ভোলা নিউজ ২৪ ডটনেট : রাখাইনে রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান দ্বিগুণ করেছে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। ফলে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশমুখী স্রোত ফের বেড়েছে। জাতিসংঘের আশঙ্কা, রাখাইনের সব রোহিঙ্গাই বাংলাদেশে চলে আসবে। ফলে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা হবে প্রায় ১২ লাখ। এদের থাকা-খাওয়া ও চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে আগামী ছয় মাসের জন্য সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা সাহায্যের আবেদন জানিয়েছে ত্রাণ সংস্থাগুলো। এদিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, রাখাইনে একটি গ্রামে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে নির্মমভাবে হত্যার প্রমাণ পেয়েছে তারা। খবর এএফপি ও রয়টার্সের।
রোহিঙ্গাবিরোধী তাণ্ডব জোরদার : মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ঘোষণা দিলেও রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীরা বলছেন, দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী অভিযান দ্বিগুণ করেছে। তারা চাচ্ছে, যেসব রোহিঙ্গা এখনও রাখাইনে আছে, তারাও যেন পালিয়ে আসে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বলছেন, বহু গ্রামে এখন একজন মানুষও নেই। হাজার হাজার লোক বাংলাদেশের দিকে ছুটছে।
এএফপি জানায়, বাংলাদেশে চার সপ্তাহে প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয়ার পর কয়েক দিন ঢল কিছুটা থেমেছিল। তবে গত কয়েকদিনে তা ফের বেড়েছে। এখন প্রতিদিন ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বলছেন, পশ্চিম রাখাইনে এখনও যেসব রোহিঙ্গা আছে, তাদেরও দেশছাড়া করতে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ফের তাণ্ডব শুরু করেছে।
মংডুর বাসিন্দা রাশিদা বেগম বলেন, ‘স্থানীয়রা আমাদের কয়েক সপ্তাহে ধরে বলেছিল যে আমরা সেখানে থাকলে তারা নিরাপত্তা দেবে। কিন্তু এরপর আর্মি এসে ঘরে ঘরে তল্লাশি শুরু করে। তারা আমাদের চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়।’ তিনি বলেন, ‘স্থানীয়রা আশ্বাস দিয়েছিল, তারা আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের ঘর থেকে বের করার পর বাড়িতে আগুন দেয়।’
হাসিনা খাতুন নামের আরেক নারী বলেন, ‘আমি গ্রামেই থাকতে চেয়েছিলাম। স্থানীয়রা আমাদের বলেছিল, বাংলাদেশে যেও না। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আমরা তাদের বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু কোনো উন্নতি হয়নি। শেষ পর্যন্ত আমাদের চলে আসতে হল।’
সাহায্যের আবেদন ত্রাণ সংস্থাগুলোর : বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা ত্রাণ সংস্থাগুলো আগামী ছয় মাসের জন্য ৪৩৪ মিলিয়ন ডলার (৩ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা) সহায়তার আবেদন জানিয়েছে। প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার জন্য এ সাহায্য চাওয়া হয়েছে। তাদের অনেকেই শিশু। জাতিসংঘের হিসাবে বাংলাদেশে এ মুহূর্তে ৮ লাখ ৯ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে। তবে অনেকের মতে, এ সংখ্যা ১০ লাখের বেশি।
২৫ আগস্টের পর রাখাইনে সামরিক বাহিনীর নিধনযজ্ঞ থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে ৫ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। এর আগ থেকেই বাংলাদেশে ৪ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছিল। আগামী ৬ মাসে আরও ৩ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছে জাতিসংঘ। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে মোট রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়াবে ১২ লাখ।
জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী রবার্ট ওয়াকিনস বলেন, ‘কক্সবাজারে থাকা রোহিঙ্গারা খুবই নাজুক অবস্থায় আছে। তাদের অনেকেই এখন বিভীষিকা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাদের বসবাসও করতে হচ্ছে অনেক মানবেতর পরিস্থিতিতে।
বাংলাদেশ এ বিশালসংখ্যক রোহিঙ্গাকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে জাতিসংঘ, ইউনিসেফসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। রোহিঙ্গাদের ওপর এ নির্যাতনকে জাতিগত নিধনযজ্ঞের ‘পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ’ হিসেবে উল্লেখ করেছে জাতিসংঘ।
ওয়াটকিনস বলেন, আমাদের লক্ষ্য ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে সাহায্যের জন্য প্রস্তুত থাকা। কারণ এরই মধ্যে ৮ লাখের বেশি অবস্থান করছে।’ তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের জীবন বাঁচাতে ব্যাপক তৎপরতা দরকার। অবিলম্বে পর্যাপ্ত পানি ও পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা না হলে রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়বে।
এক গ্রামের বহু রোহিঙ্গা খুন -এইচআরডব্লিউ : মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সে দেশের সেনাবাহিনীর যৌন নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ডের নতুন আলামত হাজির করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য এবং স্যাটেলাইটে ধারণকৃত চিত্র বিশ্লেষণ করে তারা বলছে, রাখাইনের মং নু গ্রামে ২৭ আগস্ট সংঘটিত হত্যা ও যৌন নিপীড়নের ঘটনা মিয়ানমারের সামগ্রিক মানবতাবিরোধী অপরাধের চিত্র হাজির করছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে জানায়, ২৭ আগস্ট সেনাবাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে নিরাপত্তার জন্য একটি আবাসিক কম্পাউন্ডে আশ্রয় নেয়া গ্রামবাসীদের পিটিয়ে, যৌন নিপীড়ন চালিয়ে, ছুরিকাঘাত ও গুলি করে হত্যা করেছে মিয়ানমারের সেনারা। সেনাবাহিনী ঠিক কতজন গ্রামবাসীকে হত্যা করেছে, তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। তবে স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, মং নু এবং পার্শ্ববর্তী হপং তো পিন গ্রামগুলো প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে।
মং নু এবং আশপাশের গ্রামে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নিপীড়ন থেকে বেঁচে গেছে এবং ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে- এমন ১৪ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছে এইচআরডব্লিউ। ওইসব প্রত্যক্ষদর্শী এখন বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তারা জানায়, নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর সেনাবাহিনী পাল্টা জবাব দেবে বলে তারা আগেই আশঙ্কা করেছিল। সেই আশঙ্কা থেকে শত শত মানুষ মং নু গ্রামের একটি আবাসিক কম্পাউন্ডে আশ্রয় নিয়েছিল। ২৭ আগস্ট মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কম্পাউন্ডের চারপাশ ঘেরাও করে ফেলে এবং বেশ কয়েকজন সেনা সদস্য কম্পাউন্ডের ভেতরে প্রবেশ করে। তারা বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা পুরুষ ও বালককে আঙিনায় ডেকে নিয়ে আসে এবং ছুরিকাঘাত ও গুলি করে হত্যা করে। পালানোর চেষ্টার সময় অন্যদেরও হত্যা করা হয়। পরে সেনা সদস্যরা মৃতদেহগুলো সামরিক ট্রাকে করে দূরে নিয়ে যায়। কোনো কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর দাবি, এ ট্রাকগুলোয় শত শত মৃতদেহ ছিল।
এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনে বলা হয়, মং নুর ওই কম্পাউন্ডে মিয়ানমার সেনাবাহিনী নারীদের ওপর যৌন নিপীড়ন চালিয়েছে। খোতিয়াজ নামের ২৮ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা নারী জানান, বড় ভবনের আড়ালে লুকিয়ে থাকার পরও নারীরা রেহাই পায়নি। ভবনের ভেতরে লুকিয়ে থাকার কথা জানিয়ে খোতিয়াজ বলেন, ‘তারা কক্ষে প্রবেশ করে এবং কয়েকজন নারীকে নগ্ন করে ফেলে। আমার কাছে যা ছিল সবই তারা ছিনিয়ে নেয়। তারা আমার শরীরের প্রতিটি জায়গায় স্পর্শ করতে লাগল এবং কাপড় খুলে ফেলার চেষ্টা করেছিল।’ ৩০ বছর বয়সী আরেক রোহিঙ্গা নারী অভিযোগ করেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের কাছে অর্থ ও অন্য মূল্যবান জিনিসপত্র আছে কিনা, তা খুঁজছিল। তিনি বলেন, ‘এক সেনা সদস্য আমার বুকে হাত ঢুকিয়ে সেখান থেকে সেলফেন ও টাকা বের করে নিয়ে এলো। তারপর সে আমার থামের (রোহিঙ্গা নারীদের বিশেষ পোশাক) নিচের অংশ খুলে ফেলল। সেখানে কিছু স্বর্ণ ও টাকা ছিল। সেগুলোও নিয়ে নিল। তারপর সে আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় স্পর্শ করতে লাগল।’
এইচআরডব্লিউর এশিয়াবিষয়ক উপপরিচালক ফিল রবার্টসন মনে করেন, ‘মং নু গ্রামে সেনাবাহিনীর তাণ্ডব মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধের সামগ্রিক চিত্র হাজির করেছে।’
ব্রিটেনে ১৩ সংস্থার ত্রাণ তৎপরতা : পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর লাখ লাখ মানুষের কাছে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে তহবিল সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে যুক্তরাজ্যের ডিজেস্টারস ইমার্জেন্সি কমিটি (ডিইসি)। যুক্তরাজ্যের ১৩টি শীর্ষস্থানীয় ত্রাণ সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত এ কমিটি ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে মানবিক সহায়তার আবেদন জানিয়েছে।
বিবিসি জানায়, ডিইসির সদস্য সংস্থাগুলো আগে থেকেই বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য জরুরি সহায়তা দিচ্ছে। তারা জানিয়েছে, সহায়তার অপেক্ষায় থাকা সব মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার জন্য তাদের আরও তহবিল প্রয়োজন।
ডিইসির প্রধান নির্বাহী সালেহ সাঈদ বলেন, ‘পরিবারগুলো অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্র কিংবা রাস্তার পাশে থাকছে, তাদের জন্য বিশুদ্ধ পানি নেই, টয়লেট নেই, ধোয়ামোছার সুবিধা নেই।’ বিবিসি জানায়, যুক্তরাজ্যের বড় বড় টেলিভিশন স্টেশনগুলোয় ডিইসির ক্যাম্পেইন ভিডিও প্রচার করা হবে।
রোহিঙ্গা নিপীড়ন প্রশ্নে শুরু থেকেই মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সরব অবস্থান নিয়েছে যুক্তরাজ্য। সেপ্টেম্বরে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, রাখাইনে সহিংসতা ওই দেশের মর্যাদার জন্য একটি কালো দাগ। পরে দেড় শতাধিক ব্রিটিশ এমপির আহ্বানে সাড়া দিয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দেয়া ভাষণে মিয়ানমারের সেনাদের প্রশিক্ষণ স্থগিতের ঘোষণা দেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে। এছাড়া নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা ইস্যুতে অনুষ্ঠিত তিনটি আলোচনাতেই যুক্তরাজ্য ছিল উদ্যোক্তার ভূমিকায়।