লেখকঃ আসিফ আলতাফ।সময়: ১৯৮৯, স্থান: ভোলা সদর
বড়মিঞা চলেন, দেইখা যান অবস্থাটা।
বড়মিঞা: কিরে নুরুল আমিন? হইসে কি?
বড়মিঞা আমার বাবা। সেদিন বসেছিলেন গদিঘরে (তার অফিস)। পাশের চেয়ারে আমি নিমকি আর মিষ্টি খাচ্ছি যা বাবা ঘোষ পট্টি থেকে আনিয়ে দিয়েছেন। বয়স আমার তখন দশ।
নুরুল আমিন কাকা আমাদের খামারের তত্ত্বাবধান করেন। আমার বাবাকে ভাই হিসেবেই ডাকেন। যখন কোনো ব্যাপারে তিনি আমার বাবার উপর অসন্তুষ্ট থাকেন তখন “বড়মিঞা” হিসেবে সম্বোধন করেন আজ নুরুল আমিন কাকা অসন্তুষ্ট।
নুরুল আমিন কাকা: এতদিন কইতেসি.. আমনেতো ফাও কামে ব্যস্ত থাকেন। লেকের মাছ প্রতিদিন দুইটা কইরা চুরি যায় কমপক্ষে। একেকটার সাইজ তিন কেজির তন সাড়ে চাইর কেজির কম হইতনা!
বাবা: হুম। কি করা যায়?
নুরুল আমিন কাকা: কি করা যায় মানে? এইডাতো ছোডোমোডো চোরের কাম না বা পোলাইনেও চুরি করেনা। “বাজপাখিটা” ফজরের টাইমে একবার আইয়ে আবার মাগরিবের আগ দিয়া লেকের ধারে এক্কারে নিয়ম মতন বইয়ে। ছোঁ মাইরা বিশাল মাছটি লইয়া যায়। আমার পরিশ্রমের ফসল। কিয়াত্তাম? আইজো ভোরে কমপক্ষে চাইর কেজির এক কালাবাউস লইয়া গেলো।
আমি উৎসুক দৃষ্টিতে শুনছি। কত্ত বড় পাখি হলে এই কাজ সম্ভব!
বাবা: হুম।
নুরুল আমিন কাকা: এই “হুম হুমই” আমনের ব্যবসা শ্যাষ করলো। এইডার সমাধান আইজ কাইলের মইধ্যেই করেন। বন্দুকটা লইয়া চলেন। এইডারে “শুট” করলেই ঝামেলাডা যায়। এলাকাডাও ডরে থাকে।
এবার আমার উৎসাহ আর ধরে রাখতে পারলামনা। চরম উত্তেজনায় আমি অপেক্ষায় আছি কখন শিকারে যাব তাদের সঙ্গে!
বাবা বল্লেন: কাইল সকালে চল, ফজরের সময়। বন্দুকটাকেও একটু অয়েলিং করতে হবে।
আমি আর ধৈর্য ধরতে পারলাম না। বল্লাম, বাবা আজই চল। মাগরিবের সময়। আজই.. কাল সকালে না প্লিজ।
নুরুল আমিন কাকা বল্লেন, হ আইজই লন। ভাইস্তাই ঠিক। আমনে খালি কাইল কাইল করেন। ভাইস্তারে দিয়াই হইবো, হের মইধ্যে একটা স্পিরিট আছে।
বাবা আমার সব কথাই রাখতেন। তিনি বল্লেন, আজই যাব। বন্দুক বের কর।
বাবা আর আমি এক রিক্সায়, নুরুল আমিন কাকা তার সাইকেলে। আমাদের সঙ্গে একটা ব্যাগের মধ্য দোনলা বন্দুক। আমি বল্লাম, বাবা আমরা যে একটা বন্দুক নিয়ে শিকারে যাচ্ছি এটাকি মানুষজন বুঝতে পারছে?
বাবা বল্লেন: কি ককরে বুঝতে পারবে? ওটাতো কাভার করা। তুমি বোঝাতে চাও?
আমি বল্লাম: হ্যা।
বাবা ব্যাগ থেকে বন্দুকটা বের করলেন। আমি চারপাশে দেখছি, কারা কারা আমায় দেখছে তা দেখার জন্য। আমিও বন্দুকটা ধরে থাকলাম। সত্যিই বেশকিছু মুখ আমার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে, আমার ডাঁটিয়াল ভাব কিছুটা বেড়ে গেল।
আমরা তিনজন ফার্মের রাস্তা ধরে হাটছি। বন্দুক আমার হাতে। মারাত্মক ভারী, তবু আমিই এটা বইতে চাই। হাটতে হাটতে আমরা লেকের পাড়ে চলে আসলাম।
বাবা বল্লেন, দেখ্ নুরুল আমিন পাখিটা কোন দিকে আছে। আমরা বসি। ডাব আনা।
আমি বল্লাম, বাবা আমরাও খুঁজি চল।
বাবা বল্লেন, ও আগে দেখুক পাখিটার বাসাটা কই। আমরা এদিকটা খুঁজি।
আমি বল্লাম, বাবা পাখিটা কোত্থেকে আসলো?
আমরা লেকের ধারে বসলাম।
বাবা বল্লেন, এটা একটা রেয়ার প্রজাতির পাখি। ইংরেজি নাম হচ্ছে “Fish Hawk”. খুব কম ওদের দেখা যায়। খুব যত্নে দুটো পাখি মিলে বাসা বানায়। বসন্তে ডিম পাড়ে। ডিম থেকে বাচ্চা হয়। মা পাখি বাচ্চাদের বড় করে, খাবারের ব্যবস্থা করে। নিশ্চই এটারও বাচ্চা আছে।
আমি বল্লাম, এখানে কেন আসলো পাখিটা।
বাবা বল্লেন, সেইফ একটা জায়গার খোঁজে। এখানে ওর মনে হয়েছে কেউ ওকে মারবেনা। বাচ্চাগুলোকে বড় করতে পারবে নিশ্চিন্তে। খাবারের সমস্যাও হবেনা। এখন বুঝুক মজা। আমরাতো এটাকে মেরেই ফেলবো। বাচ্চাগুলো না খেতে পেয়েই মরে যাবে। আর মাছ চুরি হবার টেনশন নেই। লেকের এপাড় থেকে বাবা জোরে ডাক দিলেন, কিরে নুরুল আমিন, দেখা পাইলি বাজ পাখির?
নুরু আমিন কাকা ওপাড় থেকে বল্লেন, না। আরেকটু পর ঠিক টাইম মতন আইয়া পরবো। পশ্চিমের বড় সৃষ্টি গাছে বাসা বানছে। এহন ঐ গাছে নাই। আইয়া পরবো একটু ধৈর্য ধরেন।
বাবা আর আমি ডাব খাচ্ছি। বাবা বল্লেন, যাক ভালোই হয়েছে। বাসাটার সন্ধানটাও পাওয়া গেল। এক্ষুনি নিশ্চই ও মাছ ধরতে এখানে আসবে, বাচ্চাগুলোকে খাওয়াতে।
আমি বল্লাম, বাবা পাখিটাতো আর ওর বাসায় ফিরবেনা, বাচ্চাগুলোকি অপেক্ষায় থাকবে? আমরা খাবার দিয়ে আসতে পারিনা?
বাবা ডাব খেতে খেতে হোহো করে হেসে উঠলেন, বল্লেন, আমরা কেন খাবার দিয়ে আসবো? আর আমরা দিলেই ওরা খাবে? হাহাহাহা..
হঠাৎ করে দেখলাম বিশাল দেহী, ছাই বর্নের কালো ঠোঁটের বাজপাখিটা আমাদের সামনের নারকেল গাছটার উপর এসে বসলো। এত্ত বড় পাখি আমি আমার জীবনেও দেখিনি! ওপাড় থেকে নুরুল আমিন কাকা ইশারায় চুপ থাকার জন্য ইঙ্গিত করছে।
বাবা ফিসফিস করে বল্লেন, চুপ। একেবারে চুপ। শব্দ পেলে ও বুঝেযাবে আমাদের হাতে বন্দুক।
বাবা খুব সাবধানে আমার হাত থেকে বন্দুক নিলেন। আস্তে আস্তে একটু সামনে হেটেগিয়ে বন্দুকের নল তাঁক করলেন হয়ত ঠিক পাখিটার বুকে।আমি ফিসফিস করে ডাকলাম, বাবা বাবা..বাবা বল্লেন, ডোন্ট ডিস্টার্ব, ডোন্ট টক।
আমি বল্লাম, বাবা প্লিজ পাখিটাকে মেরোনা।
আমি একবার মানা করাতেই বাবা ফিরলেন আমার দিকে। বল্লেন, আমি জানতাম তুমি এটাই বলবে। চল, বসা যাক। আমরা পাখিটার মাছ ধরা দেখি।লেকের ওপাড় থেকে নুরুল আমিন কাকা কপাল কুঁচকে হাসছে। আমরাও হাসছি।
তিনজন মিলে সন্ধের পর গদিঘরে ফিরে আসলাম। আমি আবারো নিমকি, মিষ্টি খেতে চাই। বাবাকে বল্লাম, বাবা কখনো আমি বন্দুক দিয়ে গুলি ছুড়তে দেখিনি, গদি ঘরের পেছনে খালপাড়ে আকাশের দিকে একটা ফাঁকা গুলি করে আমায় দেখাবে?বাবা বল্লেন, নিশ্চই.. তবে।আমি বল্লাম, তবে কি?
বাবা বল্লেন, এটারতো গুলি নেই। কখনো এটার গুলি কেনার প্রয়োজন হয়নি।
আমি থ খেয়ে গেলাম! গুলি ছাড়াই আমরা গিয়েছিলাম পাখিটাকে মারতে!
বি: দ্র: উত্তরাধিকারসূত্রে সেই বন্দুকটির মালিক আজ আমি। আজ পর্যন্ত আমারো ওটা দিয়ে গুলি ছোড়া হয়নি। তবে পরম যত্নে রেখে দিয়েছি, ভবিষ্যতে যেন আমার সন্তানদের নিয়ে হুবহু সেইরকম একটা শিকারে যেতে পারি।