নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টির ছয় শর্ত দিলেন খালেদা

0
333

ভোলা নিউজ ২৪ ডটনেট : একাদশ জাতীয় নির্বাচন ‘নির্দলীয় সরকারের অধীনে’ করার দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি শনিবার দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভার উদ্বোধনী অধিবেশনে ভোটের আগে সংসদ ভেঙে দেয়াসহ কয়েকটি শর্ত তুলে ধরে এ দাবি করেন। ক্ষমতাসীন দলের উদ্দেশে তিনি বলেন, হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি বন্ধ করে দেশে একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করুন। আমরা কখনো প্রতিহিংসা করব না।

বিএনপি চেয়ারপার্সনের শর্তগুলো হলো: ১. জাতীয় নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয় সরকারের অধীনে, ২. জনগণ যাতে ভোট কেন্দ্রে আসতে পারে সে রকম পরিবেশ তৈরি করতে হবে, ৩. নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, ৩. নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দিতে হবে; ৪. ভোটে সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে, ৫. নির্বাচন কমিশনকে কাজ করতে হবে নিরপেক্ষতার সঙ্গে ও ৬. কোনো ‘ইভিএম-টিভিএম’ চলবে না।

বেলা ১১টায় রাজধানীর হোটেল লা মেরিডিয়ানে খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে এই বৈঠক শুরু হয়। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সাড়ে চারশ’র মতো সদস্য ছাড়াও চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্যরা সভায় অংশ নেন। খালেদা জিয়ার বক্তৃতার আগে ১১টা ৩৮ মিনিটে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ধারণকৃত একটি ভিডিও বার্তা প্রচার করা হয়। এর আগে উদ্বোধনী পর্বে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংগঠনিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। এ ছাড়া দলের পক্ষ থেকে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভায় প্রয়াত নেতাদের পাশাপাশি শিক্ষাবিদ-শিল্পী-সাহিত্যিকসহ বিশিষ্টজনদের স্মরণ করে দেয়া শোক প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। বক্তৃতার শেষ করার পর দুপুরের খাবারের বিরতি দেয়া হয়। তারপর দুপুর ১টায় বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্যদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার কর্ম অধিবেশনে বসেন খালেদা জিয়া। প্রথম বক্তা হিসেবে কর্ম অধিবেশনে বক্তব্য দেন দলের সহসাংগঠনিক সম্পাদক কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি শরীফুল আলম।

উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে যোগ হওয়ার পর সপ্তম, অষ্টম ও নবম সংসদ নির্বাচন ওই নির্দলীয় সরকারের অধীনেই হয়। এর মধ্যে দুটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবং একটিতে বিএনপি জয়ী হয়। ২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের শেষ দিকে রাজনৈতিক সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে জরুরি অবস্থা জারির পর সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর ক্ষমতায় থাকে; তখনই এ পদ্ধতির দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ২০১১ সালের ১০ মে এক রায়ে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট। ওই বছরই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করে আওয়ামী লীগ সরকার। শুরু থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের বিরোধিতা করে আসা বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনের আন্দোলনে নামে। অন্যদিকে নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ আবারো সরকার গঠন করে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি জোটের ওই আন্দোলন এবং নির্বাচনের বর্ষপূর্তি ঘিরে তাদের তিন মাসের অবরোধে নাশকতায় অন্তত দুইশ’; মানুষের প্রাণহানি ঘটে।

হোটেল লা মেরিডিয়ানে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সভার উদ্বোধনে খালেদা জিয়া ‘গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে’ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দেয়ার ইঙ্গিত দিয়ে নেতাকর্মীদের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ হবে আমাদের শান্তিপূর্ণ, নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক। সেই শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক কর্মসূচি যে হবে, সেই কর্মসূচিতে অংশ নিতে আমি জনগণকেও আহ্বান করব।

বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দেশের নিম্ন আদালত ‘সরকারের কব্জায়’ থাকায় সঠিক রায় দেয়ার ক্ষমতা বিচারকদের নেই বলে মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, দেশের নিম্ন আদালত যে ‘সরকারের কব্জায়’, তা ‘সর্বোচ্চ আদালতও’ বলছে। সরকারের কথার বাইরে, ভাবনা-চিন্তা যাই থাকুক না কেন, তারা বুঝতে পারছে যে এটা সঠিক নয়, কিন্তু সঠিক রায় দেয়ার ক্ষমতাটা তাদের নেই।

আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়ে দুই কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হলে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন সাজা হতে পারে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার। তার বড় ছেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও এ মামলার আসামি।

মুদ্রা পাচার মামলায় জজ আদালতে খালাস পেলেও হাইকোর্টে তারেকের সাত বছরের সাজা হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে খালেদা তার বক্তৃতায় বলেন, সঠিক রায় দিলে যে কি হতে পারে সেটা আপনারা দেখেছেন। তারেক রহমানের সঠিক রায় দেয়া হয়েছে যে আদালতে, সেই বিচারককে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে।

সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ‘সত্যি কথা বলায়’ সরকার তাকে দেশের বাইরে যেতে এবং পদত্যাগ করতে ‘বাধ্য করেছে’ বলেও অভিযোগ করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন।

নির্বাহী কমিটির উদ্বোধনী পর্বের বক্তৃতায় খালেদা জিয়া বলেন, বিএনপির কোনো ভয় নেই। বিএনপির সঙ্গে প্রশাসন আছে, পুলিশ আছে, সশস্ত্র বাহিনী আছে। এ দেশের জনগণ আছে। দেশের বাইরে যারা আছেন তারা আছেন। কাজেই বিএনপির কোনো ভয় নেই, ভয়টা আওয়ামী লীগের।

তিনি বলেন, সরকার প্রশাসনকে দলীয় নেতাকর্মীদের মতো ব্যবহার করছে। তারা মনে করে প্রশাসনকে ব্যবহার করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চায়। কিন্তু প্রশাসন যদি একটু সুযোগ পায় তাহলে তারা নিরপেক্ষ নির্বাচন করবে। কেননা তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। তিনি বলেন, পুলিশকে বাধ্য করা হচ্ছে অন্যায় ও দলীয় কাজ করতে।

বক্তব্যের শেষে এসে খালেদা জিয়া বলেন, আমি যেখানেই থাকি না কেন, আমি আপনাদের সঙ্গে আছি। আমাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে কেউ দমাতে পারেনি, পারবেও না। আমি দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আছি, দেশের মানুষের সঙ্গে আছি। খালেদা জিয়া বলেন, সাহস সঞ্চার করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। শান্তিপূর্ণ, নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক কর্মসূচিতে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। আসুন সবাই এই দেশটাকে রক্ষা করি, গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনি।

প্রসঙ্গত, ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় হবে; দুই কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের এই মামলার প্রধান আসামি খালেদা জিয়ার শাস্তি হতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে দলটির নেতাদের। এই রায় ঘোষণার তারিখ ঠিক হওয়ার পর দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসে কোনো কর্মসূচির ঘোষণা দেননি খালেদা জিয়া। তৃণমূল নেতাদের মতো নিয়ে কর্মসূচি ঠিক করা হবে বলে দলটির পক্ষ জানানো হয়েছে।

ঐক্যের আহ্বান: সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, গুম, খুনের বিরুদ্ধে দেশের জনগণ জেগে উঠবে, ২০ দল জেগে উঠবে। সব রাজনৈতিক দলকে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানাই। আজ দেশের এ অবস্থায় জাতীয় ঐক্য অনেক বেশি প্রয়োজন। আমরা কে কী পেলাম, সেটা বড় কথা নয়। আমাদের পাওয়া ওটাই হবে, যদি জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে দেশটাকে রক্ষা করতে পারি- তবে সেটাই হবে সবচেয়ে বড় পাওয়া। তিনি বলেন, ইনশাআল্লাহ দেশ জাগবে, জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠবে। সবাই আমরা দেশ গড়ে তুলব। দেশ গড়ার জন্য অনেক লোকের প্রয়োজন হবে। সেখানে আজ যারা জুলুম-অত্যাচার করছে, তাদের সবাইকে মাফ করে দিয়েছি। আমরা প্রতিহিংসার রাজনীতি করি না, তাদেরও সঙ্গে নিতে আমরা কোনো দ্বিধা করব না।

খালেদা জিয়া নেতাকর্মীদের বলেন, সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকবেন। বহু সংকট আসবে, ষড়যন্ত্র হবে এবং নানা রকমভাবে ভয়ভীতি দেখাবার চেষ্টা করবে, কিন্তু আমরা ভয়ে ভীতু নই।

বেইমানদের কোনো মূল্যায়ন হবে না: তিনি বলেন, যারা সব আন্দোলন-সংগ্রামে ছিল, যারা কাজ করেছে, যারা দলের সঙ্গে বেঈমানি করেনিÑ দলে তাদের ভালো ভালো জায়গায় স্থান দেয়া হবে। ভবিষ্যতে যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়- তাহলে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে অবশ্যই তারা মূল্যায়ন পাবেন। কিন্তু যারা বেইমানি করবে, এক পা এদিকে, আরেক পা ওদিকে রাখবে- তাদের কোনো মূল্যায়নের জায়গা নেই।
আগে ক্ষমা করার উদাহরণ টেনে খালেদা জিয়া বলেন, তারপরও আমরা কিন্তু ক্ষমা করেছি। ক্ষমা একবার হয়, বারবার হয় না। তাই আমি বলতে চাই, বিপদ আসলে আসুন সবাই একসঙ্গে বিপদ মোকাবিলা করব। আর সুদিন আসলে একসঙ্গে সুন্দর করে দেশ গড়ব।

তার পরও বলবেন গণতন্ত্র আছে: খালদো জিয়া বলেন, দেশে ক্রান্তিকাল চলছে। আমরা এখানে সভা করতে চাইনি। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট, সোহরাওয়ার্দী ছিল- কিন্তু কেন সভা করতে দেয়া হলো না? বিএনপি সবচেয়ে বড় দল। তার পরও বলবেন দেশে গণতন্ত্র আছে।

তিনি বলেন, ডিজিটাল আইনের নামে নতুন কালাকানুন করা হচ্ছে। সাংবাদিকেরা সত্য কথা বলে। সেই কথাগুলো যখন মানুষ শোনে, তখন জনগণের অধিকার হরণ করতে নতুন আইন করা হচ্ছে।

ডিসেম্বরে নির্বাচন হলে, এত আগে প্রচারণা কেন: বিএনপি চেয়ারপার্সন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারের সমালোচনা করে বলেন, আওয়ামী লীগ বলছে নির্বাচন হবে ডিসেম্বরে। ডিসেম্বরে নির্বাচন হলে এত আগে প্রচারের কারণ কী? তিনি বলেন, নৌকা এমন ডোবা ডুবছে, যে তোলার জন্য এত আগে ভোট চাইতে হচ্ছে? হাত তুলে ওয়াদা করাতে হচ্ছে।

খালেদা জিয়ার বক্তব্যের সময় মিলনায়তনে উপস্থিত নির্বাহী কমিটির সদস্যরা খালেদা জিয়ার নামে স্লোগান দেন। নেতারা স্লোগানে বলেন, ‘আমার নেত্রী আমার মা, বন্দি হতে দেব না।’ ‘আমার নেত্রী আমার মা, জেলে যেতে দেব না।’

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের সাড়ে চার মাস পর ৫০২ সদস্যের জাতীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করেন খালেদা জিয়া। এরপর এই প্রথম ওই পর্ষদের নেতাদের নিয়ে বসছেন তিনি, যদিও বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছয় মাস অন্তর এই সভা হওয়ার কথা।

LEAVE A REPLY