ভোলা নিউজ ২৪ ডটনেট : আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী প্রতিদিন সীমান্তে সশস্ত্র টহল দিচ্ছে। এ দিকে এখনো মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের দলে দলে আসা অব্যাহত আছে। গতকালও বাংলাদেশের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে প্রবেশ করেছে হাজার খানেক রোহিঙ্গা। গত এক মাস পাহাড়ে-জঙ্গলে অবস্থান করে টিকে থাকা সম্ভব নয় নিশ্চিত হওয়ার পরই পাঁচ-ছয় দিন আগে থেকে বাংলাদেশে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন বুচিডং, রাচিডংয়ের রোহিঙ্গারা। তারা নাফ নদী অতিক্রম করে রাতের বেলায় শাহপরীর দ্বীপে এসে উঠেন এবং সকালে টকেনাফ ও উখিয়ার দিকে যেতে থাকেন।
শাহপরীর দ্বীপ থেকে টেকনাফ-উখিয়ার দিকে যাওয়ার পথে কয়েকজন রোহিঙ্গা জানিয়েছেন, ভিটেমাটি হারিয়ে কিছু রোহিঙ্গা ওদের কাছে আটক থাকার সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাদের ত্রাণ দেয় এবং সাংবাদিকেরা ছবি তোলা ও ভিডিও করার পর অন্য একটি গ্রুপ এসে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে এসব ত্রাণ কেড়ে নেয় এবং মারধর করে বাংলাদেশের দিকে চলে যেতে বলে। রাস্তায় আবার ওদের পেলে গুলি করে হত্যা করবে বলে হুমকিও দেয়। জীবনের হুমকির মুখে রোহিঙ্গারা ত্রাণ ফেলে দ্রুত পাহাড়ে-জঙ্গলে লুকিয়ে পড়েন এবং রাতের বেলা পথ চলতে চলতে বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন।
মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সাথে ওই দেশের সেনাবাহিনীকে প্রতিনিয়ত ভারী অস্ত্র নিয়ে টহল দিতে দেখা যায়। গতকাল সোমবার বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তমব্রু সীমান্তের ওপারে তিনজনের একেকটি দলে বিভক্ত হয়ে এদের টহল দিতে দেখা যায়। বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতর থেকে জুম করে ছবি তোলে দেখা যায় মিয়ানমার সরকার জিরো পয়েন্টের জায়গা ঘেঁষে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করছে।
রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর লোকদের নির্মূল করার লক্ষ্যে গত আগস্ট মাস থেকে গণহত্যা শুরু করার পর সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া কেটে দিয়েছিল ওদের বর্ডার গার্ড বাহিনী (বিজিপি) যেন রোহিঙ্গারা দ্রুত বাংলাদেশে চলে আসতে পারে। বাংলাদেশ অংশের তমব্রুর লোকজন এ কথা জানিয়েছেন।
গতকাল দুপুররের দিকে তমব্রু সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার সীমান্তে ওখানকার সেনাবাহিনীর সদস্যরা কেউ সামরিক পোশাকে আবার কাউকে শুধু সামরিক প্যান্ট পরে গায়ে সাধারণ শার্ট চাপিয়ে অস্ত্র কাঁধে নিয়ে সীমান্ত টহল দিচ্ছিল। মাঝে মধ্যে এরা দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে বাংলাদেশের দিকে দেখে নিচ্ছিল কোথায় কী আছে। এদের অনেককেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কাজ-কর্মরত মানুষ অথবা সীমান্তে অন্য কোনো কাজে গেলে অস্ত্র তাক করে গুলি করার ভঙ্গি দেখায়, যেন বাংলাদেশ সীমান্তের লোকজন ভয় পায়। তবে বাংলাদেশের বিজিবির সদস্যরা থাকলে এ ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে এরা বিরত থাকে বলে জানিয়েছেন তমব্রু সীমান্তের লোকজন।
অবশ্য বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিকে দেখা গেল তারা তমব্রু সীমান্তে টহল জোরদার করেছে। কোনো বেসামরিক লোকজনকে অথবা সীমান্ত পরিদর্শনে আসা সাংবাদিকদেরও সীমান্ত পিলারের ধারেকাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না বিজিবি। অবশ্য মিয়ানমার সীমান্তের কাছে ওদের জিরো পয়েন্টে ঝুপড়ি ঘরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে এখান থেকে বিজিবির তত্ত্বাবধানে ত্রাণ পৌঁছে দিতে দেখা গেছে। রোহিঙ্গাদের প্রতিটি ৮০ থেকে ১০০ পরিবার থেকে একজন মাঝি (দলনেতা) নির্ধারণ করে মাঝিদের বাংলাদেশ সীমান্তে ডেকে এনে ত্রাণগুলো এদের হাতে তুলে দেয়া হয়। মাঝিরা মাথায় করে দুই দেশের সীমান্ত বিভক্তকারী একটি খাল পেরিয়ে মিয়ানমারের জিরো পয়েন্টে অবস্থান করা শিবিরে ত্রাণ পৌঁছে দেয়। তমব্রুর গ্রামবাসী জানিয়েছেন, মাঝিরা ঠিকঠাক মতো ওদের ত্রাণ পৌঁছে দিয়ে থাকে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী মাঝে মধ্যে ওদের দেশে থেকে এ দেশের দিকে তেড়ে আসে বলে গ্রামবাসী জানিয়েছেন। ওখানকার রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরের আগুনের ছাই এবং মাঝে মধ্যে আগুনের ফুলকিও চলে আসে এপারে। এ কারণে সীমান্তবাসী আতঙ্কগ্রস্ত বলে জানা গেছে।
গতকাল সকালে শাহপরীর দ্বীপে বুচিডং থেকে আসা রফিকুল (৫০) জানিয়েছেন, আমরা পালিয়ে আসতে চাইলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আমাদের আটক করে দেয় একটি গুদাম ঘরে। আমরা ভেবেছিলাম যে এরা আমাদের গুলি করে মেরে ফেলবে। তবে একদিন সেনাবাহিনীর লোকজন আমাদের একটি খোলা মাঠে লাইন ধরে দাঁড়াতে বলে। আমরা ভাবলাম যে আমাদের লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে মারবে।
এ নির্দেশের পর আমরা লাইন ধরে দাঁড়ালে অনেকেই কান্না করতে শুরু করে। অনেকেই তওবা করে নেয়। ছেলেমেয়েদের জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর দেখা দেখা গেল মগবাহিনীর লোকজন ট্রাকে করে একটা কিছু নিয়ে আসে। কী তা আমরা প্রথমে বুঝতে পারিনি। এরা আমাদের সুশৃঙ্খলভাবে ধীরে ধীরে আসতে বলে এবং ওদের ট্রাকের কাছে এনে আমাদের এক ব্যাগ করে ত্রাণ দেয়। আবার ব্যাগ খুলে দেখতে বলে। ত্রাণ নেয়া অবস্থায় এরা আমাদের ছবি ধারণ করে টেলিভিশন ক্যামেরায়। ছবি তোলা শেষে সাংবাদিকেরা চলে গেলে এরা আমাদের ত্রাণগুলো কেড়ে নেয় এবং আমাদের এলোপাতাড়ি পেটাতে থাকে।
এ সময় বলতে থাকে যত দ্রুত পারিস তোদের দেশ বাংলাদেশে চলে যা। রফিকুল জানান, আমরা দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করলাম এবং রাত হলে পাহাড়ে-জঙ্গলে ঢুকে লুকিয়ে লুকিয়ে নীরবে পথ চলতে লাগলাম। আমরা এ সময় কাঁধে করে আমাদের ছোট ছেলেমেয়ে এবং বৃদ্ধদের নিয়ে দৌড়ে পালাই।