করোনা মহামারির শুরু থেকেই দুনিয়াজুড়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা তাঁদের অবদানের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও প্রবাসী বাংলাদেশি চিকিৎসক মুশতাক মাহমুদ ব্যক্তিগতভাবে অবশ্য সে প্রশংসাবাক্যে কখনোই আহ্লাদিত হননি। চোখের সামনে রোগীর মৃত্যু তাঁকে এতই ব্যথিত করত যে স্বাস্থ্যসেবীদের দেওয়া ফ্রন্টলাইন হিরো বা সম্মুখসারির নায়ক তকমাও অর্থহীন শোনাত তাঁর কানে।
ওহাইও বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের ইন্টারনাল মেডিসিন আর শিশুরোগের চিকিৎসক মুশতাক মাহমুদ তাই যখন জানতে পারলেন তাঁরই বিশ্ববিদ্যালয়েরই করোনার টিকার পরীক্ষার চালানো হবে, তখন করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিশেষ কিছু করতে চাইলেন তিনি। হাসপাতালের পরিচালককে ফোন করে মুশতাক জানালেন, যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার ও জার্মানির বায়োএনটেক তাদের উদ্ভাবিত করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের তৃতীয় ধাপে স্বেচ্ছায় শরীরে নিতে চান পরীক্ষাধীন করোনা টিকা।
কিছু শারীরিক পরীক্ষা–নিরীক্ষা আর ২৬ পৃষ্ঠার এক চুক্তিপত্রে সই করার পর দুই বছর মেয়াদি এই পরীক্ষণের প্রথম ধাপে ১১ সেপ্টেম্বর ডা. মাহমুদের শরীরে এই টিকা দেওয়া হয়। পরীক্ষণের ২৪ মাসে তাঁকে ছয়-সাতবার যেতে হবে ল্যাবে, প্রতিবার প্রায় তিন ঘণ্টার মতো সময় নিয়ে।
‘আমাকে প্রতিনিয়ত ফলোআপের মধ্যে থাকতে হবে। প্রতি সপ্তাহে একটা অ্যাপে আমাকে আমার শারীরিক অবস্থাসংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্য জানাতে হবে। আর কোনো সমস্যা অনুভব করলে আমি ওদের জানাব। যদি ভ্যাকসিনের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, তবে চিকিৎসার সম্পূর্ণ খরচ ওরা বহন করবে’, জানালেন মুশতাক মাহমুদ।
মুশতাক মাহমুদ আরও যোগ করেন, ‘তবে আমার যদি কখনো মনে হয় আমি আর এই প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে থাকতে চাই না, তখনই আমি নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে পারব। এ জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ আমাকে দিতে হবে না। যদি কখনো আমি প্রতারিত বোধ করি, আমি আইনজীবীর শরণাপন্নও হতে পারব।’
ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন ছাত্র মুশতাক মাহমুদ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস শেষ করে প্রথমে যান জাম্বিয়া। সেখানে তিন বছর চাকরির পর ২০০১ সালে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। কবিতাপ্রেমী মুশতাকের আরেকটি পরিচয় তিনি নাট্যকার মমতাজউদ্দীন আহমদের সন্তান। মুশতাকের সহধর্মিণী শায়লা চৌধুরীও চিকিৎসক। ভ্যাকসিন ট্রায়ালে নাম লেখানোর সময় বাসায় কাউকে জানাননি মুশতাক।
ভ্যাকসিন শরীরে প্রবেশের ঠিক আগে নার্সকে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে মুশতাক বলেছিলেন, ‘আমি যদি মরে যাই!’ নার্সের উত্তর ছিল, ‘কি আর হবে ডা. মাহমুদ, মানবসভ্যতা তোমাকে আজীবন মাথায় তুলে রাখবে।’
আমরা আশা করি, ডা. মাহমুদ এবং তাঁর সতীর্থদের করোনার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ অচিরেই শেষ হবে। যথার্থ ভ্যাকসিনের আবিষ্কার বাঁচাবে হাজারো প্রাণ আর পৃথিবীকে ফেরাবে আগের রূপে। তবে ডা. মাহমুদ বা তাঁর সতীর্থদের আমাদের আলাদা করে ধন্যবাদ জানাতে হবে না। সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছাড়া রোগীর মুখের হাসিই হবে তাঁদের পুরস্কার।