ভোলা নিউজ২৪ডটকম।। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমি ঘোষণা দিয়েছিলাম- বিশ্বব্যাংক টাকা বন্ধ করেছে আমরা নিজের টাকায় এই পদ্মা সেতু তৈরি করবো, করেছি। জনতার শক্তিই ছিলো আমার শক্তি।
পদ্মা সেতু তৈরি করে অপমানের একটা জবাব দিতে পারলাম।
শনিবার (২৫ জুন) শিবচরের কাঁঠালবাড়িতে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।
পদ্মা সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী ফেরিঘাটে এ জনসভার আয়োজন করা হয় ৷ দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনসভা মঞ্চে আসেন।
বিশাল জনসভায় উপস্থিত মানুষের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আজকে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য বিশেষ দিন।
আমরা কিছুক্ষণ আগেই স্বপ্নের সেতু- পদ্মা সেতু উদ্বোধন করে আসলাম। আলহামদুলিল্লাহ। জাতির পিতা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার যাত্রা যখন শুরু করলেন- মাত্র সাড়ে তিন বছর হাতে সময় পেয়েছিলেন। এই সময়ে ধ্বংসস্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ করেন। যখন দেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তৃণমুল পর্যন্ত ক্ষমতা নিয়ে যান- দুর্ভাগ্য আমাদের জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হলো। রেহানা ও আমি বিদেশে ছিলাম। দেশে আসতে পারিনি। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ আমাকে সভানেত্রী নির্বাচিত করে। শত বাধা পেরিয়ে আমি আপনাদের মাঝে আসি। আমার লক্ষ্য জাতির পিতার সেই স্বপ্ন পূরণ করা। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করা। দেশের মানুষের জন্য উন্নত জীবন নিশ্চিত করা। অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে আজকে আমরা বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছি। আজকে বাংলাদেশ খদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আজকে আমরা বিনাপয়সায় বই দিচ্ছি। প্রতিটি এলাকায় স্কুল করে দিচ্ছি কলেজ করে দিচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয় করে দিয়ে শিক্ষার দ্বার উন্মোচন করেছি। কমিউনিটি ক্লিনিক করে দিয়ে মানুষের ঘরের কাছে চিকিৎসার সেবার ব্যবস্থা করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার ওয়াদা ছিলো প্রত্যেক ঘরে আলো জ্বলবে। আজকে বাংলাদেশের প্রত্যেক ঘরে ঘরে আমরা বিদ্যুত পৌঁছে দিয়েছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলবো বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। আজকে ডিজিটাল বাংলাদেশ। সবার হাতে মোবাইল ফোন। সবাই আজকে অনলাইনে কেনাবেচা করতে পারেন- সেই ব্যবস্থা আমরা করেছি। মানুষের জীবন জীবিকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। উন্নত জীবন যাতে সবাই পায় সেই ব্যবস্থা আমরা করবো। বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাটা অব্যাহত রাখতে পেরেছি। এই একটা কারণে বাংলাদেশের জনগণ ভোট দিয়েছে। নির্বাচিত হয়েছি এবং এদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করে যাচ্ছি।
পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা জানেন এই সেতু নির্মাণের জন্য সেই ২০০১ সালে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলাম। খালেদা জিয়া এসে তা বন্ধ করে দিয়েছিল। আমরা ২০০৯ এ সরকারে এসে আবার পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করি। তখন তারা কী বলেছিল? বলেছিল আওয়ামী লীগ কোনোদিনও নাকি পদ্মা সেতু করতে পারবে না। খালেদা জিয়াকে জিজ্ঞাসা করি আসুন, দেখে যান পদ্মা সেতু নির্মাণ হয়েছে কী না? আমাদের অনেক জ্ঞানীগুণী লোক ছিলো, অর্থনীতিবিদ- বড় বড় আমলা ছিলেন- সবাই বলেছেন নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু সম্ভব নয়। আজকে নিজেদের টাকায় কিভাবে করতে পারলাম? এই বাংলাদেশের জনগণ, আপনারা আমাকে সমর্থন দিয়েছেন। পাশে দাঁড়িয়েছেন। জনগণের শক্তি সবথেকে বড় শক্তি। কী বলেন আপনারা? সেটা বিশ্বাস করেন তো? জনগনের শক্তিই বড় শক্তি। আমি সেটাই বিশ্বাস করেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, যখন ওই ড. ইউনূস তার ওই গ্রামীন ব্যাংকের এমডি থেকে চলে যেতে হলো। ওয়ার্ল্ড ব্যাংককে তদ্বির করে আমেরিকায় তদ্বির করে পদ্মা সেতুর টাকা বন্ধ করে দিলো। বলল, দুর্নীতি হয়েছে। কে দুর্নীতি করেছে? যে সেতু আমাদের প্রাণের সেতু। যে সেতুর সঙ্গে আমার দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য জড়িত, সেই সেতু করতে গিয়ে কেন দুর্নীতি হবে? তারা (বিশ্ব ব্যাংক) টাকা দেয়নি। অথচ দুর্নীতির ষড়যন্ত্র বলে টাকা বন্ধ করে দিল। আমি ঘোষণা দিয়েছিলাম টাকা বন্ধ করেছো ঠিক আছে। বাংলাদেশ বসে থাকবে না। আমরা নিজের টাকায় এই পদ্মা সেতু তৈরি করবো। অনেকে অনেকভাবে চেষ্টা করেছে। অনেক কথা বলেছে যে, এই সেতু নাকি আমরা করতেই পারবো না। আমি আগেই বলেছি আমরা একমাত্র শক্তি আপনারাই। আমার একমাত্র শক্তি বাংলার জনগণ। বাবা-মা-ভাই-বোন সব হারিয়ে নিঃস্ব-রিক্ত হয়ে ফিরে এসেছিলাম এই বাংলাদেশে। সমগ্র বাংলাদেশ ঘুরে বেরিয়েছি। নৌকায় করে করে এক একটা এলাকায় গিয়েছি। কাঁদা-পানিতে নেমেছি। মিটিং করেছি ৷ আমরা রাস্তাঘাট-ব্রিজ করেছি। সবার জন্য যোগাযোগ হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের দোয়ারিকা, শিকারপুর, গাবখান থেকে শুরু করে পায়সা পর্যন্ত সেতু বানিয়ে
দিয়েছি। যাতে এ এলাকার মানুষ নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে।
তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর টাকা বন্ধ করে দেওয়ার পর যখন আমি উদ্যোগ নিলাম- আপনাদের সাহস, আপনাদের শক্তি, জনতার শক্তি। সেই শক্তিই ছিলো আমার শক্তি। আর সেই শক্তি নিয়েই কাজ করেছিলাম। আজকে আলহামদুলিল্লাহ আমরা সেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছি। আর আপনাদের কষ্ট করতে হবে না। এই পদ্মা নদী খরস্রোতা। এই নদী পার হতে যেয়ে আর কাউকে সন্তান হারাতে হবে না। বাবা-মাকে হারাতে হবে না। ভাইবোনকে হারাতে হবে না। আজকে আপনার নির্বিঘ্নে চলতে পারবেন। সেই ব্যবস্থা আমরা করে দিয়েছি। আর যারা বাধা দিয়েছিল- তাদের একটা জবাব আমরা দিয়েছি। তাদেরকে উপযুক্ত একটা জবাব- এই পদ্মা সেতুর মধ্য দিয়ে আমরা দিতে পারলাম। বাংলাদেশ পারে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন কেউ দাবায়া রাখতে পারবা না। বাঙালিকে কেউ দাবায়া রাখতে পারেনি। ভবিষ্যতেও পারবে না। জাতির পিতা সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন পূরণ করে যেতে পারেননি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার সারা দেশে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে ৷ পদ্মা সেতু আমরা নির্মাণ করেছি। এখানেও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে। শিল্প কলকারাখানা হবে। আমাদের ফসল উৎপাদন হবে। সেই ফসল আমরা প্রক্রিয়াজাত করতে পারবো। দেশে-বিদেশে রফতানি করতে পারবো। আমাদের মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ করে দেশে-বিদেশে রফতানি করতে পারবো। বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ ঘুচে যাবে। তাদের ভাগ্য পরিবর্তন হবে। অনন্ত ২১টি জেলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হবে। সেটা আমরা করতে পারবো। এ অঞ্চলের সার্বিক উন্নতি অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হবে।
সিলেটের বন্যার প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বন্যার সঙ্গে আমাদের বসবাস। সিলেটে বন্যা হয়েছে। আমরা সেখানে ত্রাণ পাঠিয়েছি। এখন বর্ষাকাল। আমাদের এই অঞ্চলে বন্যা হতে পারে। এখন থেকে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। আপনারাও প্রস্তুতি নেবেন। যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার শক্তি বাংলাদেশ রাখে। বাংলাদেশের জনগণ রাখে। সেই ব্যবস্থাও আপনাদের নিতে হবে। বাংলাদেশের একটি মানুষও ভূমিহীন গৃহহীন থাকবে না। সব মানুষকে আমরা ঘর তৈরি করে দেবো। আমরা তা দিচ্ছি। পদ্মা সেতু তৈরি করতে গিয়ে যারা জমি দিয়েছেন তাদের সবাইকে বসবাসের জমি ও ঘর করে দেওয়ার পাশাপাশি জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি ৷ ঠিক সেই ভাবে বাংলাদেশের প্রতে্যকটি মানুষকে আমরা ঘর করে দেবো। প্রতিটি মানুষ সুন্দরভাবে যাতে বাঁচতে পারে সেই ব্যবস্থা করে দিতে পারবো এবং বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন করে জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণ করবো এটাই আমাদের প্রতিজ্ঞা।
জনসভায় উপস্থিত জনগণের উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা বলেন, আজকে আপনারা পদ্মা সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সমাবেত হয়েছেন। আপনারা সম্মিলত হয়েছেন এজন্য কৃতজ্ঞতা জানাই। কেউ রাতে রওয়ানা দিয়েছেন। কেউ ভোরে এসে বসে আছেন। কষ্ট শিকার করে এখানে এসেছেন। নাওয়া-খাওয়া সব বাদ দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে আপনারা এই সভায় এসে আমাদের অনুষ্ঠানকে সাফল্যমণ্ডিত করেছেন। একটা কথা মনে রাখবেন এই বাংলাদেশের মানুষের জন্য আমার বাবা-মা-ভাইয়েরা জীবন দিয়ে গেছেন। আমি ও আমার ছোটবোন বেঁচে আছি। আমাদের পদ্মা সেতু করতে গিয়ে অনেক অসম্মান করার চেষ্টা করা হয়েছে। অনেক অপমান করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের উপদেষ্টা, আবুল হোসেন, সচিব মোশাররফ হোসেনসহ অনেককে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে অপমান করা হয়েছে। আমার ছেলেমেয়ে জয়-পুতুল। আমার বোনের ছেলে ববিসহ অনেককে কত মানসিক যন্ত্রণা তারা দিয়েছে। কিন্তু আমরা পিছু হঠিনি। আমাদের একটাই লক্ষ্য ছিলো- এই সেতু নির্মাণ করবো। আমাদের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করবো। আমরা তা করতে পেরেছি। সেই সাহস দিয়েছেন আপনারা- শক্তি দিয়েছেন আপনারা। আমি আপনাদের পাশে আছি।
দেশের মানুষকে উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এক ইঞ্চি জমিও যেন পড়ে না থাকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আজকে সারা বিশ্বব্যাপী খাদ্যের অভাব। বাংলাদেশে যেন খাদ্যের অভাব না হয় সেজন্য যার যেটুকু জমি আছে যে যা পারেন তাই উৎপাদন করবেন। নিজে খাবেন অপরকে দেবেন। বাজারে পাঠাবেন। কোনো জায়গায় এক ইঞ্চি জমি বাদ না যায় সেভাবে কাজ করবেন। এই দেশ আপনাদের। এই দেশ আমাদের। জাতির পিতা দেশ দিয়ে গেছেন। এই দেশকে আমরা গড়ে তুলবো উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হিসেবে। বাবা-মা সব হারিয়ে পেয়েছি আপনাদের। আপনাদের মাঝে খুঁজে পেয়েছি বাবার স্নেহ, মায়ের স্নেহ। আপনাদের পাশে আমি আছি। আপনাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য আমি যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে সদা প্রস্তুত। এই ওয়াদা আমি দিয়ে গেলাম। আপনাদের জন্য প্রয়োজনে আমার নিজের জীবনটা দেবো। সবার কাছে দোয়া চাই যেন পিতার স্বপ্ন পূরণ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।
এ সময় জনসভা মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য শাজাহান খান, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন, আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ডক্টর আবদুস সোবহান গোলাপ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। জনসভায় সভাপতিত্ব করেন মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ মোল্লা।
জনসভায় ওবায়দুল কাদের বক্তব্য রাখেন ৷ জনসভা মঞ্চে প্রধানমন্ত্রী পৌঁছানোর আগে সেখানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন ৷