ভোলা নিউজ ২৪ ডটনেট।। বিগত দিনে দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে নিজের ও দলের নেতাদের ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ করেছেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা নৌকায় ভোট দিন, আমরা আপনাদের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জন করে দেব—এটা আমাদের জাতির কাছে ওয়াদা।’
আজ মঙ্গলবার সকালে ঢাকার প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে দলের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার সময় তিনি বলেন, ‘আমি নিজে এবং দলের পক্ষ থেকে আমাদের যদি কোনো ভুলভ্রান্তি হয়ে থাকে, সেগুলো ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখার জন্য দেশবাসী আপনাদের প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি। আমি কথা দিচ্ছি, অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা আরও সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণ করব।’
ইশতেহার ঘোষণার পর শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা কথায় নয়, কাজে বিশ্বাস করি। আমাদের এবারের অঙ্গীকার, আমরা টেকসই বিনিয়োগ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করব। এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পেলে জনগণ কিছু পায়, সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা ও সমৃদ্ধির সকল সুযোগ এবং সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাঙ্ক্ষিত ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতামুক্ত অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব ইনশা আল্লাহ।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি একটি কথা এখানে বলতে চাই যে আমার কোনো ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। বাবা-মা, ভাই, আত্মীয়-পরিজনকে হারিয়ে আমি রাজনীতি করছি শুধু জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য, এ দেশের মানুষের উন্নয়নের জন্য। এ দেশের সাধারণ মানুষ যাতে ভালোভাবে বাঁচতে পারে, উন্নত জীবন পায়, তাদের জীবনটাকে আরও উন্নত করা—এটাই আমার একমাত্র লক্ষ্য, একমাত্র কামনা। যে আদর্শ নিয়ে জাতির পিতা দেশ স্বাধীন করেছিলেন, সেই আদর্শ আমি বাস্তবায়ন করতে চাই। আগামী ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আমরা সাড়ম্বরে পালন করব। বাঙালি জাতির এই দুই মাহেন্দ্রক্ষণ সামনে রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগই পারবে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে দিতে, সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যেতে।’
দেশবাসীর কাছে নৌকা মার্কায় ভোট চেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘স্বাধীনতাবিরোধী কোনো শক্তি এ সময় ক্ষমতায় থাকলে, তা হবে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গ্লানিকর। তাই দেশবাসীর প্রতি আমার আকুল আবেদন, আগামী ৩০ তারিখে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আবার আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করুন। আপনারা নৌকায় ভোট দিন, আমরা আপনাদের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জন করে দেব—এটা আমাদের জাতির কাছে ওয়াদা।’ তিনি আরও বলেন, ‘নয় মাসের সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে বাঙালি জাতি চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছিল। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের ৩০ তারিখে ব্যালট–বিপ্লবের মাধ্যমে বাঙালি জাতি এবার স্বাধীনতার প্রতীক নৌকা মার্কায় ভোট বিজয় অর্জন করবে, এ বিশ্বাস আমার আছে। বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত, ইনশা আল্লাহ।’
ইশতেহার ঘোষণার শুরুতে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকের বাংলাদেশ আর্থিক দিক থেকে যেমন শক্তিশালী, তেমনি মানসিকতার দিক থেকে অনেক বলীয়ান। ছোটখাটো অভিঘাত বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে আর থামিয়ে রাখতে পারবে না। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা দিয়েছে। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা দিয়েছে। আমাদের দেশে মাথাপিছু আয় ২০০৬ সালে যেখানে ৫৪৩ মার্কিন ডলার ছিল, সেখানে ১৭৫১ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। বৈদেশিক রিজার্ভ তিন বিলিয়ন ডলার থেকে ৩৩ বিলিয়ন ডলারের ওপর। দারিদ্র্যের হার যেখানে ২০০৬ সালে ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল, সেখানে আজকে ২১ দশমিক ৮ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি দেশের একটি আজ বাংলাদেশ।’
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের উন্নয়নের সঙ্গে নিজ সরকারের উন্নয়নের তুলনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিগত ১০ বছরে বাংলাদেশের জিডিপির আকার প্রায় পাঁচ গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে ৪ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা থেকে প্রায় ২২ লাখ ৫০ হাজার ৪৭৯ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুসারে ক্রয়ক্ষমতার বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বের মধ্যে ৩১তম। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ৬১ হাজার কোটি টাকা, সেখানে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাজেটের পরিমাণ প্রায় ৭ দশমিক ৬ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ছিল ১০ দশমিক ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৩৬ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০২১ সাল নাগাদ ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় লক্ষ্য নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।’
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে যা কিছু মহৎ অর্জন ও প্রাপ্তি, সবকিছু অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার আগে তিনি মাত্র সাড়ে তিন বছর পেয়েছিলেন রাষ্ট্র পরিচালনা করার। শূন্য কোষাগার, বিচ্ছিন্ন যোগাযোগব্যবস্থা, বন্ধ কলকারখানা নিয়ে জাতির পিতা পথচলা শুরু করেছিলেন। এক কোটি শরণার্থীকে দেশে ফিরিয়ে এনে তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা ছিল এক দুরূহ কাজ। তার ওপর শুরু হয় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দেশি ও বিদেশি চক্রান্ত। এসব প্রতিবন্ধকতা, ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে মাত্র সাড়ে তিন বছরে দেশকে অনেকটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছিলেন। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় তালিকাভুক্ত হয়েছিল, আর তখনই দেশের অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। তাঁর হত্যার পর ১৯৭৫–পরবর্তী বাংলাদেশি শাসকেরা বাংলাদেশকে পরনির্ভরশীল, ভিক্ষুকের দেশে পরিণত করেছিল। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৯ সাল—এ সময় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচিতি ছিল বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ হিসেবে। বাংলাদেশ মানেই ছিল বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, কঙ্কালসার মানুষের দেশ।
আওয়ামী লীগের সভানেত্রী বলেন, ‘২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ২১ বছর পর আবার বাংলাদেশের মানুষ মুক্তির স্বাদ পায়। জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল—এই পাঁচ বছরে বাংলাদেশের মানুষের জন্য স্বর্ণযুগ। আর্থসামাজিক খাতে অভূতপূর্ব অগ্রগতি অর্জন করে। গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করি। যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ ও খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ ছাড়া কৃষকদের জন্য কল্যাণমূলক বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করি। দুস্থ, অসহায় মানুষের জন্য দুস্থ ভাতা। স্বামী পরিত্যক্তা ও বিধবা নারীদের জন্য ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা ও মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য শান্তিনিবাস, আশ্রয়হীনদের জন্য আশ্রয় প্রকল্প, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া ইত্যাদি কর্মসূচি আমরা চালু করি।’
২০০১ সালের আওয়ামী লীগের পরাজয়ের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ২০০১ সালের ষড়যন্ত্রমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে পরাজিত করা হয়। ২০০১–পরবর্তী পাঁচ বছর ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও এ দেশের সাধারণ মানুষের এক বিভীষিকাময় সময়। হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস—জনজীবন ছিল অতিষ্ঠ। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া, সংসদ সদস্য আহসানউল্লাহ মাস্টার, খুলনার অ্যাডভোকেট মঞ্জুরুল ইমাম, নাটোরের মমতাজ উদ্দিনসহ ২১ হাজার আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীকে হত্যা করে হাওয়া ভবন তৈরি করে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট ও পাচার করা হয়। তিনি অভিযোগ করেন, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাই, জেএমবি, হরকাতুল জিহাদসহ নানা ধরনের জঙ্গিগোষ্ঠী সৃষ্টি করা হয়। রমনা বটমূলে নববর্ষের অনুষ্ঠান, নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের সমাবেশ ও পল্টনে সিপিবির সমাবেশ বোমা হামলা। সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী, সাবেক মেয়র বদরুদ্দিন আহমেদ কামরান ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে বোমা হামলা করে হত্যাচেষ্টা এবং ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট ৫০০ স্থানে একযোগে বোমা হামলা, একই বছর গাজীপুরে বোমা মেরে ১০ জনকে হত্যা, শরীয়তপুরে দুই বিচারকসহ সারা দেশে অসংখ্য সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে এসব জঙ্গিগোষ্ঠী।
গ্রেনেড হামলার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আওয়ামী লীগের র্যালিতে নৃশংস গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রাণে রক্ষা পেলেও মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিরীহ মানুষ নিহত হয় এবং ৫০০ জনের বেশি মানুষ আহত হয়, আহতদের অনেকেই এখনো অসংখ্য স্প্লিন্টার নিয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় দিন যাপন করে যাচ্ছে।’ নিজ দলের কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন সাতটি বছর অতিক্রম করে ২০০৯ সাল থেকে আমরা আলোর পথে যাত্রা শুরু করেছি। একাদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা আবারও সমৃদ্ধির, অগ্রযাত্রার বাংলাদেশ, স্লোগানসংবলিত নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আমরা আমাদের ইশতেহার এমনভাবে তৈরি করেছি, যাতে আমরা তা বাস্তবায়ন করতে পারি। একই সঙ্গে ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষিত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাগুলোর ধারাবাহিকতা ২০১৮-এর নির্বাচনে ইশতেহারেও সংরক্ষিত রয়েছে।’