শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্খ জননীরূপে অধিষ্ঠিতা করে তাকে জগজ্জননী জ্ঞানে ‘জ্যান্ত দুর্গা’ বলে বন্দনা করা।
আদিকালে দুর্গা পূজায় কুমারী পূজা প্রচলন থাকলেও অনেকেই এই কুমারী পূজা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতেন না। স্বামী বিবেকানন্দই প্রথম বেলুর মঠে কুমারী পূজার পুনঃপ্রচলন করেন। স্বামীজীর এই কুমারী পূজা করা বিষয়ে কিছু আশ্চর্য কাহিনী জানা যায় তার মানস কন্যা নিবেদিতাসহ আরো কয়েকজনকে নিয়ে কাশ্মীর ঘুরতে গিয়ে। তিনি এক মাঝির শিশু কন্যাকে কুমারী পূজা করেন। যা দেখে নিবেদিতাসহ তার অন্যান্য পাশ্চাত্য শিষ্যরাও বিস্মিত হন। পরিব্রাজক অবস্থায় বিভিন্ন সময়ে তার আরো কিছু শিশু কন্যাকে কুমারীরূপে পূজা করার কথা জানা যায়।
সর্বশেষে বেলুর মঠে প্রথম দুর্গা পূজায় (১৯০১ সালে) নয়জন কুমারীকে পূজা করা এবং তাদের মধ্যে একজনকে নিজেই পূজা করেন। মোট কথা মাতৃ ভাবময় শ্রীরামকৃষ্ণ শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ কোনো উচ্চকোটির মহামানব ছিলেন। এখন কুমারী পূজা সম্পর্কে আমরা সাধারণত জানি যে গিরিরাজ বাহিমালয় কন্যা অসুরদের বিনাশ করতে এসেছিলেন মহিষাসুর নিধন এবং ভক্তদের দুঃখ কষ্ট দূর করতে পৃথিবীতে দূর্গার আগমন। মা দুর্গা শিবকে স্বামী হিসেবে বরণ করে নিয়ে কৈলাসে ঘর সংসার পেতেছেন। প্রতিবছর শরৎকালে ছেলে-মেয়ে নিয়ে মা দুর্গা আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষে চারদিনের জন্য তাকে বাবার ঘরে অর্থাৎ পৃথিবীতে আসতে হয়।
ভক্তদের পূজা গ্রহণ করার জন্য এই চার দিনের একদিন তাকে কুমারীরূপেও পূজা করা হয়। কুমারী পূজার বিধি সম্পর্কে তন্ত্রে দেবাদিদেব মহাদেব মহাদেবীকে লক্ষ্য করে বলেছেন- হে সুন্দরী শত কোটি মুখে সহস্র কোটি জিহ্বায় কুমারী পূজার ফল ব্যক্ত করতে পারব না। হে শিবে; কুমারী পূজায় জাতিভেদ নেই, সর্বজাতীয়া কুমারী গণেরই পূজা করা যায়। কুমারী পূজায় জাতি বিচার করলে নরকে যেতে হয়। তার আর উদ্ধার হয় না। মন্ত্রবান ব্যক্তি অবিচারিত কাজ করলে পাপী হয়ে থাকে। অতএব, মহাভক্তি সহকারে দেবীজ্ঞানে কুমারী পূজা করা কর্তব্য। কুমারী সর্ববিদ্যা স্বরূপা সন্দেহ নাই। একজন কুমারীকে পূজা করলে সব দেব-দেবীর পূজা করা হয়।
এই কুমারী পূজার রীতি থেকেই সম্ভবত একদা বাংলাদেশে গৌরীদান প্রথা এসেছিল। সাধারণত একজন কুমারীকে একাধিকবার কুমারী পূজার জন্য মনোনীত করা হয় না। কুমারী পূজার জন্য মনোনীত বালিকা পরবর্তী সময়ে অন্যদের মতো স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে এ ব্যাপারে কোনো বিধি নিষেধ নেই। প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট তিথিতে একজন কুমারীকে মাতৃরূপে বন্দনা করার অনুষ্ঠান চালু করে স্বামী বিবেকানন্দ মাতৃত্বের যে কমনীয় রূপকে বিকশিত করে তুলেছেন তারই ধারাবাহিকতায় কুমারী পূজা চলতে থাকবে যুগ যুগ ধরে। বস্তুবাদী বিশ্বে মানুষ ভোগ বিলাসিতা প্রাচুর্য তথা ঐশ্বর্য নিয়ে যখন দিশেহারা তখন একমাত্র মাতৃত্ব শক্তির আরধনার মধ্য দিয়েই জীবনে মুক্তি আসতে পারে এবং সেটি সম্ভব হবে কুমারী পূজার মধ্য দিয়ে।