ভোলা নিউজ২৪ডটনেট।। পণ্যবাহী পরিবহন শ্রমিকদের ভোগান্তির আরেক নাম বরিশাল-ভোলা নৌ রুটের লাহারহাট ফেরিঘাট। এখানে বাড়তি টাকা ছাড়া চলে না ফেরির ইঞ্জিন। যদিও বা চলে তার জন্য গুনতে হয় দ্বিগুণ টাকা। যিনি বাড়তি টাকা দেন না তাকে ২/৩ দিন ঘাটেই আটকে থাকতে হয়। আর টাকা দিলে সবার পেছনে আসা পরিবহনটি অনায়াসেই পৌছে যায় ফেরিতে।
তবে এমন প্রকাশ্য অনিয়ম ও চাঁদাবাজি শুধুমাত্র লাহারহাট ঘাটেই নয়। একই চিত্র অপর প্রান্ত ভোলার ভেদুরীয়া ঘেটেও। দীর্ঘদিন ধরে বিআইডব্লিউটিসি ও বিআইডব্লিউটিএর অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীদের এমন প্রকাশ্য অনিয়ম চলে আসলেও সে দিকে নজর নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। ফলে অনিয়ম ও জিম্মি দশা থেকে সহজেই রেহাই পাচ্ছেন না পরিবহন শ্রমিকরা।
সূত্রমতে, বরিশাল তথা দক্ষিণাঞ্চল থেকে ভোলা ও লক্ষ্মীপুরে সরাসরি সড়ক যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই। এজন্য বরিশালের লাহারহাট হয়ে ফেরি যোগে প্রায় ১৬ কিলোমিটার নদী পথ পাড়ি দিয়ে ভোলার ভেদুরীয়া ঘাটে পৌছতে হয়। সেক্ষেত্রে সময় লাগে দেড় থেকে আড়াই ঘন্টা। আর যে গাড়িটি সঠিক সময়ে পার হতে পারে না তাকে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে হয়। অনেকেই ফেরি পার হতে না পেরে বহনকারী গাড়ি নিয়ে ফিরে যায়। সেই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে বিআইডব্লিউটিসির অসাধু চক্র। তারা আগে পার করে দেয়ার নামে বাড়তি টাকায় নিজেদের পকেট ভারী করছে।
সরেজমিনে গেলে বরিশাল সদর উপজেলার লাহারহাট ফেরিঘাটে চোখে পড়ে পারাপারের অপেক্ষায় থাকা ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও মাইক্রোবাসের দীর্ঘ লাইন। সব মিলিয়ে অর্ধশতাধিক যানবাহন পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছে। কোন কোন পরিবহন গত ২দিন ধরে আটকে থাকলেও ঘাট পর্যন্ত পৌছতে পারেনি। ওইসব পরিবাহনের শ্রমিকদের থাকা খাওয়া সবই হচ্ছে ফেরিঘাটে ।
সাতক্ষীরা থেকে পেঁয়াজ নিয়ে আসা পণ্যবাহী ট্রাকের চালক আফজাল শরীফ বলেন, ভোলার বাংলা বাজার যাব। এজন্য শুক্রবার বিকালে বরিশাল লাহারহাট ঘাটে এসেছি। প্রথম দিন যেখানে এসে ট্রাক থামিয়েছি তার থেকে কিছুটা সামনে এগোতে পারলেও ফেরিঘাট এখনও অনেক দূর।
খুলনা থেকে আসা ট্রাক চালক মিজানুর রহমান বলেন, খুলনা থেকে বরিশালে পৌছাতে যে ভোগান্তি পোহাতে হয় লাহারহাট ফেরিঘাটে তার থেকে কয়েকগুন বেশি ভোগান্তিতে আছেন। শনিবার দুপুরে পল্ট্রিফিড নিয়ে এখানে পৌছালেও ফেরী ঘাট পর্যন্ত যেতে পারিনি। এজন্য ক্ষোভ প্রকাশ করে এই চালক বলেন, আমার পড়ে এসেছে এমন কয়েকটি ট্রাক ফেরি পার হয়ে গন্তব্যে পৌছে গেছে। কিন্তু ঘাটের লোককে বাড়তি
টাকা না দেয়ায় ওভারলোডের অজুহাত দেখিয়ে আমাকে আটকে রাখা হয়েছে।
তিনি বলে, আমাদের ঘাটের টোল, ফেরি ভাড়াসহ সকল খরচ মহাজন পূর্বে থেকেই হিসাব করে দেয়। ঘাটে বাড়তি টাকা দিতে হলে তা নিজেদের পকেট থেকেই দিতে হয়। লাহারহাট ঘাটে এমন স্বেচ্ছাচারিতা মাওয়া-দৌলতদীয় ঘাটকেও হারমানায় বলে মন্তব্য করেন যশোর থেকে আসা মোসলেম তালুকদার নামের এক ট্রাক চালক।
সূত্র জানিয়েছে, লাহারহাট ফেরী ঘাটের কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা বিআইডব্লিউটিসির টার্মিনাল সহকারী সোহেল খান ৪র্থ শ্রেণি কর্মচারী ও বহিরাগতদের নিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে। লাহারহাট থেকে ভেদুরীয়া পর্যন্ত এক টন থেকে ১১ টন পর্যন্ত পণ্যবাহী যানবাহনের সরকার নির্ধারিত ফেরি ভাড়া ৯২০ টাকা থেকে ১ হাজার ৮৫০ টাকা। আর ১০ চাকার সাধারণ পরিবহনের ভাড়া সর্বোচ্চ ২৬৭০ টাকা।
কাগজে কলমে এমনটি থাকলেও সোহেল খান প্রতি ১ থেকে ৩ টন পর্যন্ত যে কোন ট্রাকের ভাড়া আদায় করছেন ১৭৭০ টাকা। সাথে আগে ফেরি পার হতে হলে তাকে দিতে হচ্ছে এক থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত। এরপর ওজন বেশি হলে বাড়তি ভাড়ার বিষয়টি তো রয়েছেই।
লাহারহাট ঘাটে শুধুমাত্র ফেরি ভাড়া নয়, ঘাটে পৌছতেই যানবাহন শ্রমিক ও মালিকদের পদে পদে গুনতে হয় আরও মোটা অংকের চাঁদা। যার কোনটির রশিদ দেয়া হয় আর কোনটির দেয়া হয় না। এর মধ্যে লাহারহাট ঘাটে ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নকে ২৭০ টাকা, ট্যাংকলড়ী শ্রমিক সংগঠনে ৬০ টাকা, বিআইডব্লিউটিসির ঘাটের টোল সর্বনিম্ন ৫৮ টাকা এবং মসজিদের উন্নয়নের নামে আরও ২০ টাকা বাধ্যতামূলক ভাবে আদায় করা হচ্ছে। নামে বেনামে হওয়া চাঁদাবাজির একটি অংশ স্থানীয় প্রশাসনের মাসহারা হিসেবে যাচ্ছে। কিছু অংশ যাচ্ছে রাজনৈতিক নেতাদের পকেটে।
অভিযোগ প্রসঙ্গে লাহারহাট ফেরীঘাটের দায়িত্বে থাকা বিআইডব্লিউটিসির সহকারী ব্যবস্থাপক শিহাব উদ্দিন বলেন, অনেকে আগে যেতে না পেরে অভিযোগ করে থাকেন। তবে সব অভিযোগ যে মিথ্যা তাও নয়। যারা অনিয়ম করছে তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।
শিহাব উদ্দিন বলেন, আমাদের এখান থেকে প্রতিদিন গড়ে ১৩০টির মতো গাড়ি পার হচ্ছে। ছোট বড় ৩টি ফেরিতে গাড়িগুলো পার করা হচ্ছে। এখানে ২/৩ দিন আটকে থাকার মত চাপ নেই। তবে নদীতে ডুবচরের কারণে কিছু সমস্যা হচ্ছে। ডুবচরের কারণে দীর্ঘ এলাকা ঘুরে ফেরি চলাচল করছে। এজন্য আগে যেখানে পারাপারে দেড় ঘন্টা লাগতো সেখানে এখন দুই ঘন্টাও লাগছে। আবার নদীতে পানি কম থাকলে বড় ২টি ফেরি চলতে পারে না। সেময় গাড়ির জাম সৃষ্টি হতে পারে।
তাছাড়া চাঁদপুর, মাওয়া, দৌলতদীয়া ঘাটে যখন গাড়ির চাপ বেশি থাকে তখন লাহারহাটেও চাপ বাড়ে। ওই সময় কিছুটা অনিয়ম হতে পারে। তবে লাহারহাটের কাউন্টারে দায়িত্বে থাকা সোহেল খানের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়টি খোঁজ খবর নিয়ে দেখবেন বলে জানান শিহাব উদ্দিন।
বিআইডব্লিউটিসির বরিশাল অঞ্চলের সহকারী মহাব্যবস্থাপক সৈয়দ আবুল কালাম আজাদ বলেন, লাহারহাট-ভেদুরীয়া ঘাটে পূর্বে কিছু অনিয়ম ছিল। সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বর্তমানে অনিয়ম নেই বলেই আমি জানি। তবে বাড়তি টাকা আদায়ের বিষয়ে কোন চালক বা ব্যক্তি প্রমাণ দিতে পারলে অভিযুক্তর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।