আদিল হোসেন তপু ॥ অদম্য সালমা বেগম (১৫)। একজন সংগ্রামী কিশোরীর নাম। যার কিনা অষ্টম শ্রেনীতে পড়াশোনা অবস্থায় পরিবার তাকে বাল্যবিয়ে দিয়ে কন্যা দায়গ্রস্থ হতে চেয়েছিলো তার পরিবার। পরিবারের আর্থিক অস্বচ্ছলতায় কারনে সালমার পড়ালেখা করা যেন পরিবারে কাছে বোঝা হয়ে উঠছিলো। কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্র সালমা নয়। তার অদম্য ইচ্ছা শক্তির জোড়ে কোস্ট ট্রাস্ট কিশোরী কাবের সদসদের নিয়ে নিজের বাল্যবিয়ে ঠেকিয়ে দিয়েছে সালমা। সে ভোলা সদর উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের ‘যমুনা’ কিশোরী কাবের একজন সক্রিয় সদস্য। তার স্বপ্ন একজন আর্দশ বান নার্স হয়ে মানুষের সেবা করা। আর তার স্বপ্ন পূরনে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ইউনিসেফ ও কোস্ট ট্রাস্ট।
সালমা জানায়, ২০১৬ সালের দিকে আমি যখন অষ্টম শ্রেনীতে পড়াশোনা করি তখন থেকেই আমার বাবা-মা দারিদ্র্যতার কারনে আমার পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়ে বিয়ে দিয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগে। তারা কোন মতে বুঝতে চাচ্ছিল না যে বাল্যবিয়ে আইনত দন্ডনীয় অপরাধ।
আমাকে বিয়ে দেয়ার জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে সমন্ধ আনতে থাকে। আমি কোন কিছুতেই তাদের কথায় বিয়ে করতে রাজি হয় নাই। আমি বাবা মাকে বলি আমি পড়াশোনা করতে চাই। বাবা-মায়ের কথায় আমি রাজি না হওয়ায় তারা রাগে ক্ষোভে আমার পড়াশোনার খরচ বন্ধ করে দেয়। আমি আমার স্কুলের শিক্ষকদের জানালে তারা আমার পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখে আমার কোন ফি নেয়নি। এভাবেই অনেক কষ্ট করে না খেয়ে কয়েক মাইল হেটে গিয়ে জিএসসি পরীক্ষা দেই।
পরীক্ষার পরেই পরিবারের পক্ষ থেকে আমার বিয়ের জন্য তোড়জোর শুরু করে। পরে আমি স্থানীয় কিশোরী কাবের সদস্যদের নিয়ে আমার বাবা মাকে বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে বুঝাই। এতেও তারা কোন কিছুতে রাজি না হলে পরে ১০৯৮ এর সহায়তা নেই। পরে স্থানীয় মেম্বার, সাংবাদিক, গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও কোস্ট ট্রাস্ট এর ওয়ার্ড প্রমোটর ইয়াছমিন আক্তার আপা সহ সবাই মিলে আমার বাবা মাকে বুঝালে তারা আমাকে অল্প বয়সে বিয়ে দিবেনা বলে জানায়।
পরে ২০১৭ সালের দিকে ইউনিসেফ এর সহযোগীতায় ও কোস্ট ট্রাষ্ট এর আইইসিএম প্রকল্পের ব্যবস্থাপনায় ‘শিশু সুরক্ষা বৃত্তি’র ১৫ হাজার টাকা পেয়ে বর্তমানে সেই টাকা দিয়ে সেলাই মেশিন কিনি। সেলাই করা অর্থ দিয়ে পড়াশোনারা খরচ চালিয়ে যাচ্ছি। তাইতো সেলাই মেশিনের চাকায় বর্তমানে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে সালমা। সালামা স্বপ্ন ভবিষৎতে একজন দক্ষ নার্স হবে। এবং মানুষের সেবা করবে। বর্তমানে সালমা শিবপুর বালিকা বিদ্যালয়ে ১০ম শ্রেনীতে পড়াশোনা করছে।
সালমা আরো জানায়, সেলাই করে মাসে ৫০০-১০০০ হাজার টাকা আয় করে থাকি। সেই টাকা দিয়ে স্কুলের বেতন,বই, খাতা কিনি। সেই সাথে বাড়তি আয়ের জন্য হাঁস-মুরগী পালন করছি। তা দিয়ে যেন একদিকে পরিবারের বাড়তি আয় হচ্ছে অন্যদিকে আমার পড়াশোনার খরচ চলছে। বর্তমানে আমি এখন নিয়মিত স্কুলে যাই। এই ক্ষেত্রে পরিবারের বাধাঁর পরিবর্তে উৎসাহ পাচ্ছি।
সালমার মা বিলকিস বেগম জানায়, সালমার বাবা সামন্য মৎস ব্যবসায়ী। তার সামান্য আয় দিয়ে পরিবারের খরচ চালানো কষ্ট সাদ্য হয়ে যাচ্ছে। তার উপর আবার সালমার পড়াশোনা। এতো অর্থ আমারা কই পামু। তাই বাল্যবিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। এখনতো সালমার পড়াশোনার খরচ সালমা নিজেই চালাচ্ছে। এর জন্য কোস্ট ট্রাস্ট ও ইউনিসেফকে ধন্যবাদ জানাই। তারা আমার মেয়ের আগ্রহ দেখে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এখন ওর স্বপ্ন টা পূরন হলেই হলো।
কোস্ট ট্রাস্ট আইইসিএম প্রকল্পের ওয়ার্ড প্রমোটর ইয়াছমি আক্তার জানায়, সালমা আমাদের কাবের জন্য রোল মডেল। ও নিজের বিয়ে বন্ধ করে আজ এগিয়ে চাচ্ছে। এমনকি অন্য মেয়েদের বাল্য বিয়ে প্রতি নিরুসাহীত করছে। এখন কাবের সদস্যদের নিয়ে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে ভূমিকা রাখছে।
শিবপুর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য রুহুল আমিন জানায়, আমি যখন খবর পেয়েছি আমার ওয়ার্ডের কিশোরী সালমাকে বাল্যবিয়ে দেয়ার জন্য তার বাবা-মা চেষ্টা করছে। তখন স্থানীয়দের নিয়ে বাল্যবিয়ে না দেয়ার জন্য আমরা সালমার পরিবারকে বুঝিয়েছি এবং আমরা এই বিয়ে বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছি। আমরা সব সময় বাল্য বিয়েকে না বলি। আশা রাখি আমাদের ইউনিয়কে সবার সম্মেলিত চেষ্টায় বাল্য বিয়ে মুক্ত ইউনিয়ন হিসাবে গড়ে তুলতে পারবো।
কোস্ট ট্রাস্ট আইইসিএম প্রকল্পের প্রকল্প সমন্বয়কারী মো: মিজানুর রহমান জানায়, আমরা সালমার মতো অসহায় দারিদ্র্য, এতিম, শিশু বিবাহের ঝুঁকিতে আছে এমন ভোলা, লালমোহন, চরফ্যাশনের ৪০৮জন কিশোরীর মাঝে এককালীন ১৫ হাজার টাকা করে বৃত্তি প্রদান করেছি।
এই টাকা পেয়ে স্ব-স্ব কিশোরী এখন স্বাবলম্বী। তারা তাদের নিজের পড়াশোনার খরচ চালানোর পাশাপাশি পরিবারের খরচও চালাচ্ছে। এর মাধ্যমে অনেকাংশেই শিশু বিবাহ কমিয়ে আনার পাশাপাশি স্বচ্ছলতাও হয়েছে অনেকের পরিবারের। এবং ভবিষ্যৎ আমরা আরো বৃত্তি দেয়ার চেষ্টা করবো।