যেসব কারণে বাকিদের ছাপিয়ে ইভ্যালি পেল এশিয়া ওয়ানের বিশেষ স্বীকৃতি

0
333

ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি বাংলাদেশে এখনও খুব ভালোভাবে বিকশিত হয়নি, বলতে গেলে এই ইন্ডাস্ট্রিটা এদেশে এখনও কৈশোরকাল পার করছে। অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান থাকলেও, গ্রাহকের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জনের জন্যে এখনও যুঝতে হচ্ছে তাদের। এর মধ্যে গত কিছুদিন ধরে এই সেক্টরে যে প্রতিষ্ঠানের নাম সবচেয়ে বেশি শোনা যাচ্ছে, সেটার নাম ইভ্যালি। যাত্রা শুরুর এক বছরের মধ্যেই নানা অফার এবং ছাড়ের মাধ্যমে গ্রাহকদের আগ্রহের জায়গা হয়ে উঠেছে ইভ্যালি।

প্রায় পনেরো লক্ষ নিবন্ধিত গ্রাহক তৈরী হয়েছে তাদের, এ পর্যন্ত ত্রিশ হাজারের বেশি ইউনিট মোবাইল ফোন এবং প্রতিদিন ২০০’রো বেশি মোটরসাইকেল বিক্রি হচ্ছে ইভ্যালির মাধ্যমে। স্বল্প সময়ে এই অর্জনটা নিঃসন্দেহে বিশাল। প্রোডাক্ট ডেলিভারির ধীরগতি নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগ থাকলেও, ধীরে ধীরে ইভ্যালি যে বাংলাদেশের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রির শীর্ষস্থান দখলের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে, সেটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। ই-কমার্স সেক্টরে এর আগে এত দ্রুত সময়ে এমন অভাবনীয় উন্নতি আর কেউই করতে পারেনি।

এখন তো দেশের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও যুক্ত হচ্ছে ইভ্যালির ঝুলিতে, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার জনপ্রিয় বিজনেস ম্যাগাজিন এশিয়া ওয়ান এই প্রতিষ্ঠানটিকে বাংলাদেশের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ব্র্যান্ড হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এশিয়া ওয়ান বলেছে, খুব অল্প সময়েই ইভ্যালি গ্রাহকদের খুব কাছাকাছি পৌঁছে নিজেদের একটা আলাদা ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরী করেছে, গ্রাহকদের মধ্যে একটা আস্থা তৈরী হয়েছে ইভ্যালির ওপরে। প্রতিষ্ঠানটির সিইও মোহাম্মদ রাসেলকেও ‘বিজনেস লিডার’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এশিয়া ওয়ান।

একটা মোবাইল কেনার সূত্র ধরেই ইভ্যালির নামটা প্রথম শুনেছিলাম। বর্ষপুর্তির একটা অফার চলছিলো তখন, প্রায় অর্ধেক দামে প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের হাতে মোবাইল তুলে দিচ্ছিল! মোবাইলটা শেষমেশ কেনা হয়নি, তবে ইভ্যালির জনপ্রিয়তার দিকে নজর ছিল। গতকাল এশিয়া ওয়ান যখন ইভ্যালিকে দ্রুত বর্ধনশীল ব্র্যান্ড হিসেবে স্বীকৃতি দিলো, তখন মাথায় এই প্রশ্নটা এসেছিল- ইভ্যালি কীভাবে পারলো, অন্য কেউ কেন এই স্বীকৃতি পেলো না? নিশ্চয়ই এমন কিছু প্যারামিটার ইভ্যালি ধরে রেখেছে, যেগুলো অন্যরা মেন্টেইন করতে পারেনি। কী সেগুলো?

অফার এবং মূল্যছাড়

ইভ্যালির জনপ্রিয়তার সবচেয়ে বড় কারণ সম্ভবত এটাই। নানা উৎসব আর উপলক্ষ্যে গ্রাহকদের জন্যে বিভিন্ন ধরণের ছাড় নিয়ে এসেছে প্রতিষ্ঠানটি, পছন্দের পণ্যটি অল্প দামেই কিনতে পেরেছে ক্রেতা। থান্ডারস্টর্ম, আর্থকোয়াক বা এরকম আরও নানা অফারে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে ইভ্যালি থেকে পণ্য কেনার জন্য। ব্র্যান্ড মেলায় তো ৭০, ৮০, এমনকি ১০০% ক্যাশব্যাকের অফারও দেয়া হয়েছে। দুই-আড়াই লাখ টাকার বাইক ক্রেতারা পেয়ে গেছে অর্ধেক দামে, স্বভাবতই ইভ্যালি নিয়ে মানুষের আগ্রহ বেড়েছে, বেড়েছে নিবন্ধিত গ্রাহকের সংখ্যাও।

বড় লক্ষ্য, বিশাল ব্যপ্তি

ইভ্যালির লক্ষ ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান হবে তারা। এই ভিশনটা এর আগে কোন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দেখা যায়নি। শুধু অনলাইন মার্কেটকে কেন্দ্র করেই যে দেশের সবচেয়ে বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার বিশাল একটা লক্ষ্যের দিকে ছোটা যায়, সেটা ইভ্যালিই প্রথম দেখিয়েছে।

দেশের সবচেয়ে বড় মার্কেটপ্লেস হবার পথে ইভ্যালি তাদের পণ্যভাণ্ডারে যোগ করেছে নতুনত্ব। বই থেকে ফার্নিচার, মোবাইল থেকে কম্পিউটার, ঘর সাজানোর তৈজসপত্র থেকে শুরু করে চাল_ডাল-তেল-পেঁয়াজ সবকিছুই পাওয়া যায় ইভ্যালিতে। কাজেই তাদের ভোক্তাশ্রেনীটাও বিশাল। ইভ্যালির এগিয়ে যাওয়ার পথে পণ্যের এই বৈচিত্র্য আর গ্রাহকের বিশাল সংখ্যাটাও একটা বড় কারণ। অ্যালেক্সা র‍্যাংকিংয়েও ইভ্যালির উর্ধ্বগমন চোখে পড়ার মতো।

প্রচারণা

যে কোন প্রতিষ্ঠান বা পণ্যের জন্যেই প্রচারণাটা খুব গুরুত্বপূর্ন, ইভ্যালির টিম সেটা শুরু থেকেই বুঝেছে। বিলবোর্ড আর দোকানের সাইনবোর্ডের মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে ইভ্যালির যাত্রা শুরু হয়েছিল, এখন বাংলাদেশ ছাপিয়ে ইভ্যালির প্রচারণা পৌঁছে গেছে ভারত-পাকিস্তানেও!

ইভ্যালির সিইও মোহাম্মদ রাসেল

গুগল অ্যাডসেন্সে প্রচারণা চালিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের মনযোগ আকর্ষণের চেষ্টা চালিয়েছে ইভ্যালি, স্পন্সর হিসেবে সহযোগী হয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সিরিজগুলোতে। ইভ্যালির অপপ্রচার করে লেখা নিউজ আর্টিকেলেও ঝুলছে ইভ্যালিরই অ্যাড- এর চেয়ে মজার বিষয় আর কী হতে পারে! এটা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে যথেষ্ট হাস্যরসেরও উদ্রেক হয়েছে।

গ্রাহকের অভিযোগ ধর্তব্যে নেয়া

বাংলাদেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল আফটার সেলস সার্ভিস নিয়ে, একবার গ্রাহক পণ্যের দাম চুকিয়ে ফেলার পরে পণ্যে হাজার ত্রুটি থাকলেও সেটা ফেরত দিতে গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হতে হতো ক্রেতাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন অজস্র অভিযোগ এসেছে। এই প্রতারণার জন্যেই অনলাইনে কেনাকাটার ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে গিয়েছিল অনেকের।

ইভ্যালি সেই বিশ্বাসটা ফিরিয়ে আনার কাজ করছে, ডেলিভারি টাইম ছাড়া মোটামুটি সব ক্ষেত্রেই গ্রাহক তাদের কাছ থেকে ভালো সার্ভিস পাচ্ছেন। ফেসবুকে ইভ্যালির গ্রুপগুলোতে ঢুঁ মারলেই বোঝা যায় সেটা। অভিযোগের প্রায় সবই ডেলিভারির বিলম্ব নিয়ে, কিন্ত পণ্যের মান নিয়ে অভিযোগের সংখ্যা শূন্যের কোঠায়। গ্রাহক কোন পণ্যে সমস্যা পেলে সেটা সঙ্গে সঙ্গে বদলে নিতে পারছেন, কাস্টোমার সার্ভিস থেকে এই আন্তরিকতাটা বাংলাদেশে এর আগে খুব বেশি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ক্রেতাদের উপহার দিতে পারেনি। এটাও ইভ্যালির জনপ্রিয়তা এবং বৈশ্বিক স্বীকৃতি অর্জনের একটা কারণ।

ক্যারিশম্যাটিক সিইও

ইভ্যালির জনপ্রিয়তার সবচেয়ে বড় কারণগুলোর একটি সম্ভবত প্রতিষ্ঠানটির সিইও মোহাম্মদ রাসেল স্বয়ং। ইভ্যালির গ্রাহকদের সঙ্গে তিনি যেভাবে সরাসরি যোগাযোগ করেন, সেটা অবিশ্বাস্য। ফেসবুকে নিয়মিত তিনি লাইভে আসেন, ইভ্যালির নানা অফার নিয়ে ঘোষণা দেন, ইভ্যালির গ্রুপেও পোস্ট করেন, অভিযোগের জবাব দেয়ার চেষ্টা করেন। ব্যাংকার থেকে উদ্যোক্তায় পরিণত হওয়া এই ভদ্রলোকের কারণেই ইভ্যালি ধীরে ধীরে বাংলাদেশের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রির চেহারাটা বদলে দিচ্ছে। এশিয়া ওয়ান তো ইভ্যালির সঙ্গে তাকেও দ্রুত বর্ধনশীল ব্র্যান্ড নেতার স্বীকৃতি দিয়েছে।

কিছু অভিযোগ, যা বাস্তব

ইভ্যালি ত্রুটিমুক্ত কোন প্রতিষ্ঠান নয়। পণ্যের ডেলিভারি টাইম নিয়ে গ্রাহকদের মধ্যে অসন্তোষ আছে, সেটা ধ্রুব সত্যি, গোপন করার কোন কারণ নেই। অর্ডারের পরে চাতক পাখির মতো বসে থাকাটা সুখকর কোন অভিজ্ঞতা নয়। তবে এই দেরীটাও ধীরে ধীরে মেনে নিচ্ছেন ক্রেতারা। একটু দেরি না হয় হোক, তবু এমন অবিশ্বাস্য অফারে আর কে দেবে প্রোডাক্ট- এই আপাত বাস্তবতায় অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছেন ক্রেতারা।

অদূর ভবিষ্যতে ডেলিভারির সময়কাল কমিয়ে আনতে পারলে ইভ্যালি নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগ হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে নিঃসন্দেহে। এর বাইরে কাস্টোমার কেয়ারে যোগাযোগ করেও অনেক সময় সঠিক তথ্য না পাওয়ার অভিযোগ করেন অনেকে। ইভ্যালি যেভাবে টার্গেট করেছে, ২০২০ সালে তারা দেশের এক নম্বর ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান হবে, ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের শীর্ষ অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে- এর জন্য ডেলিভারি টাইম ও কাস্টমার সার্ভিস সেক্টরে উন্নতি করতে হবে, তা নিশ্চয়ই ইভ্যালি ম্যানেজমেন্ট জানে।

চৌদ্দ মাস আগে যাত্রা শুরু করা একটা প্রতিষ্ঠান এই অল্প সময়ের মধ্যেই দারুণ সাফল্য আর জনপ্রিয়তা পেয়েছে, অর্জন করছে বৈশ্বিক স্বীকৃতি, অথচ তাদের পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে এদেশের অনেকেই প্রতিষ্ঠানটির পেছনে লেগেছেন, ভিত্তিহীন কিছু তথ্যের সন্নিবেশে অপপ্রচার চালিয়ে টাকা খরচ করে সেসব সোশ্যাল মিডিয়াতে বুস্টও করা হচ্ছে!

দিনশেষে এসবে কারো লাভ হয়তো হবে না, তবে লোকসান হবে ইভ্যালির সাথে নানাভাবে জড়িত থাকা অনেকগুলো মানুষের। অবশ্য, কেউ এগিয়ে যেতে চাইলে তাকে পেছন থেকে টেনে ধরে রাখাটা তো আমাদের দেশের রীতি, সেখান থেকে সবাই তো বেরিয়ে আসতে পারবে না চাইলেও…

LEAVE A REPLY