বঙ্গবন্ধু’ উপাধির ৫০ বছর পূর্তিতে যা বললেন তোফায়েল আহমেদ

0
835

ভোলা নিউজ২৪ডটনেট।।  ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১০ লক্ষাধিক লোকের সম্মতিতে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়া হয় বলে উল্লেখ করেন ডাকসুর তৎকালীন ভিপি তোফায়েল আহমদ। বর্তমানে আওয়ামী লীগের সভপতিমণ্ডলীর এই সদস্য আরও বলেন, ‘সেদিন ছিল এক ঐতিহাসিক দিন। ওই দিন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে আমরা গণসংবর্ধনা দেই। ওই সভায় আমাদের প্রিয় নেতাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করার প্রস্তাব করি আমি।  সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত লক্ষাধিক লোক হাত তুলে আমার প্রস্তাব সমর্থন করে।  এরপরপরই আমি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করি।’ বুধবার (২০ ফেব্রুয়ারি) সকালে বনানীতে নিজ বাসায় সারাবাংলাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করার প্রেক্ষাপট এভাবেই বর্ণনা করেন বঙ্গবন্ধুর এই ঘনিষ্ঠ সহচর।

প্রসঙ্গত,  জনতার প্রতিবাদের মুখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রত্যাহার করা হয়।  সঙ্গে-সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব কারাবন্দিকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হয়।  পরেরদিন, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯ তারিখে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবর রহমানসহ মামলায় অভিযুক্তদের এক গণসংবর্ধনা দেওয়া হয়।  ওই সভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত তৎকালীন ডাকসু ভিপি ও সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক তোফায়েল আহমেদ। এই বছর এই  উপাধির ৫০ বছর পূর্ণ হলো।

সেদিনের সংবর্ধনা সভার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘সেদিনে সেই সভা ছিল কানায় কানায় পরিপূর্ণ। সেদিন ১০ লক্ষাধিক লোক ছিলে সেই মাঠে। প্রিয় নেতার কাছে আমরা ঋণী ছিলাম। আমি ছিলাম সেই সভার সভাপতি। সভাপতি সবার শেষে বক্তৃতা করেন।  ৪ ছাত্র সংগঠনের ৪ জন বক্তৃতা করলেন।  বক্তৃতা করলেন খালেদ মোহাম্মদ, সাইফুদ্দিন মানি্ক‌, মাহবুবুল্লাহ ও ইব্রাহিম খলিল। ’

ডাকসুর তৎকালীন এই ভিপি বলেন, ‘‘আমি সভাপতি হিসেবে সবার শেষে বক্তব্য দেওয়ার কথা।  কিন্তু অনুমতি চাইলাম। বললাম যে, এমন এক মহান নেতা আমাদের মাঝে উপস্থিত, যিনি আমাদের আজকের প্রধান অতিথি। যিনি জেল জুলুম অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করে কারামুক্ত হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে এসেছেন। সেই নেতার পরে আর বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ নেই।  আপনারা অনুমতি দিলে আমি আগেই বক্তৃতা করতে চাই।  সমাবেশে থাকা ১০ লক্ষ লোক হাত তুলে আমাকে অনুমতি দিলো। আমি বক্তৃতা শুরু করেছিলাম ‘তুমি’ বলে। ’’

বঙ্গবন্ধুর এই সহচর বলেন, ‘‘বক্তব্যের মাঝখানে বলেছিলাম, ‘প্রিয় নেতা কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসে মৃত্যুকে তুমি আলিঙ্গন করেছো। প্রিয় নেতা কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসে তুমি তোমার জীবনকে বাংলার মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছো।  তুমি আপস করোনি।  বারবার ফাঁসির মঞ্চে গিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছ।  আমরা বাঙালি জাতি তোমার কাছে ঋণী।  এই ঋণ আমরা কোনো দিন শোধ করতে পারবো না।  রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে আমরা তোমাকে কারামুক্ত করেছি।  এই কৃতজ্ঞ জাতির পক্ষ থেকে তোমাকে আমরা একটা উপাধি দিতে চাই। কারণ, বাংলার মানুষের জন্য তুমি তোমার জীবন উৎসর্গ করেছো।’ এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সমাবেশে থাকা লক্ষাধিক লোক হাত তুলে সম্মতি দিলো।  তখন বাংলার জনগণের পক্ষ থেকে আমি কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম।’’

তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘‘আমি বলেছিলাম, ‘যে নেতা তার যৌবনকাল কাটিয়েছে পাকিস্তানের কারাগারে, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন, সেই প্রিয় নেতাকে বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে আজ ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করলাম।  বক্তৃতা শেষে যখন ঘোষণা করলাম, ‘এখন আপনাদের সামনে বক্তৃতা করবেন আমাদের প্রিয় নেতা ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’, তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মঞ্চে দাঁড়ালেন, বক্তৃতা করলেন।  সেই বক্তৃতা আজও কানে বাজে।  ইতিহাসের পাতায় সেদিনের সেই বক্তৃতা স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।’’

বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এই বর্ষিয়ান নেতা বলেন, ‘‘তিনি বক্তৃতার মাঝখানে বলেছিলেন, ‘আমাকে যখন জেলখানা থেকে মুক্তি দিয়ে আবার গ্রেফতার করা হয়, আমি বুঝেছিলাম যে, ওরা আমাকে ফাঁসি দেবে।  আমি একটুকরো মাটি কপালে মুছে বলেছিলাম, হে মাটি আমি তোমাকে ভালোবাসি। ওরা যদি আমাকে ফাঁসি দেয়, তবে আমি যেন তোমার কোলে চিরনিদ্রায় শায়িত হতে পারি। আমি এই বাংলার মাটিকে ভালোবাসি, আমি বাংলার মানুষকে ভালোবাসি। বাংলার মানুষের জন্য আমার জীবন উৎসর্গীকৃত।’ তিনি একটা কথা বলে বক্তব্য শেষ করেছিলেন।  বলেছিলেন ‘তোমরা যারা রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করেছ, যদি কোনোদিন পারি, তবে আমি আমার নিজের রক্ত দিয়ে সেই রক্তের ঋণ শোধ করে যাবো।’  বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়ার ৫০ বছর পূর্তির এই শুভক্ষণে বলতে ইচ্ছে করে, ‘একাই রক্ত দেননি তিনি, সপরিবারে রক্ত দিয়ে বাঙালি জাতির রক্তের ঋণ তিনি শোধ করেছিলেন। তিনি টুঙ্গিপাড়ায় ঘুমিয়ে আছেন, আর কোনো দিন আসবেন না।  কিন্তু যতদিন এই বাংলা থাকবে, যতদিন বাংলার মাটি থাকবে, মানুষ থাকবে ততদিন জাতির জনক বাঙালি জাতির হৃদয়ের মণিকোঠায় অমর হয়ে থাকবেন। ’’

তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘‘বঙ্গবন্ধু উপাধির ৫০ বছর পূর্তিতে বলতে ইচ্ছে করে, আমরা বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়েছিলাম এমন একজনকে, যিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই বঙ্গবন্ধু।  তিনি বাংলার বন্ধু, বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল তার জীবনের ব্রত। আমার মনে পড়ে তার জন্মবার্ষিকীতে ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন ‘আমি তো আমার জন্মদিন পালন করি না, আমি আমার জন্মদিনে মোমের বাতি জ্বালি না, কেক কাটি না। যে বাংলার মানুষ গরিব, দুঃখী, যে বাংলার মানুষ বুভুক্ষু,অনাহারে, অর্ধাহারে মৃত্যুবরণ করে, তাদের নেতা হিসেবে আমার জন্মদিনই কী, আর মৃত্যুদিনই কী? আমি তো আমার জীবন বাংলার জনগণকে উৎসর্গ করেছি। ’ সত্যিই সেই মহান নেতা তার জীবন বাঙালি জাতির জন্য উৎসর্গ করেছিলেন।  তাকেই তারা ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

LEAVE A REPLY