ভোলা নিউজ ২৪ ডট নেট : মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতনে গত দুই দফায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠাতে ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট চুক্তি সই করেছে দু’দেশ। আগামী তিন মাসে প্রতিদিন ৩০০ করে এবং পরে এই সংখ্যা আরো বাড়িয়ে দুই বছরের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্পন্ন করার শর্ত রেখে এই চুক্তি সই হয়। তবে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, সম্মানজনক ও নিরাপদ প্রত্যাবাসন হতে হবে।
মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক শেষে বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক এবং মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব মিন্ট থো এই চুক্তিতে সই করেন। এর আগে সোমবার সারাদিন যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম বৈঠকে চুক্তি নিয়ে দিনভর আলোচনা হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ওই বৈঠকে আন্তরিক পরিবেশে দুই পক্ষের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্টের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। ওই খসড়া তৈরি করা হয় দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সম্মতিপত্র এবং যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের দলিলের টার্মস অব রেফারেন্সের ভিত্তিতে। এতে প্রতি সপ্তাহে ১৫ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে বাংলাদেশ প্রস্তাব করে। কিন্তু তারা ওই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। তারা নিজেরা রোহিঙ্গাদের জন্য কিছু ব্যবস্থা করেছে। ফলে প্রাথমিক অবস্থায় প্রতিদিন ৩০০ করে সপ্তাহে এক হাজার ৫০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে রাজি হয়েছে মিয়ানমার। পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে পর্যালোচনা করে এ সংখ্যা বাড়ানো হবে। আমরা বলেছি যখন থেকে প্রত্যাবাসন শুরু হবে তার দুই বছরের মধ্যে প্রত্যাবাসন শেষ হবে। এটি নিয়ে অনেক আলোচনার পর মিয়ানমার এ প্রস্তাবে রাজি হয়। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর এই প্রক্রিয়ার অধীনে একটি পরিবারকে একটি ইউনিট হিসেবে গণ্য করা হবে অর্থাৎ একটি ফরমে পুরো পরিবারের তথ্য থাকবে এবং মিয়ানমার এটি গ্রহণ করবে। ফলে প্রক্রিয়াটি সহজ হবে। এ ব্যাপারে যত শিগগিরই সম্ভব রোহিঙ্গাদের একটি তালিকা মিয়ানমারকে দেয়া হবে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থাকে বাংলাদেশ কাজে লাগাবে এবং মিয়ানমার তাদের সময়মতো আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে।
সূত্র জানায়, রোহিঙ্গারা যাতে আর বাংলাদেশে না আসে তার ব্যবস্থা করবে মিয়ানমার। এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের জিরো পয়েন্টে অপেক্ষমাণ ৭ হাজার রোহিঙ্গাকে তারা সেখান থেকে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করবে। ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার একটি অস্থায়ী ক্যাম্পে রাখবে এবং এটি কখনই অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত ক্যাম্পে পরিণত হবে না বলে মিয়ানমার জানিয়েছে।
এদিকে মিয়ানমারে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে পাঠানো এক প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে গতকাল জানানো হয়, রোহিঙ্গারা যাতে আর বাংলাদেশে আসতে না পারে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে মিয়ানমার সম্মত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য বাংলাদেশে ট্রানজিট ক্যাম্প হবে ৫টি এবং মিয়ানমারে অভ্যর্থনা ক্যাম্প হবে দুটি। বাংলাদেশ থেকে নিয়ে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের লা পো থং নামক একটি জায়গায় অস্থায়ীভাবে রাখা হবে। তারপর তাদের পুড়িয়ে দেয়া বাড়িঘর সংস্কার করে তাদের সেখানে পাঠানো হবে। এতে আরো বলা হয়, সহিংসতায় যেসব শিশু অনাথ হয়েছে এবং বাংলাদেশে যাদের জš§ হয়েছে তাদেরকেও এই অ্যারেঞ্জমেন্টের আওতায় ফেরত পাঠানো হবে। এ জন্য দুটি টেকনিক্যাল ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হবে। একটি রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাইয়ের জন্য এবং অন্যটি ফেরত পাঠানোর জন্য।
ওদিকে মঙ্গলবার যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক শেষে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে প্রথম ব্যাচে ১২৫৮ জনকে ফেরত নেয়া হবে। এর মধ্যে ৭৫০ জন মুসলমান এবং ৫০৮ জন হিন্দু। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মিয়ানমার সরকার ৭৫০ জন মুসলমান ও ৫০৮ জন হিন্দু রোহিঙ্গাকে ইতোমধ্যে যাচাই-বাছাই সম্পন্ন করেছে এবং তারা বাংলাদেশকে অনুরোধ জানিয়েছে যে, প্রথম ব্যাচে যেন উল্লিখিত রোহিঙ্গারা থাকে।
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর পূর্বপ্রস্তুতি প্রত্যক্ষ করতে এক সপ্তাহের সফরে আগামীকাল ঢাকায় আসছেন মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াং লি। সফরকালে তিনি কক্সবাজার যাবেন এবং ক্যাম্পে অবস্থান নেয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে প্রত্যাবাসন নিয়ে মতবিনিময় করবেন। এর আগেও রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে তিনি কক্সবাজার সফর করেন। বাংলাদেশ সফর শেষে ইয়াং লি থাইল্যান্ডে যাবেন। মিয়ানমার সরকার ইয়াং লিকে সেদেশে ঢুকতে অস্বীকৃত জানানোর পর তিনি বাংলাদেশ সফরের সিদ্ধান্ত নেন।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানান, রোহিঙ্গাদের ফেরাতে খুব ঠাণ্ডা মাথায় এগোচ্ছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছে বলে জানান তিনি। মঙ্গলবার বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিজ কার্যালয়ে প্রতিমন্ত্রী এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরাতে আমরা বরাবরই আশাবাদী। বিষয়টা যেহেতু জটিল, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে এবং সমস্যার ব্যাপ্তি অনেক বড়। সোমবার ৯ লাখ ৯৯ হাজার রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক নিবন্ধন হয়েছে। এই সংখ্যাই বলে সংকট কত বড়।
উল্লেখ্য, গত বছরের ২৫ আগস্ট রাখাইনে নতুন করে সেনা অভিযান শুরুর পর এ পর্যন্ত লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে আরেক দফা অভিযানে আশ্রয় নেয় আরো প্রায় এক লাখ। এ ছাড়া মিয়ানমারে নিপীড়নের মুখে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে আরো প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওই অভিযান এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে শরণার্থীদের ফেরত নিতে সম্মত হয় মিয়ানমার। রোহিঙ্গাদের ঘরে ফেরার পথ তৈরি করতে গত বছরের ২৩ নভেম্বর নেপিদোতে দু’দেশের মধ্যে একটি সম্মতিপত্র স্বাক্ষরিত হয়। তাতে বলা হয়, প্রথম দফায় শুধু ২৫ আগস্ট থেকে আসা শরণার্থীদেরই ফেরত নেবে মিয়ানমার। ওই সম্মতিপত্র স্বাক্ষরের তিন সপ্তাহের মধ্যে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করে দুই মাসের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করা হবে এবং যত দ্রুত সম্ভব একটি সুনির্দিষ্ট চুক্তিতে সই করবে দু’দেশ। কিন্তু সেই ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয় তিন সপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়ার পর, গত বছর ১৯ ডিসেম্বর। ঢাকায় ওই বৈঠকেই যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের টার্মস অব রেফারেন্স ঠিক করা হয়। সম্মতিপত্র স্বাক্ষরের ৫৪ দিনের মাথায় দুই পক্ষ মঙ্গলবার ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট চূড়ান্ত করল। আর প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য সম্মতিপত্রে নির্ধারিত দুই মাস সময় শেষ হচ্ছে ২৩ জানুয়ারি। তবে নির্ধারিত দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরু নাও হতে পারে। এ জন্য আরো এক-দুই সপ্তাহ পরে হতে পারে বলে জানা গেছে।