ভোলা নিউজ ২৪ডটনেট : আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটে কাক্সিক্ষত ডিজিটাল ভোটিং মেশিনে (ডিভিএম) ভোট না করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সদ্য সমাপ্ত রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে একটি কেন্দ্রে মেশিনটি ব্যবহারের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করলেও সরকার পরিবর্তনের বিশাল কর্মযজ্ঞে এটির ওপর এখনই ভরসা রাখতে পারছে না সাংবিধানিক সংস্থাটি। যে কারণে আপাতত ডিভিএমকে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে পরীক্ষামূলকভাবে চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। ধারাবাহিক এই পরীক্ষা চলতে থাকবে আগামী ৬-৭ বছর পর্যন্ত। সফলতার হার শতভাগ কিংবা তার কাছাকাছি হলে জাতীয় নির্বাচনে এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগাবে কমিশন। এ ক্ষেত্রে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে টার্গেট করেছে কমিশন।
কমিশনের ভাষ্যমতে, প্রযুক্তির কথা বলা হলেও মনুষ্য সৃষ্ট এই যন্ত্রের পরিচালক একজন ব্যক্তি। তাই এটি যে শতভাগ ক্রটিমুক্ত তা নিশ্চিত করে বলার সুযোগ নেই। কিন্তু এটাকে সফলভাবে কাজে লাগানো গেলে দুটি ইতিবাচক সুফল পাবে কমিশন এবং রাজনৈতিক দলগুলো। একটি দ্রুত সময়ের মধ্যে ভোটগ্রহণ এবং ভোটের ফলও চটজলদি প্রকাশ হবে। আর দ্বিতীয়টি, চাইলেও কেন্দ্র দখল করে দ্রুততার সঙ্গে ভোট দিতে পারবে না দুবৃর্ত্তরা। কারণ ভোটারদের ফিঙ্গার প্রিন্ট এই প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত থাকবে এবং এক মিনিটে সর্বোচ্চ ৫টির বেশি ভোট প্রয়োগের সুযোগ থাকবে না। পাশাপাশি, মান্ধাতা আমলের কাগজের তৈরি ব্যালট পেপার সংরক্ষণ ও মুদ্রণের ঝামেলা কমে আসবে।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের যুগ্ম সচিব এবং এনআইডির পরিচালক (অপারেশন) আবদুল বাতেন বলেন, ডিজিটাল ভোটিং মেশিন (ডিভিএম) নির্বাচনে ব্যবহারের জন্য কমিশনে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়েছে। যার ধারাবাহিকতায় রংপুরের একটি ওয়ার্ডের একটি কেন্দ্রে ভোট নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকারের (লোকাল বডি) নির্বাচনে ব্যবহার করার মাধ্যমে এই প্রযুক্তি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয়ে যাবে। কারণ ব্যবহার করার আগ পর্যন্ত আমরা জানতে পারব না, এই প্রযুক্তির ভালো-মন্দ দিকগুলো সম্পর্কে। এ জন্য আগামী ৬-৭ বছর পর্যন্ত এটি স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে ব্যবহার চলতে থাকবে। যার মাধ্যমে এ বিষয়ের ত্রুটি ও কারিগরি দিকগুলো চিহ্নিত করা হবে। সব ধরনের (ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ইতিবাচক সম্ভাবনা) অভিজ্ঞতা অর্জন করার পর পরবর্তী নির্বাচন অর্থাৎ ২০২৩ সালের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে এটিকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
ইসি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ইভিএম ব্যবহার হওয়া প্রায় সব নির্বাচনে ত্রুটি ধরা পড়লেও ভোটের ফলাফলের ক্ষেত্রে প্রভাব না পড়ায় অনেক ওয়ার্ডের নির্বাচনের ফল গোঁজামিল দিয়ে প্রকাশ করেছিল কমিশন। কিন্তু রাজশাহী সিটির একটি ওয়ার্ডে এই প্রযুক্তির ত্রুটির কারসাজি ধরা পড়লে তা প্রকাশ্যে চলে আসে, কারণ এখানে বিজয়ী ও নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান ছিল কাছাকাছি।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, নির্বাচন কমিশন প্রযুক্তির সঙ্গে প্রথম যুক্ত হয় ১/১১ ড. শামসুল হুদা কমিশনের আমলে। সংস্কার কমিশনের তকমা পাওয়া এই কমিশন হঠাৎ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) প্রবর্তন করেন। সদ্য প্রয়াত বর্ষীয়ান রাজনীতিক মহিউদ্দীন চৌধুরীর নির্বাচনী মাঠ চট্টগ্রাম সিটিতে নতুন উদ্ভাবিত এই প্রযুক্তি দিয়ে ভোট নেয়া হয়, তবে সেটি ছিল সীমিত পরিসরে। ধাপে ধাপে এর প্রসারতা বাড়তে থাকে। নারায়ণগঞ্জ সিটির কয়েকটি ওয়ার্ডে, কুমিল্লা সিটি ও নরসিংদী পৌরসভায় শতভাগ ইভিএম এবং পরবর্তী সময়ে ইউনিয়নসহ রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা ও সিলেট সিটিতেও ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয়।
১/১১ কমিশন বিদায় নেয়ার পর কাজী রকিবউদ্দিন কমিশনের অধীনে এসব নির্বাচন হয়। ইভিএমের প্রবর্তক ছিল বুয়েট। রাসিক সিটিতে ইভিএমকে ত্রুটিমুক্ত করতে কমিশন থেকে বুয়েটকে অনুরোধ জানানোয় বিপত্তি বাধে। এর আগে বুয়েটের অনুমতি ছাড়া সিইসি রকিব কমিশনের জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক এককভাবে দাম বেশির অজুহাতে চায়না ব্যাটারির বদলে ওই সিটিগুলোতে দেশীয় প্রযুক্তির চান্দা ব্যাটারি ব্যবহার করে। পরে বুয়েট ত্রুটির দায় দায়িত্ব না নিলে ইভিএম প্রযুক্তিকে বিদায়ী কমিশন তাদের মেয়াদে আর কোনো নির্বাচনে ব্যবহার করেননি। পরবর্তী সময়ে তারা ডিভিএম প্রবর্তনের উদ্যোগ নেয়, কিন্তু দায়িত্বের মেয়াদ পূর্ণ হলে তা বাস্তবায়ন না করেই চলে যেতে হয়। এমনকি পুরনো ইভিএম বর্তমান কেএম নুরুল হুদা কমিশন সম্প্রতি বিলুপ্ত ঘোষণা করেছে।
এর পর এনআইডির সাবেক ডিজি ব্রি. জে. সুলতানুজ্জামান মো. সালেহউদ্দীনের নেতৃত্বে বিএমটিএফের সহায়তায় ডিভিএম প্রবর্তন করার কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। ইতোমধ্যে এই কমিশনের আমলে কয়েক দফা ডেমো উপস্থাপন হয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এখন শুরু হচ্ছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পালা, যা ২১ ডিসেম্বর রংপুর সিটিতে প্রথম সীমিত আকারে ব্যবহার হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এটির ব্যাপ্তি বাড়াতে থাকবে কমিশন। সব ধরনের কারিগরি ত্রুটি চিহ্নিত করা এবং তা সমাধানের পর জাতীয় নির্বাচনে ব্যবহারের পদক্ষেপ নেয়া শুরু করবে কমিশন। এর জন্য সংশোধন হতে যাওয়া গণপ্রতিনিধি আদেশ-১৯৭২ (আরপিও)তে ডিভিএম যুক্ত করা হচ্ছে। আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিধিমালায় এই প্রযুক্তির ব্যবহার সংক্রান্ত আইন যুক্ত থাকলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এটার ব্যবহারের সুযোগ ছিল না। নতুন সংশোধিত আরপিওতে এটি অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনে এটার ব্যবহারের পথ খুলছে। কারণ আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন টার্গেট না হলেও পরবর্তী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এটির প্রয়োগ ঘটাতে সব ধরনের পদক্ষেপ রেখে যেতে চাইছে কেএম নুরুল হুদার কমিশন।