ভোলা নিউজ ২৪ ডটনেট ।। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) সাংবিধানিক ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা। একইসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জনে তাদের পরামর্শের উপর গুরুত্ব দিতে ইসির প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন তারা। পাশাপাশি নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত পর্যবেক্ষকদের ওপরও নজরদারি বাড়াতে ইসিকে পরামর্শ দিয়েছেন সাংবাদিকরা।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বুধবার রাজধানীর নির্বাচন ভবনে এ সংলাপ শুরু হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা। চার নির্বাচন কমিশনারও আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন। গণমাধ্যমের সঙ্গে দুইদিন ব্যাপী সংলাপের প্রথম দিনে নির্বাচন কমিশন প্রিন্ট মিডিয়ার সম্পাদক/প্রতিনিধি, সিনিয়র সাংবাদিক ও সাংবাদিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক করেন।
প্রথম দিন গনমাধ্যমের ৩৭ জন প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও উপস্থিত ছিলেন ২৬ জন। সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, সিনিয়র সাংবাদিক আবেদ খানসহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক আমন্ত্রণ পেলেও সংলাপে অংশ নেননি।
নির্বাচন কমিশনের তালিকার ক্রমানুসারে সংলাপে উপস্থিত ছিলেন, নিউএজ সম্পাদক নূরুল কবির, যুগান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল আলম, ইত্তেফাকের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আশিস সৈকত, কালের কণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক মোস্তফা কামাল, মানবজমিন প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত, আমাদের অর্থনীতি সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান, বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি মুহাম্মদ শফিকুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন, বিএফইউজের একাংশের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল ও মহাসচিব ওমর ফারুক, বিএফইউজের অপর অংশের মহাসচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ, প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক, আমানুল্লাহ কবীর, সাপ্তাহিক সম্পাদক গোলাম মর্তুজা, কলাম লেখক বিভুরঞ্জন সরকার, সিনিয়র সাংবাদিক মাহবুব কামাল, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান, দৈনিক সংবাদের নির্বাহী সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামান, যায়যায়দিনের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কাজী রুকুনউদ্দীন আহমেদ, সাংবাদিক কাজী সিরাজ ও সাংবাদিক আনিস আলমগীর।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন বিএফইউজে সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, সংলাপে বেশিরভাগ ব্যক্তিই সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা বলেছেন। ইসিকে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন করতে হবে। সেনাবাহিনী মোতায়েন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সার্বিকভাবে অনেকেই মনে করছেন সেনাবাহিনী মোতায়েনের প্রয়োজন নেই। আবার অনেকেই মোতায়েনের পক্ষে মত দিয়েছেন।
তিনি জানান, আলোচনা ‘না‘ ভোটের বিষয় এসেছে। অনেকে না ভোট চালুর বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন। অনেকে আবার বিরোধীতাও করেছেন। একটি বিষয়ে সবাই একমত হয়েছেন যে নির্বাচনে গণমাধ্যমকে সম্পৃক্ত করতে হবে। আমরা সুনির্দিষ্টভাবে বলেছি প্রার্থীদের হলফনামায় গণমাধ্যমের প্রবেশাধিকার থাকতে হবে। নির্বাচন কমিশন প্রার্থীদের হলাফনামা প্রকাশ না করার সিদ্ধান্তের কথা বলেছেন। কিন্তু আমরা দাবি করেছি তা প্রকাশ করার।
সিনিয়র সম্পাদক মাহফুজউল্লাহ বলেন, সংলাপে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই ধরনের নির্বাচন যেন ভবিষ্যতে না হয় সেজন্য কমিশনকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। নির্বাচনের আগে মাঠ প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে নির্বাচনের আগের তিন বছরে মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেননি এমন কর্মকর্তাদেরকে পদায়নের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সংলাপে অংশগ্রহনকারী দুয়েকজন ছাড়া সবাই সেনাবাহিনী মোতায়েনের কথা বলেছেন। এ ক্ষেত্রে কেউ কেউ সরাসরি এবং কেউ কেউ প্রয়োজনে সেনা মোতায়েনের কথা বলেছেন।
মানবজমিনের সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, নির্বাচনে সেনাবাহিনী, ‘না’ ভোট, সীমানা পুনর্নির্ধারণসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমি সেনা বাহিনী মোতায়েনের পক্ষে মত দিয়েছি। বলেছি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করা হয়ে থাকে। আমরা কোন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা নই যে আমাদের এখানে সেনা মোতায়েন করা যাবে না।
বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে যে প্রস্তাবগুলো এসেছে তা হলো- কিভাবে নির্বাচন সুষ্ঠু করা যায়। সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। একইসঙ্গে নির্বাচনকালীন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সিভিল প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে কথা হয়েছে। সেনাবাহিনী থাকবে কী না তা নিয়েও কথা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন যদি মনে করে সেনাবাহিনী দরকার সেটা করবেন। না চাইলে নয়।
তিনি বলেন, কিছু আসন পুনর্বিন্যাস করা দরকার। যেমন কুমিল্লা-১০ আসন ৯০ কিলোমিটার লম্বা। এই সংকটগুলো নিরসন করতে হবে। নির্বাচনে সন্ত্রাসী, মাস্তান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে তার সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগের কথাও বলেন এই সাংবাদিক।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি শফিকুর রহমান বলেন, সেনাবাহিনী নির্বাচনে নয়, সেনা মোতায়েন হতে পারে একমাত্র জাতীয় বিপর্যয়ে। প্রচলিত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট। নির্বাচনে সেনাবাহিনী থাকলে অন্যান্য বাহিনীগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। আমি চাই নির্বাচন কমিশনই এসব বিষয়ে ভূমিকা রাখবে।
তিনি জানান, নির্বাচনে পর্যবেক্ষণের নিয়োগের বিষয়ে আরো নিয়ন্ত্রিত হতে কমিশনের দৃষ্টি আর্কষণ করেছি। দেশি-বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ক্রীড়ানক হিসেবে কাজ করে এই পর্যাবেক্ষকরা। পর্যবেক্ষক নামের একটি গোষ্ঠী একটি বিশেষ দলের পক্ষে নেমে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করে। বিশেষ করে নারী ভোটারদেরকে প্রভাবিত করে।
সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক ঐক্য জরুরি মন্তব্য করে ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলার চেষ্টা করেছি। সুষ্ঠু ও নিরেপক্ষ নির্বাচনের পূর্বশর্ত হলো সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। এজন্য রাজনৈতিক ঐকমত্য খুবই জরুরি। বিশেষ করে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যদি অংশগ্রহণ না করে তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কাজেই দলগুলোর আস্থা অর্জনে কমিশনকে প্রাধান্য দেয়া উচিত। নির্বাচনের প্রধান স্টেক হোল্ডার হলো রাজনৈতিক দল। তাদের সঙ্গে সংলাপ করাটা বেশি জরুরি। একজন সাংবাদিক হিসেবে বলতে পারি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হলে যে ধরনের পরিবেশ দরকার সেটি এখনও তৈরি হয়নি। কমিশন আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এমন আচরণ করবেন যাতে জনগণের আস্থা তৈরি হয়। ইসির আচরণের মানদণ্ড হবে একটি- তাহলো নিরপেক্ষতা স্বাধীন মনোভাব ও কঠোরভবে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করা। সেক্ষেত্রে সরকারের ওপরও যদি কঠোর পদক্ষেপ নিতে হয় তা করতে হবে।
বিএফইউজে একাংশের মহাসচিব এম আবদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশের প্রধান দুই দল- আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের পন্থা বের করতে হবে। দল নিরেপক্ষে সরকারের অধীনে কেবল গ্রহণযোগ একটি জাতীয় নির্বাচন সম্ভব। নির্বাচনের আগে অবশ্যই চলতি সংসদ ভেঙ্গে দিতে হবে। নির্বাচনে ভয়ভীতি মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করতে হবে। পোলিং এজেন্ট ও ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ‘না‘ ভোটের বিধান রাখতে হবে। নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহে সাংবাদিকদের ওপর কোন বিধি নিষেধ আরোপ করা যাবে না।
সিনিয়র সাংবাদিক আমানুল্লাহ কবীর তার প্রস্তাবনায় সেনা মোতায়েন ও নির্বাচনে লেভেং প্লেইয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার প্রস্তাব দেন। তিনি বিএনপির নাম উল্লেখ করে বলেন, বর্তমানে ওই দলটির অনেক নেতার নামে মামলা রয়েছে। ওই মামলার সূত্র ধরে নির্বাচনের সময় যাতে হয়রানির শিকার না হতে হয় তার জন্য নির্বাচনকালে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাদের মামলার হয়রানি থেকে রেহাই দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আমানুল্লাহ কবীর সেনা মোতায়েনের পক্ষে মত দেন।
প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, নির্বাচনে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা বলেছি। প্রতিটি দল যাতে দলের নেতৃত্বে ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করে কমিশনকে যে বিষয়ে তার জায়গা থেকে পদক্ষেপ নিতে বলেছি। তিনি বলেন, ভিন্ন কোন নামে যেন জামায়াত নিবন্ধিত হতে না পারে কমিশনকে তার জন্য সতর্ক থাকতে বলেছি।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির আগের ৯০ দিনের মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করতে গত ১৬ জুলাই দেড় বছরের কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করে কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। এর অংশ হিসেবে রাজনৈতিক দল, নির্বাচন পরিচালনা বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যম প্রতিনিধি, পর্যবেক্ষক ও নারী সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ইসির এই মতবিনিময়। এ নিয়ে ৩১ জুলাই সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মতামত নেয়া হয়েছে। ধারবাহিক সংলাপে সব অংশীজনের বক্তব্য নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে সরকারের কাছেও পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন সিইসি।