বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডের এই ত্রিদেশীয় সিরিজকে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ-প্রস্তুতি হিসেবেই ধরা হচ্ছিল। সেই প্রস্তুতিটা দারুণভাবেই সারলেন মাশরাফিরা। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বহুজাতিক কোনো টুর্নামেন্টের শিরোপা জেতার জন্য এর চেয়ে ভালো সময় বোধ হয় আর হতো না। কিন্তু শিরোপা ছাড়াও আয়ারল্যান্ড থেকে আরও কিছু প্রাপ্তি আছে বাংলাদেশের। শিরোপার মতো কিছু না হলেও এই প্রাপ্তিগুলো ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য ভালো কিছুই এনে দিতে পারে…
সৌম্য সরকারের ধারাবাহিকতা
ঘরোয়া, আন্তর্জাতিক মিলিয়ে সৌম্যর সবশেষ পাঁচটি ইনিংস—১০৬, ২০৮*, ৭৩, ৫৪ ও ৬৬। ক্যারিয়ারে এই প্রথমবারের মতো টানা পাঁচটি পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস খেললেন তিনি। একজন ব্যাটসম্যানের দুর্দান্ত ছন্দে থাকা বুঝি একেই বলে। টগবগে আত্মবিশ্বাস নিয়ে উইকেটে যাচ্ছেন, দলকে দারুণ শুরু এনে দিচ্ছেন। সৌম্য যেন ফিরিয়ে আনছেন ২০১৫ সালকে। সোনার ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো সেই বছরটা কেটেছিল তাঁর। ২০১৫ বিশ্বকাপে ভালো খেললেন। দেশে পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ রাঙালেন। ওয়ানডেতে তামিম ইকবালের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রান করলেন। মাঝে অনেক দিন নিজেকে বারবার হারিয়ে ফেলছিলেন তিনি। বিশ্বকাপকে সামনে রেখে আবারও যেন স্বরূপে ফিরেছেন সৌম্য। আর বিশ্বকাপের আগে এমন ধারাবাহিক সৌম্যকেই তো চাচ্ছিল বাংলাদেশ! এই ফর্মটা বিশ্বকাপে ধরে রাখতে পারলেই তো কেল্লা ফতে!
মোসাদ্দেকের ফেরা
জাতীয় দলে মোসাদ্দেকের শুরুটা ছিল দারুণ আশাজাগানিয়া। ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর ফিনিশিং দুর্দান্ত হলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কেন যেন মিইয়ে যাচ্ছিলেন। মোসাদ্দেক এই সিরিজে দেখিয়ে দিয়েছেন ঘরোয়া ক্রিকেটের পারফরম্যান্সটা তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও অনূদিত করতে পারেন। অফ স্পিন বোলিংটা কার্যকর। সে কারণে ফাইনালে সাকিবের জায়গায় দলে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু তিনি ব্যাট হাতে ম্যাচ উইনার হয়ে আশাবাদী করে তুললেন সবাইকে। মোসাদ্দেকের আত্মবিশ্বাসী ফিরে আসাটাও এই সিরিজের বড় প্রাপ্তি। মাঝে চোখের সমস্যার জন্য বেশ ভুগেছিলেন এই তরুণ তারকা। আস্তে আস্তে সে সমস্যা কাটিয়ে নির্বাচকদের দেখিয়ে দিচ্ছেন, দলে জায়গাটা স্থায়ী করতে পুরোপুরি প্রস্তুত তিনি।
ব্যাটিংয়ে পেশাদারি ধারাবাহিকতা
ত্রিদেশীয় সিরিজের প্রতিটি ম্যাচেই চূড়ান্ত ধারাবাহিকতা দেখিয়েছেন ব্যাটসম্যানরা। একটি ম্যাচেও প্রথমে ব্যাটিং না করলেও রান তাড়া করার সময় তামিম-সৌম্য-সাকিব-মুশফিকদের পারফরম্যান্স ছিল দারুণ পেশাদারি। বাংলাদেশ দল নিয়ে ‘চাপের মুখে ভেঙে পড়া’র তত্ত্ব খুব জনপ্রিয়। রান তাড়া করায় এমনিতেই চাপ থাকে। আড়াই শ ছুঁই ছুঁই কিংবা তার ওপাশে রান তাড়া করতে নেমে বাংলাদেশের ব্যাটিং অর্ডার বহুবার ‘তাসের ঘর’-এর মতো ভেঙে পড়েছে। কিন্তু ত্রিদেশীয় সিরিজে দেখা গেল নতুন কিছু, আড়াই শর এপাশে কিংবা ওপাশের রান তাড়া করতে দলকে তেমন একটা বেগ পেতে হচ্ছে না। বিশ্বকাপের আগ দিয়ে ব্যাটসম্যানদের কাছ থেকে এমন পেশাদারিই তো চাচ্ছিল বাংলাদেশ দল।
ওপেনিংয়ে ‘মধুর সমস্যা’
তামিম ইকবালের স্থান পাকা বাংলাদেশের ওপেনিং ব্যাটিংয়ে। কিন্তু বিশ্বকাপে তাঁর সঙ্গী হবেন কে? সৌম্য সরকার, নাকি লিটন দাস? আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজে প্রতিটি ম্যাচেই সফল হয়েছেন ওপেনাররা। সৌম্য তো ভালো খেলেছেনই, একটি ম্যাচে সুযোগ পেয়ে লিটনের পারফরম্যান্সও ছিল দুর্দান্ত। সৌম্য-লিটনের ফর্ম দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে চোখজুড়ানো দৃশ্য। বাংলাদেশের ওপেনিং জুটি তো একসময় নিয়মিতই দুঃস্বপ্ন উপহার দিত ক্রিকেটপ্রেমীদের। এখন সেটির পরিবর্তন হয়েছে অনেকটাই। তবে যে খুব পাল্টে গেছে, সে কথাও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে সিরিজেই ভুগেছে ওপেনিং জুটি। কিন্তু ত্রিদেশীয় সিরিজে দেখা যাচ্ছে অন্য দৃশ্য। সৌম্য-তামিম প্রথম ম্যাচে গড়লেন ১৪৪ রানের জুটি। ওয়ানডেতে প্রতিপক্ষের মাটিতে এটা ছিল বাংলাদেশের ওপেনিং জুটির সর্বোচ্চ সংগ্রহ। পরের ম্যাচেও পঞ্চাশোর্ধ্ব রানের জুটি গড়েছিলেন দুজন। আর তার পরের ম্যাচে সৌম্যর জায়গায় লিটন এসেও ধরে রাখলেন ধারাবাহিকতা। তামিম ও লিটন মিলে সে ম্যাচে গড়লেন ১১৭ রানের জুটি। ফাইনালে সৌম্যর ব্যাট জ্বলে উঠেছে আবারও। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপে ওপেনিং জুটি নির্বাচন করতে গিয়ে এক মধুর সমস্যায় পড়তে হচ্ছে টিম ম্যানেজমেন্টকে!