খোলা চিঠি
বরাবর,
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
বিষয়: বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ মোস্তফা কামালকে নিজ জন্মস্হানে সমাহিত করা ও তাঁর মায়ের শেষ ইচ্ছা প্রসঙ্গে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আজ ২৬ মার্চ, স্বাধীনতা দিবস। বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণ তাদের মুক্তিসংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের ফল আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। সেসময় বাংলাদেশের রণাঙ্গনে যেকয়জন অকুতোবীর নিজেদের জীবন বাজী রেখে দেশের জন্য লড়াই করেছেন, শহিদ হয়েছেন তাঁরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদেক কাছে আমাদের আজন্ম ঋণ। সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ এর অন্যতম বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল এর জন্ম ১৯৪৭ সালে ভোলার দৌলতখান উপজেলার পশ্চিম হাজীপাড়া গ্রামে।
দেশরত্ন, স্কুল সনদ অনুযায়ী বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল এর নাম মোহাম্মদ মোস্তফা। বাবার নাম হাবিলদার হাফিজ। বাসার সামনে দিয়ে সৈন্যদের সুশৃঙ্খল কুচকাওয়াজ দেখে কিশোর মোস্তফার মনেও সাধ জাগতো সেনা সদস্য হবার। পারিবারিক বাধার কারণে ১৯৬৭ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে যোগ দেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। প্রশিক্ষণ শেষে তাকে নিয়োগ করা হয় ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কুমিল্লায়।
জননেত্রি , মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা আপনার অজানা নয়। তবুও আপনার নিবিড় মনোযোগ আকর্ষণের জন্য বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের যুদ্ধকালীন সাহসিকতার বীরত্বগাঁথা তুলে ধরছি। ভালো বক্সার হিসাবে রেজিমেন্টে মোস্তফা কামালের সুনাম ছিলো। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কয়েকদিন পূর্বে বক্সার হিসাবে সিপাহি মোহাম্মদ মোস্তফা অবৈতনিক ল্যান্স নায়েক হিসাবে পদোন্নতি পান। এই বীর সেনানী পাকিস্তানি ঘৃণ্য চক্রান্ত বুঝতে পেরে কয়েক জন বাঙ্গালি সৈনিককে সাথে নিয়ে মেজর শাফায়াত জামিল অধিনায়ক লে. কর্নেল খিজির হায়াত খান সহ সকল পাকিস্তানি অফিসার ও সেনাদের গ্রেফতার করেন। এরপর তাঁরা মেজর খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে আশুগঞ্জ, উজানিস্বর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এন্ডারসন খালের পাশ দিয়ে প্রতিরক্ষায় অবস্থান নেন।১৭ এপ্রিল সকাল থেকে পাকিস্তানি বাহিনী তীব্র গোলাবর্ষণ শুরু করে প্লাটুন পজিশনের উপরে। সারাদিন যুদ্ধ চলে। ১৮ এপ্রিল সকালে বর্ষণমুখর পরিস্থিতিতে শত্রু দরুইল গ্রামের কাছে পৌছে যায়। মূল আক্রমণ আরম্ভ হয় দুপুর ১২ টায় অবস্থানের পশ্চিম দিক থেকে। শত্রুর একটি দল প্রতিরক্ষার পিছন দিক দিয়ে মুক্তিবাহিনীকে ঘিরে ফেলছিলো। মুক্তিবাহিনী দরুইল গ্রাম থেকে আখাওড়া রেল ষ্টেশনের দিকে পশ্চাদপসরণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু নিরাপদে সেখান থেকে সরে আসতে হলে তাদের প্রয়োজন ছিলো নিরবিচ্ছিন্ন কাভারিং ফায়ার। মোহাম্মদ মোস্তফা সহযোদ্ধাদের জানান তিনি নিজে এই কাভারিং ফায়ার প্রদান করবেন এবং সবাইকে পেছনে হটতে নির্দেশ দেন। সহযোদ্ধারা মোস্তফাকেও পশ্চাদপসরণের অনুরোধ করেন। কিন্তু কর্তব্যের টানে মোস্তফা ছিলেন অবিচল। তিনি সহযোদ্ধাদের বললেন তাঁর প্রাণের তুলনায় সহযোদ্ধাদের অনেকের প্রাণের মূল্য অধিক।মোস্তফার ক্রমাগত নিখুঁত ফায়ারে পাকিস্তানিদের প্রায় ২০-২৫ জন হতাহত হন এবং তাদের সম্মুখ গতি মন্থর হয়ে পড়ে। পাকিস্তানিরা মরিয়া হয়ে মোস্তফার অবস্থানের উপরে মেশিনগান এবং মর্টারের গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এক পর্যায়ে মোস্তফার এল.এম.জি.-র গুলি নিঃশেষ হয় এবং তিনি মারত্মক ভাবে জখম হন। তখন পাকিস্তান বাহিনীর সৈনিকরা ট্রেঞ্চে এসে তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।তাকে শাহাদাতের স্থানের পাশেই সমাহিত করেন।মোস্তফা তাঁর জীবন দিয়ে সহযোদ্ধাদের জীবন বাঁচিয়েছিলেন।অসীম সাহসিকতার জন্য তাকে সর্বোচ্চ বীরত্বসূচক খেতাব ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ প্রদান করে বাংলাদেশ সরকার।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,ভোলার জনগণ হিসাবে আমরা গর্বিত এই জন্য যে বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা আমাদের জেলার সন্তান। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় নিজ জেলার, নিজ জন্মস্হানের মাটিতে তিনি সমাহিত হতে পারেননি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সম্মুখ সমরে তিনি যেখানে নিহত হয়েছেন, তাকে সেখানেই সমাহিত করা হয়েছে। আর এর কারণে বঞ্চিত হয়েছেন বীরশ্রেষ্ঠের বাবা মা, আত্মীয় স্বজন ও ভোলার আপামর জনসাধারণ। বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল এর মায়ের বার্ধক্যজনিত কারণে প্রিয় পুত্রের কবরখানা ঠিকমতো দেখতেও পারেননি। যেখানে মায়েরা ক্ষণজন্মা সন্তানের কবর সবসময় দৃষ্টিসীমার মাঝে আগলে রাখে আর সেখানে জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান সমাহিত হয়ে আছেন আখাউড়ায়!
মানবতার কন্যা, মৃত্যুর পর মৃতের বাবা মা কিংবা আত্মীয় স্বজন চায় যে, তাদের আপনজনের কবর তাদের কাছাকাছি কোন জায়গাতে যেন হয়। যাতে করে তাঁর জন্ম ও মৃত্যু দিনে তাঁর জন্য বিশেষ আয়োজনের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করা সম্ভব হয় ও নিয়মিত কবর জিয়ারত করাও সম্ভব হয়। কিন্তু বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ মোস্তফা বেশ দুর্ভাগা যে,যিনি দেশমাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন অথচ তিনিই তাঁর নিজ জেলা তথা তার জন্মস্থানের মাটিতে সমাহিত হতে পারেননি । ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার আখাউড়া যদি তাঁর কর্মস্থল হয় তাহলে তিনি জন্মস্থান রেখে কিভাবে তাঁর কর্মস্থলে সমাহিত হোন?
মমতাময়ী মা, ভোলার সন্তান হিসাবে দেশের এই সূর্য সন্তানের সমাধি যথাযথ মর্যাদায় রক্ষণাবেক্ষণ, শ্রদ্ধা নিবেদন ও তাঁর যথাযোগ্য স্মরণে নিজ জেলার বিকল্প নেই। এই শ্রেষ্ঠ সন্তানের স্মৃতির উদ্দেশ্য ভোলায় নির্মিত হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল বাসটার্মিনাল ও বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল স্মৃতি জাদুঘর। তবে তাকে কেন ভোলায় সমাহিত করা হবে না? বীরশ্রেষ্ঠকে নিজ জেলার মাটিতে সমাহিত করার দীর্ঘবছরের দাবি দ্বীপজেলা ভোলার মানুষের অধিকার।
প্রিয় নেত্রী, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার আখাউড়ার দরুইল গ্রামের আপমর জনগণের প্রতি আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা। তাঁরা দীর্ঘ ৪৮ বছর সম্মান ও আন্তরিকতার সাথে এই বীরকে স্মরণ করে এসেছেন। এবার সময় এসেছে বীরশ্রেষ্ঠকে তাঁর নিজ জন্মস্থানের মাটিতে সমাহিত করার। আর এই মহান ও মানবিক কাজটি আপনার যোগ্য নেতৃত্বে আপনার সরকারের পক্ষেই সম্ভব।
বঙ্গবন্ধু কন্যা, স্বাধীনতা যুদ্ধে সন্তানহারা মায়ের কষ্ট আপনি খুব ভালো করেই জানেন। বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল এর মা জীবনের শেষ বেলায় উপনীত হয়েছেন। তিনি মৃত্যুর পূর্বে তার প্রিয় সন্তানের নাম মোহাম্মদ মোস্তফা ও তাঁর সমাধি নিজ জন্মস্হানে দেখে যেতে চেয়েছেন। রত্নগর্ভা এই জননীর শেষ ইচ্ছা পূরণে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামীলীগ ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনাই একমাত্র ভরসা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সন্তানহারা এক মা ও ভোলার আপামর জনসাধারণের প্রাণের দাবি পূরণে আপনি আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হবেন।ভোলাবাসী ফিরে পাবে তাদের প্রিয় সূর্যসন্তানকে নিজ জেলায় সমাহিত করার অধিকার।
নিবেদক
আপনার গুণমুগ্ধ
ভোলার আপামর জনসাধারণের পক্ষে
সালেহ্ রনক
শিক্ষক, সমাজকর্মী
কলেজ রোড, যুগীর ঘোল
ভোলা