ভোলা নিউজ২৪ডটকম।। আজ ভয়াল ১২ নভেম্বর। ১৯৭০ সালের এ দিনে ঘূর্ণিঝড় ‘ভোলা’ বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলীয় কয়েক জেলায় আঘাত হেনে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের হিসেবে মৃতের সংখ্যা ছিল ৫ লাখ। কিন্তু বিশ্ব গণমাধ্যম ও বেসরকারি হিসেবে ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় ওই ঝড়ে। ২০১৭ সালের ১৮ মে ওই ঝড়কে ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী হিসেবে লিপিবদ্ধ করে জাতিসংঘের আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও)।
এদিকে ঝড়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দ্বীপ জেলা ভোলা। এতে জেলায় প্রাণহানি ঘটে ১ লাখ ২০ হাজার মানুষের। এছাড়াও বিধ্বস্ত হয়ে যায় কয়েক লাখ বসতঘর। এত ধংসস্তূপ হলেও বর্তমানের মত ইন্টারনেট, মোবাইল, দ্রুত বার্তা পাঠানো ও যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় চার দিন পরে জানতে পারে দেশবাসী। ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘পূর্ব দেশ’ নামে একটি পত্রিকার মাধ্যমে এ খবর ছড়িয়ে পড়ে।
সে সময় পূর্ব দেশ পত্রিকার ভোলা প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন এম হাবিবুর রহমান। সেই আমল থেকেই তিনি এখন সাংবাদিকতা করছেন। বর্তমানে ভোলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি, ভোলা থেকে প্রকাশিত দৈনিক বাংলার কণ্ঠের সম্পাদক ও বাংলাদেশ বেতারের ভোলা প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত আছেন। ঘূর্ণিঝড় ‘ভোলা’ নিয়ে তার সঙ্গে কথা হয় । জানালেন ভয়াল সেই দিনের কথা। বর্ণনা দিলেন পত্রিকায় খবর পাঠানোর চিত্র।
হাবিবুর রহমান জানান, ১৯৭০ সালের ১১ নভেম্বর সকাল থেকেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। সন্ধ্যা থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। এরপর ১২ নভেম্বর ভোর থেকে থেকেই প্রচণ্ড বাতাস ও জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় ভোলার সাত উপজেলা। বিধ্বস্ত হয়ে কয়েক লাখ বসতঘর। সকালে দেখা যায় মরদেহের মিছিল। কেউ মারা গেছে সপরিবারে আবার কেউ হারিয়েছে স্বজনকে। বেঁচে যাওয়া স্বজনরা তাদের পরিবারের সদস্যদের খুঁজতে থাকেন। কেউ পেয়েছেন আবার কেউ পাননি।
তিনি বলেন, সকালে ঝড় থামার সঙ্গে সঙ্গে আমি সংবাদ সংগ্রহে ছোট একটি সাদাকালো ক্যামেরা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে পড়ি। পায়ে হেঁটে মাইলের পর মাইল ছুটেছি। রাস্তা দু’পাশে মরদেহ পড়ে আছে। মেঘনা নদীতে মরদেহ ভাসছে। ছবি তোলা শেষে পৌর শহরের ফিরে আসি। ‘কাঁদো বাঙালি কাঁদো ভোলার গাছে গাছে ঝুলছে লাশ’ শিরোনামে সংবাদ লিখি। ছবিসহ সংবাদটি পূর্ব দেশ পত্রিকায় দ্রুত পাঠানোর জন্য ঢাকায় যাওয়ার লোক খুঁজতে থাকি। পরে সেইদিনই আমার এক আত্মীয়কে পাই। তিনি মাছের ট্রলারে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। তার কাছে আমার লিখা সংবাদ ও ক্যামেরার ফিল্মটি পত্রিকায় অফিসে পৌঁছে দেওয়ার জন্য দেই।
হাবিবুর রহমান বলেন, ঘটনার তিন দিন পর বরিশাল থেকে সেই সময়কার জেলা প্রশাসক মো. হাসেম আলী ভোলায় আসেন। খবর পেয়ে দ্রুত তার কাছে ছুটে যাই। তার সহযোগিতায় পুলিশের ওয়ারলেস দিয়ে পত্রিকা অফিসে যোগাযোগের চেষ্টা করি। প্রথমে জেলা প্রশাসক রাজি না হলেও পরে অনুমতি দেন। আমি পুলিশের ওয়ারলেস দিয়ে পত্রিকা অফিসে যোগাযোগের চেষ্টা করও বার বার ব্যর্থ হই। পরে রাত সাড়ে ১২টার দিকে সংযোগ পাই। তখন আমি পত্রিকা অফিসে সংবাদটির কথা বলতেই তার জানান সন্ধ্যায় আমার লিখা কাগজ ও ফিল্ম তাদের কাছে একজন দিয়ে গেছে। এটি ছাপানো হচ্ছে। ঘটনার চার দিন পর পূর্ব দেশ পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পরই ঢাকাসহ সারাদেশের মানুষ জানতে পারে ভোলার করুন কাহিনীর কথা।
এদিকে ওইদিনের কথা জানান আরেক প্রবীণ সাংবাদিক এমএ তাহের। তিনি বলেন, ওইদিন ভোলার ওপর দিয়ে বয়ে যায় ঘূর্ণিঝড়। আগের দিন সকাল থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ও গভীর রাতে বাতাসের গতি বেড়ে যায়। আশপাশের গ্রাম থেকে অনেক মানুষ পৌর শহরে আসতে শুরু করেন। আমরা তাদের ন্যাশনাল ব্যাংক ও বরিশাল দালাল নামে দুটি ভবনে আশ্রয় দেই। পরে ১২ নভেম্বর ভোরের দিকে বাতাস ও জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় ভোলার সাত উপজেলা।
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী ভোলার দৌলতখান উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নের মদনপুর গ্রামের বাসিন্দা মোঃ কাঞ্চন মিয়া। তিনি বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতের পর জলোচ্ছ্বাস হয়। প্রচণ্ড বাতাস ছিল। আমাদের ঘরে অনেক উঁচু থাকার পরও জলোচ্ছ্বাসে পানি ঢোকে। তখন আমি আমার বাবা, মা ও ভাই-বোনরা ঘরের খাটের ওপর বালিশ ও কাঁথা দিয়ে উঁচু করে বসে ছিলাম। পরে সকালে জোয়ারের পানি নেমে গেলে ঘর থেকে বের হয়ে দেখি অনেক মানুষ মরে পড়ে আছে। অনেক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়।’
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী মো. রফিজল ইসলাম বলেন, ‘ঝড়ে আমাদের ঘরটি ভেঙে যায়। ১১ নভেম্বর রাতে আমি বাবা-মা, বোন ও এক খালা অন্য একটি বাড়িতে আশ্রয় নিলে সে ঘরটিও ভেঙে যায়। পরে তারা একটি মোটা কাঁঠাল গাছের ওপর আশ্রয় নেই। জলোচ্ছ্বাসের ঢেউ আমাদের গায়ের ওপর দিয়ে এককে পর এক চলে গেলেও শক্ত করে গাছ ধরেই রাখি। সকালে পানি কমে গেলে গাছ থেকে নেমে দেখি পুরো গ্রামের ঘরবাড়ি ভেঙে খোলা মাঠে পরিণীত হয়েছে। আশপাশে অনেক মানুষের মরদেহ পড়ে আছে।’
স্বজনহারা রোকসানা আক্তার জানান, ‘১২ নভেম্বর ঝড়ের সময় আমার বয়স ১০ বছর। ওই ঝড়ে আমার এক খালা ও নানিরা চার বোন পানিতে ভেসে গেছেন। চার দিন পর তাদের মরদেহ অনেক দূরে গিয়ে পাওয়া যায়। পরে তাদের কবর দেওয়া হয়।’
ভোলা ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) উপ-পরিচালক মো. আব্দুল রশীদ বলেন, ১৯৭০ সালের দিকে কোনো আশ্রয়কেন্দ্র ছিল না। তেমন বেড়িবাঁধ ছিল না। এমনকি সিপিপিও ছিল না। যার কারণে ওই সময় ভোলায় এমন প্রাণহানি ঘটে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ভোলায় ৭৪৬টি সাইক্লোন শেল্টার, শক্ত বেড়িবাঁধ হয়েছে। একই সঙ্গে সিপিপির ১৩ হাজারের অধিক সদস্য আছে। তাই ৭০ সালের মত প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড়ে বর্তমানে হলেও প্রাণহানি একেবারেই কম হবে।