ভোলা নিউজ ২৪ ডটনেটঃ মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রিত কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে বেশিরভাগ রোহিঙ্গা জীবনের নিশ্চয়তার পাশাপাশি মাথাগোঁজার ঠাঁই এবং খাদ্যসামগ্রী পেলেও এখনো তাদের ভাগ্যে জোটেনি প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্র। নারী-শিশুরা শীতবস্ত্রের অভাবে জ্বর, কাশিসহ ঠাণ্ডাজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, কয়েক দশক আগে বাংলাদেশ থেকে নির্মূল হওয়া ডিপথেরিয়াও কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে ছড়িয়ে পড়েছে।
শীতের শুরুতেই ঠাণ্ডা কম হলেও গত কয়েকদিন ধরে বয়ে যাচ্ছে শৈত্যপ্রবাহ। নারী-শিশু ও বয়স্ক রোহিঙ্গারা ছাড়াও ঝুপড়ি ঘরসহ শিবিরের বাইরে থাকা রোহিঙ্গারা প্রচণ্ড শীতে কাঁপছে। দু’চারজনের ঘরে থাকলেও, অধিকাংশের ঘরেই নেই শীত নিবারণের কম্বল। তাই দিনের বেলায় কুড়ানো লাকড়ির পরিত্যক্ত অংশ জ্বালিয়ে কোনো রকমে শীত থেকে বাঁচার ওপায় খোঁজার চেষ্টা অসহায় মানুষগুলোর।
প্রতিটি রোহিঙ্গা শিবিরে লাখো মানুষের বাস। এসব ঝুপড়িতে কনকনে রাত পেরিয়ে যখন ভোরের সূর্য আলো ফেলে, তখন যেন প্রাণ ফিরে পায় শীতবস্ত্রহীন এসব রোহিঙ্গা। ক্যাম্পের ভেতরে ইদানীং বসেছে শীতবস্ত্রের বাজার। হাতেগোনা কিছু রোহিঙ্গা এসব শীতবস্ত্র কিনতে পারলেও বেশিরভাগের ভাগ্যে সান্ত¡না শুধু দর কষাকষিতেই। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে টেকনাফ উপজেলার নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত শিবির ও শিবিরের বাইরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা বস্তিতে ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়।
টেকনাফের মৌচনি নিবন্ধিত শিবিরের প্রধান সড়কের সামনে গড়ে উঠেছে নতুন করে শতাধিক রোহিঙ্গাদের ঝুপড়ি ঘর। সেখানে অনেকের ঘরে ছাউনি থাকলেও নিচে কাদা মাটিতে বসবাস করছে এমন এক রোহিঙ্গা নারী তসলিমা আক্তারের সঙ্গে কথা হয়। তার বাড়ি মিয়ানমার কিলাডং গ্রামে।
তিনি জানান, শুরুতে তেমন বেশি শীত লাগেনি। কিন্তু গত দুইদিন ধরে ঠাণ্ডায় খুব কষ্ট হচ্ছে। কথা বলার সময় কোলে ছিল ৫ মাস বয়সের শিশু মিনারা বেগম। তার সর্দি-কাশির প্রভাবে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বিরামহীনভাবে কেঁদে চলেছে। পাশে থাকা অপর দুই সন্তান মামুন ও শফিকার গায়েও গরম কাপড়চোপড় নেই। হাত-পা গুটিয়ে মায়ের পাশে বসে আছে।
তসলিমা আক্তার জানায়, এক কাপড়ে তারা মিয়ানমার ছেড়েছেন। গরম কাপড় তো দূরে, প্রাণ নিয়ে আসাটাও ছিল দুরূহ। এখন শীতে কষ্ট পাচ্ছে সন্তানরা। মিনারা বেগম অসুস্থ হলেও তাকে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। টেকনাফের নয়াপাড়া ত্রাণ কেন্দ্রের পাশে ধানের জমিতে নতুন করে ঘর তৈরি করতে দেখা যায়। শুধু ঘরের ছাউনি দিতে পেরেছেন কেউ কেউ। তাদের মধ্যে অনেকে আবার ছাউনি দিতে পারেনি। বাঁশের বেড়া ও পলিথিনের ছাউনিযুক্ত ১৫ ফুট লম্বা একটি ঝুপড়িঘরে গাদাগাদি করে থাকছেন পরিবারের ২০ নারী ও শিশু। নারীদের সঙ্গে আছে পাঁচ মাস থেকে ছয় বছর বয়সী অন্তত ৫ জন শিশু। ঠাণ্ডায় (শীতে) বেশিরভাগ শিশু সর্দিজ্বর ও কাশিতে আক্রান্ত। কিছু শিশুর গায়ে কাপড়ও নেই। আমরা কেউ ইচ্ছা করে এখানে পালিয়ে আসিনি। আত্মীয়-স্বজন, ঘরবাড়ি-সহায়-সম্বল সবকিছু হারিয়েছি।
তিনি আরো বলেন, শিশুদের কান্নাকাটি আর হৈ চৈয়ের জন্য এই ঝুপড়িঘরে কারো ঘুম হয় না। রাতে ঝুপড়িঘরের বাঁশের বেড়া দিয়ে যখন ঠাণ্ডা বাতাস ঢোকে তখন শিশুরা কান্নাকাটি শুরু করে। একটা কম্বল কিংবা গরম কাপড় দিয়ে শিশুদের শীত নিবারণেরও কোনো জো-নেই। এর মধ্যে খাবারের সংকটও চলছে।
টেকনাফে লেদা ও নয়াপাড়ার দুই শিবিরে আগে থেকে ৬০ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে। সম্প্রতি সেখানে যোগ হয়েছে আরো প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা। তার আশপাশে রয়েছে প্রায় লাখখানেক। তাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি নারী ও শিশু। নতুন আসা রোহিঙ্গারা ঝুপড়িঘর তৈরি করে, অনেকে শুধু ছাউনি দিয়ে কোনোমতে দিন কাটাচ্ছেন।
টেকনাফ লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা আবদুল মতলব বলেন, মিয়ানমার থেকে নিঃস্ব হয়ে প্রাণে বেঁচে বাংলাদেশে পাহাড়, জঙ্গল ও খোলা জায়গাতে আশ্রয় নিয়েছেন অনেকে। মাথাগোঁজার ঠাঁই এবং খাদ্যসামগ্রী কিছুটা পেলেও এখনো তাদের ভাগ্যে জোটেনি প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্র। তাই বর্তমানে প্রতিদিন সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে (শীতে) ঠাণ্ডায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে অসহায় মানুষগুলো। পাশাপশি ক্যা¤পগুলোতে বাড়ছে ঠাণ্ডাজনিত নানা রোগ-ব্যাধি। গত মঙ্গলবার ঠাণ্ডাজনিত রোগে এক বৃদ্ধা রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। তাকে স্থানীয়ভাবে দাফন করা হয়েছে।
টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা সুমন বড়–য়া বলেন, শীতকালে পাহাড় ও জঙ্গলে আশ্রয় নেয়া নারী-শিশুরাও ঠাণ্ডাজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এর মধ্যে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস, সর্দিজ্বর, কাশি, নিউমোনিয়া, চর্মরোগ, ইনফেকশন, রক্ত ঝরা ও চোখের এলার্জিসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। তবে সকলে যাতে চিকিৎসাসেবা পায় সেই চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমরা প্রতিদিন ২৫০-৩০০ জন রোহিঙ্গাকে চিকিৎসা দিয়ে থাকি। তবে শীতকাল আসার পর থেকে রোগীর সংখ্যাটা বেড়েছেই চলেছে।
এদিকে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ডিপথেরিয়া রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। এখন পর্যন্ত ৭০ জনের মতো ডিপথেরিয়া রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন বলে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোর প্রধান সমন্বয়ক সিরাজুল হক খান জানিয়েছেন। তিনি জানান, সংক্রামক ব্যাধি ডিপথেরিয়া আক্রান্তের হাঁচি, কাশির মাধ্যমে খুব দ্রুত অন্যের শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। পরীক্ষায় ডিপথেরিয়া ধরা পড়া অন্তত পাঁচজনের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেছেন কক্সবাজারের একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। নাম না প্রকাশের শর্তে ওই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জানান, ডিপথেরিয়ায় আক্রান্তের গলার পেছন দিকে সরু পর্দা তৈরি হয়। এতে শ্বাসকষ্ট, হৃদযন্ত্রের সমস্যা, পক্ষাঘাত, এমনকি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। টিকা দানের মাধ্যমে এ রোগের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ করা যায়। তবে ব্যাকটেরিয়া ঘটিত এই সংক্রামক রোগের উপসর্গের ভিত্তিতে চিকিৎসা শুরু করার কথা জানিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। সরকারের রোগ পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা-আইইডিসিআর ইতোমধ্যে ওই এলাকায় প্রতিনিধি পাঠিয়েছে।