তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিলের দাবিতে সাংবাদিকরা সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। বিতর্কিত এ ধারা বাতিলের জন্য সাংবাদিকসমাজ আজ এক কাতারে। অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে সাধারণ জনতাকে ৫৭ ধারায় হয়রানি ও মিথ্যা মামলা দেয়া হচ্ছে। তাই ৫৭ ধারার এই অপপ্রয়োগের কারণে দিন দিন ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে দেশের জনগণও।
৫৭ ধারা নিয়ে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও দৈনিক সকালের খবর-এর সিনিয়র রিপোর্টার আজমল হক হেলাল নতুন সময়কে বলেন, এটি একটি কালো আইন। এ আইনের মাধ্যমে সাংবাদিকরা হেনস্তা-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
আইন সমাজকে বিকশিত করে, আতঙ্কিত করে না। যে আইন সমাজকে আতঙ্কিত করে, সে সমাজ কখনো বিকশিত হয় না। সেখানে স্থিতিশীল সমাজব্যবস্থাও থাকে না।
আজমল হক হেলাল বলেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা পাকিস্তান শাসনামলেও ছিল না। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন স্বাধীন বিধ্বস্ত দেশ গোছাতে ব্যস্ত, তখন তাঁকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে হত্যা করা হয়েছে। এরপর আর সংবাদপত্র বিকশিত হয়নি।
তিনি বলেন, এখন সংবাদপত্র বিকশিত হয়েছে। বেড়েছে অনলাইন পত্রিকার সংখ্যা। এজন্য সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানাই। তবে সংবাদপত্রের কিছু এথিকসও রয়েছে। যেগুলো আমাদের মেনে চলা উচিত। তার একটি হচ্ছে, সংবাদেপত্রে যেগুলো সাংবাদিকরা লিখবেন, সেগুলো অবশ্যই যাচাই-বাচাই করে লিখবেন। সঠিকভাবে মতপ্রকাশ করবেন। কিন্তু সেখানে যদি ৫৭ ধারার মতো কালো আইন থাকে, তবে দেখা যাবে একটা সময় সংবাদপত্রই থাকবে না। সাংবাদিকরাও কাজ করবেন না। দেশে উশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হবে।
তিনি আরো বলেন, আজকে সরকার সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনা করছেন, আমি মনে করি এটি সাংবাদিকদের বড় অবদান। সমাজের কোথাও দুর্নীতি-অনিয়ম হলে সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তা খুঁজে বের করেন। লেখার মাধ্যমে তা সংশ্লিষ্টদের কাছে তুলে ধরেন। কিন্তু এই ৫৭ ধারা থাকলে সাংবাদিকরা লেখার আগ্রহ ক্রমেই হারিয়ে ফেলবেন। তাই সমাজকে বিকশিত করতে হলে দেশে যত কালো আইন আছে, তা বাতিল করতে হবে।
আজমল হক হেলাল বলেন, ব্রিটিশদের করা যত আইন আছে, তাতে হাত দেয়া যাচ্ছে না। সঠিকভাবেই চলছে। এমনকি সেসব আইনের ব্যাখ্যাও আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টি যত আইন করেছে, তা সবই বিতর্কিত। কোনো আইনই ভালো কাজে আসেনি। সবাই নিজেদের স্বার্থে করেছেন।
৫৭ ধারা নিয়ে তথ্যমন্ত্রীর বিতর্কিত অবস্থান নিয়েও কথা বললেন এ সাংবাদিক নেতা। তিনি বলেন, ক্ষমতার আসার আগে গুলিস্তানে দাঁড়িয়ে তথ্যমন্ত্রী এক বক্তব্যে বলেছিলেন, ৫৪ ধারা (বিশেষ ক্ষমতা আইন) নামের কালো আইন বাতিল চাই। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সত্য, সেই মানুষ এখন পার্লামেন্টে বলেন ৫৭ ধারা দেশ-জাতিকে নিরাপত্তা দিচ্ছে। তাঁর এ দ্বিমুখী আচরণ আমাদেরকে আহত করে।
৫৭ ধারা নিয়ে দৈনিক আমাদের অর্থনীতির চিফ রিপোর্টার ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের জনকল্যাণ সম্পাদক উম্মুল ওয়ারা সুইটি বলেন, আমার কাছে মনে হয় এটি একটি স্বেচ্ছাচারী ধারা, স্বৈরতান্ত্রিক ধারা। অনেকটা ৫৪ ধারার মতো, সন্দেহ হলেই গ্রেপ্তার। আবার না চাইলে, গ্রেপ্তার নয়।
তিনি বলেন, ৫৭ ধারার মধ্য দিয়ে প্রভাবশালীদের উত্থান হচ্ছে। তারা লাভবান হওয়ার পাশাপাশি গণমাধ্যমকর্মীদের নিষ্পেষণ করছেন। বিষয়টি দুঃখজনক।
সিনিয়র এই সাংবাদিক বলেন, এ ধারার মাধ্যমে শুধু সরকার পক্ষ যে সাংবাদিকদের দমন করার চেষ্টা করছে তা নয়, ক্ষমতার সঙ্গে যাদের যোগসাজশ আছে তারা সবাই (স্থানীয় প্রশাসন কিংবা প্রভাবশালী মহল) এর সঙ্গে জড়িত। যেটি গণমাধ্যমের নৈতিকতাকে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে।
তথ্যমন্ত্রীর অবস্থান নিয়েও কথা বললেন এই সাংবাদিক নেতা।
তিনি বলেন, ৫৭ ধারার বিষয়টি এখন আর শুধুমাত্র তথ্যমন্ত্রীর কাছে সীমাবদ্ধ নেই। কারণ, বিভিন্ন জোট নিয়ে বর্তমান সরকার গঠিত। সেখানে সবার অংশগ্রহণ রয়েছে। রয়েছে মতামতও।
উম্মুল ওয়ারা সুইটি বলেন, সরকারের সঙ্গে গণমাধ্যমকর্মীদের সম্পর্ক নষ্ট করছে এই ৫৭ ধারা। অথচ আমরা জানি, এই সরকার সাংবাদিকবান্ধব, গণমাধ্যমবান্ধব সরকার। নানাভাবে তারা সাংবাদিকদের সহায়তা করে আসছে। কিন্তু ৫৭ ধারা তাদের সেই অর্জনকে শেষ করে দিচ্ছে। প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।
সাম্প্রতিক সময়ের সাংবাদিক নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে এই সিনিয়র সাংবাদিক বলেন, যতদূর জানি প্রায় ৫০ জনের মতো সাংবাদিক এই ধারার আওতায় গ্রেপ্তার-নির্যাতন-হেনস্তার শিকার হয়েছেন। যেটি কোনোভাবেই কাম্য নয়।
৫৭ ধারা সুস্থ সাংবাদিকতার জন্য হুমকি বলেও মনে করেন এই সাংবাদিক নেতা।
উম্মুল ওয়ারা সুইটি বলেন, ৫৭ ধারায় সাধারণ কেউ মামলা করতে গেলে এখন পুলিশ সদর দপ্তরের সুপারিশ এবং সরকার দলীয় কেউ করতে গেলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অনুমতি লাগবে। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে, যে আইনটি নিয়ে এত বিতর্ক, সেটি রাখার কি দরকার?
৫৭ ধারা বাতিলের দাবি জানিয়ে সিনিয়র এই সাংবাদিক বলেন, এই ধারা সাংবাদিকতাকে ধ্বংস করার ধারা। তাই সংশোধন নয় সাংবাদিক সমাজ অবিলম্বে এই ধারা বাতিল চান।