ভোলা নিউজ২৪ডটকম।। এ ব্যবসায় তারা বিনিয়োগ করেছেন শত শত কোটি টাকা, বাস্তব আয়ের সঙ্গে যার লেশমাত্র মিল নেই * ঝামেলা এড়াতে স্ত্রী-সন্তানের নামেও মালিকানা দেখিয়েছেন কেউ কেউ।
নৌপথের শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব যাদের তারা নিজেরাই বনে গেছেন পুরোদস্তুর জাহাজ ব্যবসায়ী! অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, বিআইডব্লিউটিএর (অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ) বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা নামে-বেনামে একাধিক বিশালাকার জাহাজের মালিক।
নিজস্ব শিপিং লাইন্স ব্যবসায় শত কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে তাদের। অথচ তাদের চাকরিজীবনের বেতন-ভাতা দিয়েও একটি জাহাজ কেনা সম্ভব হবে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত ঘুষ-দুর্নীতির টাকায় ফুলেফেঁপে উঠেছে তাদের বিত্তবৈভব।
যুগান্তরের মাসব্যাপী অনুসন্ধানে বিআইডব্লিউটিএর অন্তত ১২ জন কর্মকর্তার সঙ্গে জাহাজ ব্যবসার সংশ্লিষ্টতা উঠে আসে। সরকারি চেয়ারের ক্ষমতা অপব্যবহার করে নিজেদের আখের গুছিয়েছেন তারা।
অঢেল টাকা উপার্জনের পর তাদের অনেকে এখন চাকরি ছেড়ে নিরাপদে সরে পড়ার উপায় খুঁজছেন। এসব কর্মকর্তার প্রধান দায়িত্ব হল জাহাজের রুট পারমিট দেয়া, নদী ও ঘাট ব্যবস্থাপনা মনিটরিং, ড্রেজিং, বয়াবাতি সংরক্ষণ করা প্রভৃতি।
তবে রুট পারমিট দেয়ার ক্ষেত্রে অনেক শর্ত পূরণ সাপেক্ষে অনুমোদন দেয়া হয়। এক্ষেত্রে পর্দার আড়ালে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে বিআইডব্লিউটিএর উপ-পরিচালক আবু বকর ছিদ্দিকের সরকারি কর্মকর্তা পরিচয় চাপা পড়েছে বহু আগেই। নামে-বেনামে তিনি অন্তত ১৫টি জাহাজের মালিক। জাহাজ ব্যবসা থেকে নিজেকে আড়াল করতে তার কৌশল অনেকটা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো।
তিনি বেশিরভাগ জাহাজের মালিকানাসংক্রান্ত কাগজপত্র করেছেন তার স্ত্রী ইসরাত জাহান পাপড়ির নামে। তার মালিকানাধীন জাহাজগুলোর নাম হচ্ছে- ঢাকা-ঈদগাঁ ফেরিঘাট রুটে চলাচলকারী এমভি রাজহংস-৭ (এম-৬৭৮৬), ঢাকা-ভাসানচর রুটের রাজহংস-৮ (এম-৯৯৭৭), ঢাকা-ভাসানচর রুটের রাজহংস-১০ (এম-০১-২০৭৭) এবং ঢাকা-নুরাইনপুর-কালাইয়া রুটে চলাচলকারী বন্ধন-৫ (এম-০১-১২১৮)।
এর মধ্যে রাজহংস-১০ জাহাজটির যাত্রী ধারণক্ষমতা ৬১৬ জন। ১৫ কোটি টাকা মূল্যের জাহাজটি গত বছর ৯ এপ্রিল রেজিস্ট্রেশন পারমিট পায়।
এছাড়া এমভি রাজহংস-৭ এবং ৮-এর প্রতিটির মূল্য ১৩-১৪ কোটি টাকা করে। বন্ধন-৫ নামের জাহাজটিও সুবিশাল। এর পরিচালনায় ১৮ নাবিক নিয়োগ করা হয়েছে।
রাজহংস-৮ জাহাজের মালিক হিসেবে ইসরাত জাহান পাপড়ি জাহাজ মালিক সমিতির সদস্য হন। তার সদস্য নম্বর-৭৩। তবে তিনি কখনই মালিক সমিতির সাধারণ সভায় যোগ দেননি।
কোম্পানির কাগজপত্রে সই-স্বাক্ষর সবই সিদ্দিকের। মালিক সমিতির সবাই জানেন স্ত্রীকে মালিক সাজালেও জাহাজের আসল মালিক আবু বকর ছিদ্দিক।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, যাত্রীবাহী জাহাজ পরিচালনার জন্য ইসরাত জাহান পাপড়িকে মালিক দেখিয়ে দুটি কোম্পানি খোলা হয়। এর একটি হচ্ছে মেসার্স বে-ওয়াটার সার্ভিস লিমিটেড।
যার ঠিকানা- সদরঘাট বিআইডব্লিউটিএ কার্যালয় সংলগ্ন ৪/২ সি, সিমসন রোডের ৪র্থ তলা। আরেক কোম্পানির নাম- মেসার্স বন্ধন ওয়াটার ওয়েজ। কোম্পানির ঠিকানা হচ্ছে- ৩১/৩২ ব্যাকল্যান্ড বাঁধ রোড, ওয়াইজঘাট।
যাত্রীবাহী জাহাজের পাশাপাশি বেনামে শিপিং লাইন্সের (কার্গো জাহাজ) ব্যবসাও আছে আবু বকর ছিদ্দিকের। কোম্পানির নাম আল-জামিউ শিপিং লাইন্স লিমিটেড। এ কোম্পানির ঠিকানা মতিঝিলের ২৮/সি-১, টয়েনবি সার্কুলার রোড (৪র্থ তলা)।
৪ নভেম্বর সেখানে গেলে দেখা যায়, অফিসের বাইরে সাইনবোর্ডে লেখা ‘আল জামিউ শিপিং লাইন্স, বাংলাদেশ ভারত প্রটোকল রুটে পণ্য পরিবহনকারী নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান।’
ভেতরে ঢুকে জাহাজ ভাড়া নেয়ার জন্য কথাবার্তা হয় ম্যানেজার তরিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক জাহাজ আছে।
এর মধ্যে আল জামিউ-১, ২ এবং ৩ নামের লাইটার জাহাজ বেশিরভাগ প্রটোকল পণ্য পরিবহন করে। তবে বড় ট্রিপ পেলে অন্য ভাড়াও আমরা ধরি। সুনির্দিষ্ট কার্যাদেশ ছাড়া আমরা কোনো ভাড়া চুক্তি করি না।’
বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক নেতা যুগান্তরকে বলেন, প্রটোকল পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে আবু বকর ছিদ্দিক অনিয়মের মাধ্যমে সিরিয়াল ভেঙে নিজের জাহাজ ঢুকিয়ে দেন। কারণ প্রটোকল পণ্যের প্রতি টিপে ৪-৫ লাখ টাকা ভাড়া পাওয়া যায়।
ভাড়া বেশি হওয়ার কারণে প্রটোকল পণ্য পরিবহনে সবাই আগ্রহী। ছিদ্দিকের অনিয়মের বিষয়ে জাহাজ মালিকরা বিআইডব্লিউটিএতে একাধিকবার অভিযোগ জানালেও কোনো ফল হয়নি।
দুর্নীতির ১২ গোলাপ : বিআইডব্লিউটিএর সাবেক এবং বর্তমান ১২ কর্মকর্তা যৌথভাবে ‘ডজন রোজ’ বা ১২ গোলাপ নামে একটি কোম্পানি গড়ে তুলেছেন। এ কোম্পানির বহরে ইতোমধ্যে একাধিক জাহাজ চলাচল করছে। আরও বেশ কয়েকটি জাহাজ নির্মাণাধীন।
এর মধ্যে রূপগঞ্জের আলম মেরিন শিপ বিল্ডার্সের ডকইয়ার্ডে নির্মিত হচ্ছে ডজন রোজ-১ (এম-২০-৭৪৬) নামের একটি বিশালাকার জাহাজ। ডজন রোজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াজুল ইসলাম ওরফে মনিরের নামে জাহাজটি নিবন্ধিত।
সরেজমিন জাহাজ নির্মাণ দেখতে যুগান্তরের অনুসন্ধান টিম ২৫ অক্টোবর হাজির হয় রূপগঞ্জের পূর্বগ্রামে অবস্থিত আলম ডকইয়ার্ডে। দেখা যায়, গেট ভেতর থেকে বন্ধ। ছোট ফাঁক গলে একজন নিরাপত্তারক্ষী জানতে চান কোথা থেকে এসেছেন। বলা হয়, ‘মনির স্যারের (রিয়াজুল ইসলাম) জাহাজ দেখতে এসেছি, গেট খোলেন।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই গেট খুলে যায়। ভেতরে ঢোকার পর ডকইয়ার্ডের কর্মচারীরা নির্মাণাধীন একটি জাহাজ দেখিয়ে বলেন, ওই যে দেখছেন বিশাল জাহাজটি, ওটাই মনির স্যারের জাহাজ। বালুমহাল ডক এলাকা ঘুরে দেখা যায়, দীর্ঘ এলাকাজুড়ে জাহাজ নির্মাণের কর্মযজ্ঞ চলছে। লোহা-লক্কড় পেটানো এবং ঝালাইয়ের কাজে ব্যস্ত শ্রমিকরা।
একসঙ্গে ৩-৪টি জাহাজের নির্মাণ কাজ চলছে। কিছুদূর হাঁটার পর দেখা যায় ডজন রোজ-১ নামের বিশালাকার জাহাজটি পানিতে নামানোর প্রস্তুতি চলছে। জাহাজের পেছনে মোটা দড়ি বাঁধার কাজ করছেন শ্রমিকরা। ২-১ দিনের মধ্যেই নদীতে ভাসানো হবে।
ডকইয়ার্ডের প্রকৌশলীরা জানান, এ ধরনের একটি জাহাজ নির্মাণে ১৬ থেকে ২০ কোটি টাকা খরচ হয়। ডকইয়ার্ডে জাহাজ মালিকের নিয়োগকৃত কর্মচারী বা লস্কর আনসার আলী যুগান্তরকে বলেন, জাহাজ নির্মাণ তদারক করতে মাঝে মাঝেই এখানে আসেন রিয়াজুল ইসলাম ওরফে মনির।
তাছাড়া অন্যরা নিয়মিত মোবাইল ফোনে খোঁজখবর নেন। ডজন রোজ-১ এর সার্ভে সনদসংক্রান্ত কাগজপত্র খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, জাহাজটি বিআইডব্লিউটিএর খুলনা অফিসে নিবন্ধিত।
যুগান্তরের খুলনা ব্যুরোর স্টাফ রিপোর্টার নুর ইসলাম রকি জানান, ডজন রোজ-১ জাহাজটির রেজিস্ট্রেশনের জন্য গত ৪ ডিসেম্বর আবেদন জমা দেয়া হয়।
অবিশ্বাস্য দ্রুততায় মাত্র দেড় মাসের মাথায় সার্ভে রিপোর্ট এবং রেজিস্ট্রেশন সনদ দিয়ে দেয় বিআইডব্লিউটিএ। রেজিস্ট্রেশন সনদে ডজন রোজ লিমিটেড কোম্পানির ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে রাজধানীর তোপখানা রোডের ২৭/৫/অ-বি।
যুগান্তরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, আবু বকর ছিদ্দিক ছাড়া আরও ১১ সাবেক-বর্তমান বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তা ডজন রোজ কোম্পানির সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে যুক্ত।
এদের মধ্যে জনৈক রফিকুল ইসলাম, বরখাস্ত নিুমান সহকারী এমদাদুল হক (এমভি সুমনা হক জাহাজের মালিক), জনৈক আবু তাহের, জনৈক আবু সালেহ কাইয়ুম, শাহজাহান সিরাজ, আবদুল আওয়াল এবং অবসরপ্রাপ্ত দুই কর্মকর্তা মাহবুবুল আলম ও শফিকুল হক অন্যতম।
এদের দ্বারা পরিচালিত জাহাজগুলো হচ্ছে- এমভি সুমনা হক, শাহরুখ-১, ২; রিজেন্ট-১০, এমভি সোহেলী এবং এমভি স্বর্ণদ্বীপ-৪।
বক্তব্য : জাহাজ ব্যবসা সম্পর্কে বক্তব্য জানতে উপ-পরিচালক আবু বকর ছিদ্দিকের মোবাইল নম্বরে ফোন করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। মতিঝিল বিআইডব্লিটিএ অফিসে একাধিকবার গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।
তবে ছিদ্দিকের আল-জামিউ শিপিং লাইন্সের ব্যবসায়িক অংশীদার মোক্তার হোসেন মঙ্গলবার রাত ১০টায় যুগান্তরকে বলেন, আল জামিউ শিপিং লাইন্সের মোট চারজন অংশীদার। আবু বকর ছিদ্দিক তার স্ত্রীর নামে শেয়ার কিনেছেন।
সরকারি কর্মকর্তা এ ধরনের ব্যবসায় জড়িত হতে পারে কি না প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা তো এত সব নিয়মকানুন জানি না। তবে তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো, তিনি আমাদের সঙ্গে একটা ব্যবসায় আসতে চেয়েছেন আমরা তাকে না করতে পারিনি।’