ভোলা নিউজ ২৪ডট নেট:৫ নভেম্বর ঘড়ি, কম্পিউটারের সময় এক ঘণ্টা কমিয়ে নিন। রাত দুইটা বাজলে একে একটায় পরিণত করুন। আমেরিকায় সূর্যালোককে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে প্রতিবছর ১২ মার্চ সময় এক ঘণ্টা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। আর ৫ নভেম্বর রাত দুইটার সময় এক ঘণ্টা কমিয়ে একটা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ৫ নভেম্বর এক ঘণ্টা কমিয়ে দেওয়া হবে।
শুধু আমেরিকা নয়, উত্তর আমেরিকা অঞ্চল, ইউরোপের সব দেশেই দিবালোক সংরক্ষণে ঘড়ির কাঁটার এ অদলবদল করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশেও এ পন্থা অবলম্বন করা হয়। সব মিলিয়ে বিশ্বের প্রায় ৭০টি দেশে দিবালোক সংরক্ষণের উদ্যোগ প্রচলিত। তবে এশিয়া ও আফ্রিকার কোনো দেশেই এটি প্রচলিত নয়। আর দক্ষিণ আমেরিকায় বিষুবরেখার কাছাকাছি থাকা দেশগুলো এটি অনুসরণ না করলেও প্যারাগুয়ে ও ব্রাজিল এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। বছরের দুই সময়ে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। একটি শীতকালে, যখন দিনের দৈর্ঘ্য ছোট হয়ে আসে। বছরের এ সময় ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা কমিয়ে দেওয়া হয়। আর গ্রীষ্মের সময় ঠিক উল্টোভাবে এগিয়ে দেওয়া হয় এক ঘণ্টা। মূলত প্রাকৃতিক আলোর আরও কার্যকর সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতেই এ পন্থা অনুসরণ করা হয়।
চলতি বছর সূর্যালোক সংরক্ষণের এ উদ্যোগ আমেরিকায় ৯৯তম বছরের মতো অনুসৃত হচ্ছে। ১৯১৮ সালের ১৯ মার্চ সূর্যালোক সংরক্ষণের লক্ষ্যে একটি আইন হয় আমেরিকায়। ওই বছরের ৩১ মার্চ আমেরিকায় প্রথমবারের মতো ঘড়ির কাঁটায় অদলবদল করা হয়। তবে সে সময় এটি আমেরিকার সব অঞ্চলে অনুসৃত হতো না। ১৯৬৬ সালে এসে এটি প্রথম জাতীয়ভাবে অনুসরণ শুরু হয়। এরপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রয়োজনে এর মাত্রায় ভিন্নতা আনা হলেও আমেরিকায় সূর্যালোক সংরক্ষণ চলছেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, পৃথিবীতে সূর্যালোক সংরক্ষণের এটিই কি প্রথম উদ্যোগ ছিল? এর আগেও কি এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে?
উত্তর হচ্ছে ‘হ্যাঁ’, ছিল। বহু অঞ্চলেই এটি প্রচলিত ছিল। সরাসরি ঘোষিত না থাকলেও পৃথিবীর বহু অঞ্চলের মানুষ দিনের সময়টিকে আলাদাভাবে ভাগ করে যাবতীয় কাজ সম্পাদন করতেন। বিশেষত, কৃষিভিত্তিক সমাজে সৌরালোকের উপস্থিতি ও অনুপস্থিতি দ্বারাই সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। প্রাচীন সভ্যতাগুলোয় এ ধরনের নিদর্শন মিলবে ভূরি ভূরি। প্রাচীন বিভিন্ন সভ্যতায় দিবাভাগকে সমান ১২ ভাগে ভাগ করে সময়ের দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করতে দেখা যেত। এ ক্ষেত্রে দিনের দৈর্ঘ্য কোনো বিবেচ্য ছিল না। সে ক্ষেত্রে শীতের সময়ের দিনের প্রতিটি ভাগের দৈর্ঘ্য অবধারিতভাবেই গ্রীষ্মকালীন ভাগের চেয়ে কম ছিল।
এ ক্ষেত্রে রোমানরা ব্যবহার করত একটি বিশেষ ধরনের পানি ঘড়ি, বছরের বিভিন্ন সময় যার মানদণ্ড থাকত বিভিন্ন রকমের। সে সময় সূর্যোদয়ের পর দিনের তৃতীয় ভাগটিকে বলা হতো, হোরা টারশিয়া। শীতকালে রোমান হোরা টারশিয়া শুরু হতো আধুনিক সময়ের সকাল ৯টা ২ মিনিটে, যা বর্তমান সময়-কাঠামোর বিচারে স্থায়ী হতো ৪৪ মিনিট। অথচ এই একই হোরা টারশিয়া গ্রীষ্মকালে শুরু হতো সকাল ৬টা ৫৮ মিনিটে। ৭৫ মিনিটের স্থায়িত্বকাল নিয়ে দৈর্ঘ্যেও বড় ছিল এই দিবাভাগ। পৃথিবীর নিজ অক্ষে ঘূর্ণনকে কেন্দ্র করে আধুনিক অসম সময়ভাগ খুব পুরোনো দিনের কথা নয়। পৃথিবীর বহু অঞ্চলেই রোমানদের অনুরূপ না হলেও ঋতুভেদে সময় বিভাজন বদলে যেত। কৃষিভিত্তিক ভারতীয় সভ্যতায় দিবাভাগের সময়নির্দেশক বেলা আবর্তিত হতো রোদের তেজ বুঝে, যা এখনো ক্রিয়াশীল।
আধুনিক সময়ে এসে দিবালোক সংরক্ষণের প্রস্তাব প্রথম ১৮৯৫ সালে উঠলেও তা আলোর মুখ দেখতে অনেক সময় লাগে। বিস্তর গবেষণার পরও ১৯০৮ সালে প্রথম ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এ বিষয়ে একটি আইন উত্থাপিত হলেও তা সে সময় পাস হয়নি। আধুনিক সময়ে কানাডার অন্টারিও প্রথমবারের মতো দিবালোক সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে যায়। অন্টারিওর ওরিলিয়ার মেয়র থাকাকালে উইলিয়াম সোর্ড ফ্রস্ট প্রথমবারের মতো এ পদ্ধতি অনুসরণ করেন। ১৯১১ ও ১৯১২ সালে তাঁর মেয়াদে অরিলিয়ায় এ পন্থা অনুসরণ করে প্রাকৃতিক আলো সংরক্ষণের লক্ষ্যে ঘড়ির কাঁটায় অদলবদল করা হয়। আর রাষ্ট্র হিসেবে প্রথম এ পথে হাঁটতে শুরু করে জার্মানি ও হাঙ্গেরি যৌথভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। তা-ও শতবর্ষ হয়ে গেল। দেশ দুটিতে দিবালোক সংরক্ষণ প্রথম শুরু হয় ১৯১৬ সালের ৩০ এপ্রিল। একই সময়ে ব্রিটেন ও তার মিত্ররা এ পথ অনুসরণ করতে শুরু করে। তবে যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই যুক্তরাজ্য, কানাডা ও আয়ারল্যান্ড ছাড়া বাকি সবাই স্বাভাবিক ধারায় ফিরে আসে।
সময়ের সঙ্গে বহু দেশ এ পথ অনুসরণ করলেও খোদ আমেরিকাতেই এখন এর বিরোধী একটি পক্ষ তৈরি হয়েছে। সিবিএস নিউজ বলছে, ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের অনেকেই চলতি বছরকে এ কার্যক্রমের শেষ বছর হিসেবে দেখতে চাইছেন। এ বিষয়ে একটি ভোটও অনুষ্ঠিত হয়েছে সেখানে। তাদের কথা হলো, দিবাভাগ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। দিনের কাজ দিনেই শেষ করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। বিশেষত, তরুণ প্রজন্ম এখানকার রাতকে পছন্দ করছে না বলে এই পরিবর্তনের দাবি উঠেছে বলে জানা গেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম থেকে। ম্যাসাচুসেটসের সামনে এমন উদাহরণও অবশ্য রয়েছে। আমেরিকার হাওয়াই, অ্যারিজোনার অধিকাংশ অঞ্চল, গুয়াম, পুয়ের্তো রিকো সূর্যালোক সংরক্ষণ-বিষয়ক মার্কিন আইন অনুসরণ করে না।
সূর্যালোক সংরক্ষণের বিষয়টির মূলে রয়েছে পৃথিবীর শক্তিঘর নামে পরিচিত সূর্যকে আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার করা। ফলে বিষয়টি সরাসরি শক্তি উৎপাদন ও অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত। ২০০৫ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র চার সপ্তাহ সূর্যালোক সংরক্ষণের কারণে আমেরিকায় প্রায় ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়। তবে এর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে পাল্টা আরেক গবেষণায় অধ্যাপক ম্যাথিউ জে কোচেন বলেন, মার্কিন বিদ্যুৎ বিভাগ আলোকশক্তির সাশ্রয়ের কারণে বেঁচে যাওয়া বিদ্যুতের হিসাবই শুধু দিয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে গ্রীষ্মকালে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র ও শীতকালে হিটার বাবদ ব্যয় হওয়া বাড়তি বিদ্যুৎ সাশ্রয় বিদ্যুতের পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশি। তাঁর গবেষণার তথ্যমতে, এটি প্রায় চার গুণ চাহিদা বৃদ্ধি করে। এ ছাড়া এ ধরনের সৌরালোক সংরক্ষণের উদ্যোগ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে যতটা ইতিবাচক, ততটা শিল্পোন্নত অর্থনীতির জন্য নয় বলেও মত রয়েছে বিশ্লেষকদের।