সংকট নেই, চাহিদা বাড়ায় ছোলা-পেঁয়াজের দাম বাড়ছে

0
0

ভোলা নিউজ ২৪ডটকম।। কয়েক সপ্তাহ পরেই আসছে রমজান মাস। এরই মধ্যে বাজারে সংকট না থাকলেও চাহিদা বাড়ায় বেশির ভাগ পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে।

বিশেষ করে রমজানে চাহিদা বাড়ে এমন পণ্যের মধ্যে পেঁয়াজ ও ছোলার দাম বাড়ছে। সপ্তাহ ব্যবধানে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ২/৩ টাকা আর এক মাসের ব্যবধানে ছোলার দাম কেজিতে ৫ টাকা বেড়েছে।

এদিকে রমজানের আগাম প্রস্তুতি নিয়ে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক সন্তোষ প্রকাশ করলেও আমদানিকারক এবং ব্যবসায়ীরা আশ্বস্ত হতে পারছেন না। রমজানের পণ্য আমদানির জন্য পর্যাপ্ত ডলার দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে দুই বার বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি পাঠানো হয়। এর প্রেক্ষিতে ছোলা, পেঁয়াজ, খেজুর, ভোজ্যতেল, চিনিসহ আটটি পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বাণিজ্যিক ব্যাংক, আমদানিকারক ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বরাবরের মতো এবারও অসাধু ব্যবসায়ীদের অপকর্মে অস্থিতিশীল হতে শুরু করেছে বাজার। দুশ্চিন্তা বাড়ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয় থেকে ইতোমধ্যে বেশ কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সারা বছরের নিত্যপণ্য আমদানি ব্যয়ের প্রায় ২০ শতাংশই রমজানের পণ্য আমদানিতে খরচ হয়। তবে ডলার সংকটের কারণে নিত্যপণ্য আমদানি বিল পরিশোধে দেরি হচ্ছে। এজন্য পরিস্থিতি সামলাতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় রমজানের পণ্য আমদানির চাহিদা মেটাতে আলাদাভাবে ডলার সরবরাহ করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ করেছে। এর মধ্যে রমজানের চাহিদার প্রায় সমপরিমাণ এলসি ইতোমধ্যে খোলা হয়েছে। গত ডিসেম্বর থেকেই রমজানকেন্দ্রিক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খোলা শুরু হয়।

শনিবার (০৪ মার্চ) রাজধানীর মৌলভীবাজার, শ্যামবাজার, রায়সাহেব বাজার, সুত্রাপুর, ধূপখোলা মাঠ বাজারসহ বিভিন্ন বাজারে দেখা গেছে, পাইকারি বাজারে প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩২ টাকা কেজি। আর মুড়িকাটা দেশি পেঁয়াজ প্রতিকেজি মানভেদে ২৬ থেকে ২৮ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগেও বিক্রি হতো ২৫ থেকে ২৮ টাকা কেজি। আর আমদানি করা ভারতের পেঁয়াজ ২৮ থেকে ৩০ টাকা। যা গত সপ্তাহে ছিল ২৬ থেকে ২৮ টাকা। সে হিসেবে প্রতি কেজিতে দেশি ও আমদানি করা পেঁয়াজের দাম সপ্তাহ ব্যবধানে বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকা। এ বছর তানজানিয়া থেকে আসা ছোলা প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮২ টাকায়, যা গেল বছর ছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। আর অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা ভালো মানের ছোলা পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৮৫ থেকে ৮৬ টাকায়, যা গেল বছর বিক্রি হয়েছে ৬৮ থেকে ৭০ টাকা।

খুচরা বাজারে প্রতিকেজি দেশি হালি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা আর মুড়িকাটা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকা। আর আমদানিকৃত ভারতের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৩৮ টাকা কেজি দরে। বর্তমানে মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আসছে না।

এদিকে ছোলা ভালো মানের (অস্ট্রেলিয়া) প্রতি কেজি খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯২ টাকা। আর তানজিয়ার ছোলা খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৮৫ থেকে ৮৭ টাকা। এক মাস আগে প্রতি কেজি ছোলার দাম মান ভেদে ৮০ থেকে ৯৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। সে হিসেবে প্রতি কেজি ছোলার দাম কেজিতে ৫ টাকা করে বেড়েছে।

বিভিন্ন ট্রেডিং ও পাইকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দেওয়া তথ্যে জানা গেছে, বর্তমানে পাইকারিতে অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি হওয়া ছোলা প্রতি মণ ৩ হাজার ১০০ থেকে ৩ হাজার ৪০০ টাকায় লেনদেন হতে দেখা গেছে। এছাড়া তানজানিয়ার ছোলা বিক্রি হচ্ছে মণ প্রতি ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকায়। এক মাস আগেও যা ২ হাজার ৬০০ থেকে ৩ হাজার টাকার মধ্যে লেনদেন হয়েছিল।

পেঁয়াজের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, রমজান মাসকে সামনে রেখে সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক ব্যাংকগুলো পেঁয়াজের এলসি দিচ্ছে। ফলে বাড়তি চাহিদার জন্য এলসি খোলার পাশাপাশি আমদানিকারকরা বন্দর দিয়ে পেঁয়াজের আমদানি বাড়িয়েছিলেন। তবে এখনো বাজারে দেশি পেঁয়াজের ভালো সরবরাহ থাকায় আমদানিকৃত পেঁয়াজের চাহিদা কিছুটা কম। এতে চাহিদার তুলনায় আমদানি বাড়ায় দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম কমতির দিকে ছিল। পক্ষান্তরে ভারতের বাজারেই পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। এ অবস্থায় তা আমদানি করে লোকশান গুনতে হচ্ছিল আমদানিকারকদের। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে আমদানির পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছেন আমদানিকারকরা। ফলে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমায় আমদানিকৃত ভারতীয় পেঁয়াজের দাম কিছুটা বাড়ছে। সেই সঙ্গে দেশি পেঁয়াজের দামও খানিকটা বাড়ছে।

শ্যামবাজারে পাইকারি ব্যবসায়ী মেসার্স সিতালী আড়তের মালিক আব্দুর রহিম বলেন, বর্তমানে কৃষকের উৎপাদন ব্যয় অনুযায়ী পেঁয়াজের দাম স্বাভাবিক আছে। তবে গত সপ্তাহ থেকে কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা দাম বেড়েছে। সামনে রমজান তাই পেঁয়াজের চাহিদা বেড়েছে। আর চাহিদা বাড়লে দামও বাড়ে। কিন্তু বাজারে পেঁয়াজের কোনো সংকট নেই। মূলত চাহিদা বাড়ার কারণেই দাম একটু বেড়েছে। এখন পেঁয়াজের ভরা মৌসুম। এই দাম না পেলে কৃষকরা পেঁয়াজ উৎপাদন করবে না।

তিনি বলেন, বর্তমানে যে পরিস্থিতি এরকম থাকলে বাজারে পেঁয়াজের সংকট হবে না। যদি ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ না করে। এখনও ভারত থেকে আসে দেখে পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এছাড়া কাঁচামালের দাম সব সময় ওঠানামা করে। তবে সরকার নজরদারি বাড়াতে হবে। যাতে কোনো অসাধু ব্যসায়ী কারসাজি না করতে পারে।

এদিকে দেশে সীমিত পরিসরে ছোলা উৎপাদন হলেও চাহিদার সিংহভাগই আসে অস্ট্রেলিয়া, মিয়ানমার, তানজানিয়া থেকে। আগে মিয়ানমার থেকে আমদানি হলেও চলতি মৌসুমে এখনো প্রতিবেশী দেশটির ছোলা আসেনি। চলতি বছর চাহিদার তুলনায় আমদানি কম হওয়ায় রোজায় পণ্যটির দাম বেশি হবে বলেই ধরে নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে আগে থেকেই মজুদের পাশাপাশি বিক্রির ক্ষেত্রে বাড়তি দাম হাঁকিয়ে পণ্যমূল্য বাড়ানো হয়েছে কৌশলে। তাই এক মাসের ব্যবধানে ছোলার দাম বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণ।

পুরান ঢাকার মৌলভিবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে এক বছরে যে পরিমাণ ছোলা বিক্রি হয় তার অর্ধেকই হয় কেবল রমজান মাসে। এ কারণে বাড়তি চাহিদাকে পুঁজি করে আমদানিকারক ও মজুদদার ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। অনেক সময় পর্যাপ্ত মজুদ থাকলেও বড় ব্যবসায়ীদের বেঁধে দেওয়া দামের সঙ্গে সমন্বয় করতে ছোলার দাম বাড়ানো হয়। দেশে মুষ্টিমেয় কয়েকটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ছোলা আমদানির সঙ্গে যুক্ত থাকায় সহজেই পণ্যটির দাম বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে বলে মনে করছেন তারা।

মৌলভিবাজারের একাধিক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রোজার এক সপ্তাহ আগে ও রোজার সময় সরকারি পর্যায়ে বাজার মনিটরিং কমিটির অভিযান থাকায় কৌশলে কয়েক মাস আগেই পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। মূলত বর্তমানে দাম বাড়িয়ে অধিক মুনাফা তুলে নেওয়ার পর বাজার মনিটরিং কমিটির অভিযানকালীন সমন্বয় করে কমানোর কৌশল নিয়েছে আমদানিকারক ও ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়ীরা। তাই দেশের পণ্যমূল্যের দাম স্থিতিশীল রাখার পাশাপাশি রোজায় অস্বাভাবিক মুনাফা রোধ করতে কয়েক মাস আগে থেকেই বাজার মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনা করা জরুরি বলে মনে করছেন এ ব্যবসায়ীরা।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ড. গোলাম রহমান বলেন, রমজানে সাধারণত নিত্যপণ্যের চাহিদা স্বাভাবিকের তুলনায় দুই থেকে আড়াই গুণ বেড়ে যায়। একটা অসাধু ব্যবসায়ী চক্র এই সুযোগ নিয়ে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। এতে পণ্যের দাম স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। এ জন্য বাজার ঠিকমতো মনিটরিং করা দরকার।

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন জানিয়েছে, ডলারের দাম বাড়ার কারণে এবার রোজায় আমদানি করা পণ্যের দাম প্রায় ৩০ শতাংশ বাড়বে।

অন্যতম আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ডলার সংকটে আমরা এখনো পর্যাপ্ত এলসি খুলতে পারিনি। তবে রমজানে বাড়তি দামে পণ্য বিক্রি হবে কিনা তা নির্ভর করবে সে সময়ের বাজারমূল্যের ওপর।

চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ জাহেদী জানান, রমজানে পণ্যের দাম ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বাড়বে। এর কারণ হলো, আগে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য ৮৫-৮৬ টাকা হলেও বর্তমানে তা ১০৭ টাকা হয়েছে। আর ডলার সংকটের কারণে আমদানি কমেছে ৩০-৩৫ শতাংশ। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা রমজান উপলক্ষে আগাম প্রস্তুতি নিতে পারেননি। এরই মধ্যে ব্যবসায়ীরা বিকল্প হিসেবে ভারত ও মিয়ানমার থেকে রমজানের পণ্য আনার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাই সহজে এসব দেশ থেকে পণ্য আনতে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, রমজান মাসকে কেন্দ্র করে পর্যাপ্ত এলসি খোলা হয়েছে। এর পরিমাণ গত বছরের জানুয়ারির তুলনায় অনেক বেশি। তারপরও বিভিন্ন মাধ্যমে এলসি খোলার বিষয়ে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন।

তিনি জানান, রমজান মাসে পাঁচটি পণ্যের চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। আর বাজার স্বাভাবিক রাখতে এসব পণ্য আমদানিতে সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সরকারের আরেক সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, রোজার দেড় মাস আগেই গত বছরের তুলনায় আমদানি করা পণ্যের দাম গড়ে ৫৯ শতাংশ বেড়েছে।

খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের দেওয়া তথ্য মতে, গত ২০ থেকে ২৫ দিনে মানভেদে ছোলা মণ প্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেড়েছে। বিদেশি পেঁয়াজ কেজি প্রতি ২২ থেকে ৩২ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। দেশি পেঁয়াজ কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ২৮ টাকার মধ্যে।

ছোলার বার্ষিক চাহিদা প্রায় দেড় লাখ টন, রোজার চাহিদা ৮০ থেকে ৯০ হাজার টন। পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৫ লাখ টন; এর মধ্যে রোজার চাহিদা ৫ লাখ টন। এ বছর ২ লাখ ২৪ হাজার ৫৬৭ টন ছোলা আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলেছেন ব্যবসায়ীরা। এক বছর আগে এর পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার ৫৯৬ টন। ৪২ হাজার ৫৬৩ টন পেঁয়াজ আমদানির ঋণপত্র খুললেও গত বছরের একই সময় ছিল ৩৬ হাজার ২২৬ টন।

LEAVE A REPLY