৭০ কেজি বেওয়ারিশ সোনা!

0
465

ভোলা নিউজ ২৪ ডট নেটঃ বিয়েশাদির মতো উৎসব বা জাঁকালো অনুষ্ঠানে সোনার গয়না লাগেই। মূল্যবান ধাতু বলে সোনা নিয়ে নানা কেলেঙ্কারি বা অপরাধমূলক ঘটনাও কম ঘটছে না। সোনার গয়না ছিনিয়ে নিতে ডাকাতি, ছিনতাই বা চুরির ঘটনা অহরহ ঘটছে।

কিন্তু সোনা নিয়ে সব হিসাব-কিতাব যেন উল্টে যায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। উড়োজাহাজের শৌচাগারের বেসিন, কমোড বা যাত্রীদের আসনের নিচে থেকে সোনার বার উদ্ধারের ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। আবার বিমানবন্দরের বোর্ডিং ব্রিজের শৌচাগার, ময়লার ঝুড়ি, ট্রলির নিচে বা কার্গো গুদামে পড়ে থাকা কাপড়ের বোঁচকায় পাওয়া গেছে সোনার বিভিন্ন চালান।

এ বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এই বিমানবন্দরের ‘পরিত্যক্ত’ অবস্থায় প্রায় ৭০ কেজি সোনা উদ্ধার করেছে শুল্ক বিভাগ এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এর বাজার মূল্য ৩৫ কোটি টাকা।

শুল্ক গোয়েন্দা ও ঢাকা কাস্টম হাউসের তথ্য অনুযায়ী, আলাদা ১৫টি চালানে এই ৭০ কেজি সোনা শাহজালাল বিমানবন্দরে এসেছিল। কোটি কোটি টাকার এসব পরিত্যক্ত সোনার দাবিদার পাওয়া যায়নি। মালিকের সন্ধানও মেলেনি এখনো। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে পাচারকারীরা ধরাও পড়ছে না।

সোনার এসব চালান কিন্তু সবার চোখে ধরা পড়ে না। প্রতিটি সোনার বারের ওজন ১০০ গ্রাম থেকে ১১৬ গ্রামের মতো। কখনো কালো, কখনো সাদা, কখনো হলুদ বা বাদামি রঙের স্কচটেপে জড়িয়ে ছোট ছোট প্যাকেটে করে আনা হয়। কিন্তু স্কচটেপের রং যা-ই থাকুক না কেন, প্যাকেটগুলোর আকৃতি একই।

খুব বড় চালান উদ্ধারের ঘটনা এ বছর ঘটেনি। সাত কেজি ওজনের চারটি চালান ধরা পড়েছে। ২৪ জানুয়ারি ওমানের মাসকট থেকে আসা রিজেন্ট এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজের শৌচাগার থেকে কালো স্কচটেপে মোড়ানো তিনটি প্যাকেটের মধ্য থেকে সোনার ৬০টি বার উদ্ধার করা হয়। এর মোট ওজন ৬ কেজি ৯৬০ গ্রাম। এর মূল্য প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২৬ মার্চ সাত কেজি সোনার চালান আটক করেন শুল্ক গোয়েন্দারা।

এরপর ১ মে দেশের আরেকটি বেসরকারি বিমান সংস্থা ইউএস বাংলার একটি উড়োজাহাজ থেকে প্রায় সাত কেজি সোনা পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করেন ঢাকা কাস্টম হাউসের কর্মকর্তারা।

কলকাতা থেকে আসা ওই উড়োজাহাজের ৯বি নম্বর আসনের নিচে একটি ব্যাগের ভেতর সোনার ৬০টি বার পাওয়া যায়। ব্যাগটিতে হলুদ রঙের স্কচটেপে মোড়ানো ছয়টি বান্ডিল পাওয়া যায়। প্রতিটি বান্ডিলে ১০টি করে মোট ৬০টি সোনার বার ছিল। প্রতিটি বারের ওজন ১১৬ গ্রাম করে। সব মিলিয়ে উদ্ধার হওয়া সোনার ওজন ৬ কেজি ৯৬০ গ্রাম।

কাস্টম হাউস সূত্রে জানায়, ইউএস বাংলার এই উড়োজাহাজ সিঙ্গাপুর থেকে ঘটনার দিন সকালে ঢাকায় আসে। ওই উড়োজাহাজে কলকাতাগামী কয়েকজন ট্রানজিট যাত্রী ছিলেন। তাঁদের নিয়ে এর পরপরই উড়োজাহাজটি কলকাতায় চলে যায়। কলকাতা থেকে ফিরতি ফ্লাইট ওই দিন বিকেল চারটার দিকে ঢাকায় ফিরে আসে।

সাত কেজি সোনার চালান পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধারের ঘটনা ঘটে ৮ অক্টোবর। সেদিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে বিমানবন্দরের এয়ার ফ্রেইড এলাকা থেকে কাপড়ের রোলের ভেতর থাকা সাত কেজি সোনার চালানটি জব্দ করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।

শুল্ক গোয়েন্দাদের দাবি, ওই দিন রাত পৌনে ১০টার দিকে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের এস কিউ ৪৪৬ নম্বর ফ্লাইটে করে সোনার চালানটি আসে। এবার অবশ্য এক কেজি ওজনের সাতটি সোনার বার পাওয়া যায়। কালো কাপড়ের একটি রোলের ভেতর সোনার বারগুলো পাওয়া যায়।

অন্যদিকে ১৮ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুর থেকে আসা ইউএস বাংলার উড়োজাহাজ থেকে সাড়ে চার কেজি এবং ১১ অক্টোবর মাসকট থেকে ইউএস বাংলার একটি উড়োজাহাজের সিটের নিচ থেকে চার কেজি সোনা জব্দ করা হয়।

৫ জুলাই শাহজালাল বিমানবন্দরে এক নম্বর বোর্ডিং ব্রিজের শৌচাগারে ময়লার ঝুড়ি থেকে ২ কেজি ৮০০ গ্রাম সোনা উদ্ধার করে ঢাকা কাস্টম হাউসের প্রিভেনটিভ টিম।

২৭ ফেব্রুয়ারি শাহজালাল বিমানবন্দরের স্ক্যানিংয়ের পাশে একটি ট্রলির ওপর লাগেজে কালো কার্বন কাগজে প্যাঁচানো অবস্থায় ৯০০ গ্রাম সোনা উদ্ধার করে ঢাকা কাস্টমস হাউসের বিমানবন্দর টিম। শুল্ক কর্মকর্তাদের ধারণা, লাগেজটি স্ক্যানিংয়ের কথা জানতে পেরে পাচারকারী পালিয়ে যায়।

২৮ আগস্ট ফ্লাই দুবাইয়ে উড়োজাহাজের আসনের নিচে আড়াই কেজি, ১৪ জুন সাড়ে চার কেজি, ২৩ জুন বাংলাদেশ বিমানের উড়োজাহাজ থেকে সাড়ে তিন কেজি, ২০ সেপ্টেম্বর পৌনে পাঁচ কেজি, ৬ জুলাই ছয় কেজি, ২৮ জুলাই আড়াই কেজি, ২৯ জুলাই ১১৬ গ্রাম সোনার পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়।

ধরা পড়ার ভয়ে ‘পরিত্যক্ত’
ধরার পড়ার ভয়, ফৌজদারি মামলার ঝক্কি-ঝামেলা ও গডফাদারদের সবুজ সংকেত না পাওয়াতেই পাচারকারীরা বিমানবন্দরে সোনার চালান ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। এমন তথ্য জানান প্রায় ১০০টি সোনার চালান আটক করেছেন—এমন একজন শুল্ক কর্মকর্তা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, অনেক সময় আসামি ধরা পড়লেও শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তারই সোনার চালান ফেলে রেখে চলে যেতে বলেন। কারণ, মামলা হলে আসামির ঝক্কি-ঝামেলা তো আছেই। সেই সঙ্গে যিনি চালানটি জব্দ করেছেন, সেই শুল্ক কর্মকর্তাকেই বাদী হয়ে থানায় ফৌজদারি মামলা করতে হয়। মামলার দিন হাজিরার ঝামেলা তিনি পোহাতে চান না। আসামি জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়। তবে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা লিখে দেন, ‘আসামি কাস্টম কর্তৃপক্ষই আটক করেছে। তাই তারাই প্রমাণ করবে কে দোষী, কে নির্দোষ।’ তদন্ত শেষে সব মামলার জবাব একই আসে।

প্যাকেট থেকে বের করা হচ্ছে সোনার বার। ছবি: ঢাকা কাস্টসম হাউস

ওই শুল্ক কর্মকর্তা বলেন, যাঁরা উড়োজাহাজের আসনের নিচে রেখে বা শৌচাগারে রেখে সোনার চালান দেশে নিয়ে আসেন, তাঁদের সঙ্গে বড় সিন্ডিকেট জড়িত। এঁদের মধ্যে রয়েছেন সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইনস বা বিমান সংস্থার গ্রাউন্ড সার্ভিসের কর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, কেবিন ক্রুরা। ২০১৪ সালের ২৬ এপ্রিল ১০৬ কেজি সোনার পাচারের সঙ্গে মো. আনিস উদ্দিন ভূঁইয়া নামের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি বাংলাদেশ বিমানের মেকানিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন। সোনার চালানটি কীভাবে বিমানবন্দর থেকে বাইরে নেওয়া হবে, সেই নির্দেশনা আনিসকে দুবাই থেকে মোবাইল ফোনে বার্তা দিয়ে জানানো হচ্ছিল। মোবাইল ফোন বার্তায় তাঁকে বলা হচ্ছিল, ‘মামা, গাড়ি কখন গ্যারেজে পাঠানো হবে?’ পাচারকারীদের কাছে ‘গাড়ি’র অর্থ ‘উড়োজাহাজ’ আর ‘গ্যারেজ’ হলো ‘বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গার’।

কর্মকর্তা বলেন, মধ্যপ্রাচ্য বা মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর থেকে আসা ফ্লাইটগুলো চট্টগ্রাম বা সিলেটে এসে অভ্যন্তরীণ আকাশপথের যাত্রী ঢাকায় নিয়ে আসে। ঢাকায় আসার পথে উড়োজাহাজের ভেতর আন্তর্জাতিক রুটের যাত্রীদের সঙ্গে পাচারের লেনদেন হয়ে থাকে। এভাবে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে যাত্রী নেওয়া বন্ধ করা গেলে সোনার পাচার কমে যাবে।

জেল-জরিমানা না হওয়ায় পাচার বন্ধ হয় না
সোনার চালানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা একটি চক্র। শাহজালাল বিমানবন্দরের একটি শ্রেণি এর সঙ্গে কাজ করে থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা শুল্ক কর্তৃপক্ষের অভিযানের কথা আগাম তারাই জানিয়ে দেয়। তাই পাচারকারী ধরা পড়ার ভয়ে সোনার চালান ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। এ কথা জানান শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খান। তিনি বলেন, ‘গত চার বছরে দুই হাজার কেজি সোনা আটক করা হয়েছে, যার মূল্য এক হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে শুল্ক গোয়েন্দারা আটক করেছেন ১ হাজার ৬০০ কেজি সোনা। এসব সোনা পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে আমরা প্রায় ২০০ আসামি গ্রেপ্তার করেছি। আমাদের তৎপরতার কারণে পাচার কমে এসেছে। তবে একটি চক্র এখনো সক্রিয় আছে। আমরা আর্থিক জরিমানা আদায় করছি। উদ্ধার করা সোনা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হচ্ছে। কেউ ধরা পড়লে সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। সম্প্রতি বেশ কিছু মামলার আসামিদের সাজা হচ্ছে। তবে তারা বাহক। সোনা পাচারের নেপথ্য নায়কদের মধ্যে কারও সাজা দৃশ্যমান হলে এ ধরনের অপরাধ কমে আসত।’

রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা বাংলাদেশ বিমান, বেসরকারি বিমান সংস্থা রিজেন্ট এয়ারওয়েজ ও ইউএস বাংলায় সোনা পাচারের ঘটনা ঘটছে উল্লেখ করে মইনুল খান বলেন, ‘আগে বাংলাদেশ বিমানের উড়োজাহাজে সোনার পাচারের ঘটনা বেশি ঘটত। বর্তমানে বিমানকে ছাড়িয়ে গেছে রিজেন্ট। আমরা তাদের সঙ্গে বসব। উত্তরটা তারা দেবে—সোনার চালান কেন তাদের ফ্লাইটে করে আসছে।’

LEAVE A REPLY