ভোলায় দুর্নীতির অভিযোগে প্রধান শিক্ষক সাময়িক বরখাস্ত

0
109

স্টাফ রিপোর্টার ।। ভোলা সদর উপজেলার ইলিশা ইউনিয়নের ‘নিজাম উদ্দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ এর প্রধান শিক্ষক (সাময়িক বহিস্কৃত) এইচ এম মইনুল হক শিপুর বিরুদ্ধে ব্যাপক অর্থ আত্মসাৎ, অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও শিক্ষিকা/ছাত্রীদের সাথে অশ্লীল আচরণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রধান শিক্ষক মইনুল হক শিপুর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উইং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর এবং পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাবর অভিযোগ করা হয়। তার বিরুদ্ধে আনিত অর্থ আত্মসাৎ, অনিয়ম, দুর্নীতি ও ছাত্রী-শিক্ষিকাদের সাথে অশ্লীল আচরণের করার অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করে সত্যতা প্রমাণিত হওয়ায় প্রধান শিক্ষক এইচ এম মইনুল হক শিপুকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ভোলা সদর উপজেলার ২নং পূর্ব ইলিশা ইউনিয়নের ‘নিজাম উদ্দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ এর প্রধান শিক্ষক এইচ এম মইনুল হক শিপু তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিদ্যালয়ের অর্থ আত্মসাৎ, অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও শিক্ষিকা/ছাত্রীদের সাথে অশ্লীল আচরণ করে আসছিলেন। তার এসব কর্মকান্ডে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে ম্যানেজিং কমিটির সদস্য, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। তারা প্রধান শিক্ষক এইচ এম মইনুল হক শিপুর এসব অনিয়মের সুষ্ঠ তদন্ত চেয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী করে দুর্নীতি দমন কমিশন, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উইং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর এবং পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাবর অভিযোগ দায়ের করেন। ভূক্তভোগীদের এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রধান শিক্ষক শিপুর বিরুদ্ধে তদন্তে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন ও পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উইং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর এবং পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

প্রধান শিক্ষক এইচ এম মইনুল হক শিপু নিজের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যালয়ে শাখা খোলার নামে ২,৫০,০০০/- টাকা খরচ দেখিয়ে কাজ না করে আত্মসাৎ করেন। সেই টাকা ম্যানেজিং কমিটির সভায় জরিমানা করে স্কুলের সাধারণ তহবিলে জমা দেওয়ার জন্য বলা হলেও তা জমা দেননি। বিদ্যালয়ের এক সহকারী শিক্ষকের আবেদনের প্রেক্ষিতে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা- বাংলাদেশ তদন্তে প্রমানিত হয়। যার স্মারক নং-৪জি-২৪৫-ম/২০১৪-৫৭৪-৫৭৪, তাং- ০৫-০৩-২০২০ইং। ২০০৯ সালে শিক্ষার্থী মুনিয়ার ৭০০/-, ২০১৫ সালে সুমাইয়া আক্তার, ২০১৬ সালে সেতু রানীর ১,৯০০/-, মোঃ শফিকুর ইসলামের ১,৯০০/-, ২০১৭ সালে সুমাইয়া আক্তারের ১০৫০/-, ইসরাত জাহানের ১,৫৭৬/- মেধা বৃত্তি ও সাধারণ বৃত্তির টাকা বিতরণ না করে আত্মসাৎ করেন। ২০০৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত উপবৃত্তির টিউশন ফি বাবদ সরকারী বরাদ্দকৃত ৩,০৫,৩৫০/- টাকা প্রাপ্ত হয়েছে। সেই টাকা শিক্ষকদের মধ্যে বিতরণ এবং স্কুলের উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহার না করে তা আত্মসাৎ করেন। ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের নিবন্ধন ফি বাবদ ১৭০/- টাকা ধার্য ছিলো।

কিন্তু প্রধান শিক্ষক ১৬০জন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে রেজিঃ ফি বাবদ ৫০০/- টাকা করে নিয়ে তা আত্মসাৎ করেন। ২০১৯ সালে ৮ম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের নিবন্ধন ফি ৭০/- টাকা ধার্য্য থাকলেও তিনি ১৫০/- টাকা করে নিয়ে তা আত্মসাৎ করেছেন। নবম-দশম শ্রেণীর সেশন ফি বাবদ ৫০০/- টাকা করে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আত্মসাৎ করেন তিনি। এসএসসি পরীক্ষার সনদপত্র প্রধান শিক্ষক নিজে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১০০০/- টাকার বিনিময়ে বিতরণ করে উক্ত টাকা আত্মসাৎ করেন। সরকারী ২,০৬,৭৮৯/- টাকা আত্মসাৎ করেন প্রধান শিক্ষক শিপু। পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের তদন্তে টাকা আত্মসাৎ প্রমানিত হয়। পরে উক্ত টাকা সরকারী কোষাগারে জমা দেন। ১৪ বছর যাবৎ ভূয়া কাগজপত্র দেখিয়ে অবৈধভাবে প্রধান শিক্ষকের বেতন স্কেল ভোগ করে আসছেন তিনি। বিদ্যালয় থেকে ছাত্রছাত্রীদের উপবৃত্তির টিউশন ফি সাধারণ তাহবিলে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেন। হিসাব সহকারী ও ম্যানেজিং কমিটিকে কখনো এ বিষয়টি অবহিত করেননি তিনি। ১৯৯৬-২০১৩ইং সাল পর্যন্ত বিদ্যালয় থেকে যেসকল ছাত্রছাত্রী এসএসসি পরীক্ষায় পাশ করেছেন তাদের মূল সনদপত্র বাবদ  ৫০০/- টাকা করে গ্রহণ করেন।

বিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিলে জমা না দিয়ে তিনি লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেন। বিদ্যালয়ের দাতা সদস্য ছাত্রছাত্রীদের খেলাধুলার জন্য জুতা ক্রয়ের জন্য ১৫ হাজার টাকা অনুদান দেয়। জুতা না কিনে প্রধান শিক্ষক সে টাকা আত্মসাত করেন। বিদ্যালয়ের পুরাতন ঘর জরাজীর্ণ হলে তা ২৫ হাজার টাকা বিক্রি করে সেই টাকাও আত্মসাৎ করেন। ২০০৭ সালে প্রলংকারী সিডরে ক্ষতিগ্রস্থ শিক্ষার্থীদের এসএসসি ফলম ফিলাপের টাকা সরকার মওকুফ করে দিলেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়ে তা আত্মসাৎ করেন। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে এসএসসি ফি ব্যাংকে জমা না দিয়ে অবৈধভাবে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করান। ফলে শিক্ষার্থীদের ফলাফল প্রকাশিত হয়নি।

২০১৭ সালে স্কুলের ক্যাশ থেকে ৯৭ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন। ২০১৯ সালে এসএসএসি পরীক্ষার প্রবেশ পত্রের জন্য সহকারী শিক্ষিকার কাছে রক্ষিত ৭৭,১৫০/- টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করেন। সুমাইয়া আক্তার (৮ম শ্রেণী), অন্যান্য ছাত্রী ও শিক্ষিকাদের সাথে প্রায় সময় অশ্লীল আচরণ করেন। বিদ্যালয়ের দুই সহকারী শিক্ষকদের নামে মালামাল ক্রয় না করে ২০২০ সালে অলিক ভাউচার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রদান করেন। প্রধান শিক্ষক শিপুকে উক্ত আত্মসাৎকৃত টাকা নির্বাহী কমিটির সভাপতি বরাবর জমা দিতে নির্দেশ দেওয়ার পরও সাধারণ তহবিলে জমা না দিয়ে তিনি প্রতারণার আশ্রয় নেয়। দুর্নীতি দমন কমিশন ও পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উইং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর এবং পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষা মন্ত্রণালয় অভিযোগের ভিত্তিতে দীর্ঘদিন তদন্ত করে প্রধান শিক্ষক এইচ এম মইনুল হক শিপুর বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ, অনিয়ম, দুর্নীতি ও ছাত্রী-শিক্ষিকাদের সাথে অশ্লীল আচরণ করাসহ ১৯টি অভিযোগের সত্যতা প্রমান পেয়েছে।

তদন্ত করে এসব অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় প্রধান শিক্ষক এইচ এম মইনুল হক শিপুকে সাময়িক বরখাস্ত করে ম্যানেজিং কমিটি। পরে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থণের নোটিশ করা হয়। নোটিশ পেয়ে প্রধান শিক্ষক মইনুল হক শিপু আত্মপক্ষ সমর্থন করে পদত্যাক করেন। বর্তমানে দুর্নীতিবাজ প্রধান শিক্ষক মইনুল হক শিপু বরখাস্ত অবস্থায় রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানা গেছে।

এ ব্যাপারে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক (সাময়িক বহিস্কৃত) এইচ এম মইনুল হক শিপুর সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

‘নিজাম উদ্দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ এর ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মোঃ ইব্রাহিম মিয়া বলেন, এইচ এম মইনুল হক শিপু প্রধান শিক্ষকের ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন। তিনি আমাকে কিংবা ম্যানেজিং কমিটির কোন সদস্যদের পরামর্শ ছাড়া নিজের ইচ্ছা মতো এসব অনিয়ম করেছেন। আমরা তার এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কিছু বললেও কোন কর্ণপাত না করে তার খামখেয়ালী মতো প্রতিষ্ঠা চালাতো। কোন শিক্ষকদেরকে তিনি কোন ধরণের মূল্যায়ন করতে না। এইচ এম মইনুল হক শিপুর বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত হয়। সেই তদন্তে তার প্রত্যেকটা অনিয়ম, দুর্নীতি সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। তাই এইচ এম মইনুল হক শিপুকে বরখাস্ত করা হয়েছে। আমরা এই দুর্নীতিবাজ প্রধান শিক্ষক এইচ এম মইনুল হক শিপুর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করছি।

ভোলা সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ জিহাদ হাসান বলেন, প্রধান শিক্ষক এইচ এম মইনুল হক শিপুর বিরুদ্ধে অনেকগুলো দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগের ভিত্তিতে বরিশাল দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্তে নামে। তদন্ত রিপোর্টে প্রধান শিক্ষক এইচ এম মইনুল হক শিপুর বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ, দুর্নীতি ও অনিয়মসহ করা অভিযোগের সত্যতা প্রমানিত হয়। পরে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। পরবর্তীতে প্রধান শিক্ষক শিপু বাদী হয়ে আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। ম্যানেজিং কমিটিও শিপুর বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। উভয় মামলা চলমান রয়েছে। আদালত যে রায় দে সে অনুযায়ী শিক্ষা মন্ত্রণালয় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে।

LEAVE A REPLY