সু চিকে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে বিচারের সুপারিশ- দায় যুদ্ধাপরাধের

0
414

কৌঁসুলিরা অং সান সু চির গত মঙ্গলবারের ভাষণে উল্লেখ করা ‘বৈশ্বিক পরীক্ষায় ভীত না হওয়া’-সংক্রান্ত উক্তি উল্লেখ করে বলেছেন, ‘আপনি যদি বৈশ্বিক পরীক্ষায় ভয় না পান, তাহলে বিশ্বের রোষানলে পড়ার ভয়ে ভীত হওয়ার প্রস্তুতি নিন। আর আপনার মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী চক্রটিসহ নিজের ওপরই আন্তর্জাতিক আইনের খড়্গ মোকাবিলার জন্য তৈরি হোন।’

মিয়ানমারের গণহত্যার বিষয়ে মামলা পরিচালনাকারী কৌঁসুলিদের টিম ছয়টি নির্দিষ্ট সুপারিশ রেখেছে। এক. শুধু অতিরিক্ত বসতিস্থাপন থেকে উদ্বাস্তুদের জন্য বাংলাদেশকে আরও বেশি পদক্ষেপ নিতে হবে। জাতিগত রোহিঙ্গাদের শুধু নির্দিষ্ট ক্যাম্পে আটকে রাখার প্রবল বিরোধিতা ও তাকে নিন্দা জানানোর দাবি রাখে। দুই. ১৯৬২ সাল থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে চলে আসা পদ্ধতিগত জাতিগত নিপীড়নের নিরিখে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের দায়ী করার নীতি প্রত্যাখ্যান করতে হবে। রোহিঙ্গা জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের দায়ী করার বর্মী দাবি অসম্ভব। সে কারণে তা নাকচ করতে হবে। তাদের এই দাবির সমর্থনে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ দিতে পারেনি। অং সান সু চির উচিত নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানানো, তাঁর পিতা জেনারেল অং সান না হলে তিনি হয়তো নিশ্চিহ্ন হতেন। তিন. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় (জাতিসংঘ, ওআইসি, কমনওয়েলথ প্রভৃতি) যেভাবে পরমাণু অস্ত্র প্রশ্নে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে, সেভাবে মিয়ানমারকেও দিতে হবে। চার. রোহিঙ্গা, কারেন ও কাচিনদের নিজের হিসেবে না মানা পর্যন্ত আসিয়ানের উচিত মিয়ানমারকে একঘরে করে রাখা। গণতন্ত্র এলেও দেশটিতে দৃশ্যত সামরিক শাসনই চলছে। পাঁচ. আইসিসিতে সু চির বিচারসহ একটি নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা এবং ছয়. রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব প্রদান করা।

অং সান সু চিসহ উচ্চ পর্যায়ের জেনারেলদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর অভিযোগ অকাট্য সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে ‘স্পষ্টভাবে’ প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে বলে মুখ্য কৌঁসুলি দোরিন চেন ও উপ মুখ্য কৌঁসুলি আজরিল মোহাম্মদ আমিন তাঁদের সমাপনী বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন। দোরিন চেন বলেছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটনে রাষ্ট্র ও ব্যক্তির দায় চিহ্নিত করা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আইনে ‘কর্তৃত্ব ও উর্ধ্বতন দায়িত্বের’ জায়গা থেকে মিয়ানমারের সামরিক নেতা ও রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের ফৌজদারি দায় নির্দিষ্ট করা যেতে পারে। সু চিকে লেখা নোবেলজয়ী ডেসমন্ড টুটুর চিঠির বরাত দিয়ে চিফ প্রসিকিউটর তাঁর নিবেদন শেষ করেন। সু চিকে টুটু লিখেছেন, ‘মিয়ানমারের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পদে সমাসীন হওয়ার মূল্য যদি হয় আপনার নীরবতা, তাহলে সেই মূল্য খুব মাত্রাতিরিক্ত।’

উল্লেখ্য, আইসিসিতে বিচার শুরুর উপায় বাতলে দিতে চিফ প্রসিকিউটর মিজ দোরিন চেন বলেন, ‘মিয়ানমার ১৯৫৬ সালে গণহত্যা সনদ এবং ১৯৯২ সালে ভিয়েনা সনদ সই করেছে। আমরা গোপনীয় সাক্ষ্য-প্রমাণে নিজেরাই নারীর প্রতি চরম বর্বরতা প্রত্যক্ষ করেছি।’

শুনানির সমাপনী ঘোষণা করে পারমান্যান্ট পিপলস ট্রাইব্যুনালের সভাপতি আর্জেন্টাইন বিচারক আগামীকাল শুক্রবার সকাল ১০টায় রায় ঘোষণার তারিখ ধার্য করেন।

শুনানির শেষ পর্যায়ে আসামি পক্ষের আইনজীবী মিয়ানমারের অবস্থান তুলে ধরেন। এ সময় অং সান সু চির ভাষণ সম্প্রচার করা হয়। এই শুনানিতে উপস্থিত হয়ে বা প্রতিনিধির মাধ্যমে বক্তব্য পেশের জন্য ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে তাঁদের চিঠি দেওয়া হলেও এর কোনো উত্তর আসেনি। গতকাল শুনানিতে অংশ নিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজ্ঞ এবং মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গণহত্যা-সংক্রান্ত সাবেক বিশেষজ্ঞ গ্রেগরি স্ট্যানটন বলেন, অং সান সু চি রোহিঙ্গাদের পরিচয় শনাক্তকরণের যে প্রক্রিয়া চালুর ঘোষণা দিয়েছেন, সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সর্বতোভাবে সতর্ক থাকতে হবে। সু চি যেন বিশ্বকে বোকা বানাতে না পারেন। তিনি তাঁর ভাষণে ‘অব্যাহতভাবে গণহত্যাকারী সামরিক বাহিনী’র পক্ষে দেওয়া তাঁর ‘সাফাই বক্তব্য’ অগ্রহণযোগ্য বলে চিহ্নিত করেন। তাঁর মতে, অং সান সু চি তাঁর সর্বশেষ ঘোষণায় যেভাবে যাচাইপ্রক্রিয়া চালুর প্রস্তাব বিশ্বের সামনে পেশ করেছেন, সেটি একটি কূটকৌশল।

ড. গ্রেগরি এর আগে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জন্য আন্তর্জাতিক রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনালের খসড়াসহ বিভিন্ন দেশের গণহত্যার বিচারে মার্কিন সরকারের পক্ষে দায়িত্ব পালন করেছেন। ড. স্ট্যানটন অং সান সু চির নতুন নীতিকে আমেরিকার ইতিহাসের কুখ্যাত জেমস ক্রো আইনের সঙ্গে তুলনা করেন। উনিশ শতকের ওই কালো আইনসহ নানা উপায়ে আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে শ্বেতাঙ্গরা আফ্রিকার ক্রীতদাসদের ভোটাধিকার রুদ্ধ করেছিল, ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ওই আইন টিকে ছিল। জেনোসাইড ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা স্ট্যানটন বলেন, সু চির সরকারের সংঘটিত ‘জেনোসাইডাইল ম্যাসাকার’ (গণহত্যামূলক নিধনযজ্ঞ) আন্তর্জাতিক আইনে ‘নবম ও দশম স্তরে’ পৌঁছে গেছে। নবম ধাপ হলো নিশ্চিহ্নকরণ (এক্সটারমিনেশন) এবং দশম ধাপ হলো প্রত্যাখ্যান করা। তিনি মিয়ানমারের গণহত্যা তদন্তে আসিয়ান ও জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলকে তদন্ত শুরু করতে এবং আসিয়ান রাষ্ট্রগুলোকে পলায়নপর রোহিঙ্গাদের জন্য তাদের দেশের সীমান্ত খুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

গতকালের শুনানিতে বিশেষজ্ঞ সাক্ষী হিসেবে ড. সি আর আবরার বলেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যথার্থই ২৫ আগস্টের পরে আসা রোহিঙ্গাদের দিকে মনোযোগ দিয়েছে। কিন্তু তাদের ১৯৯১-৯২ সালে আসা রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা ও সমর্থনদানের কথা বিবেচনায় নিতে হবে। আঞ্চলিক নেতাদের বুঝতে হবে এর নিরাপত্তাগত প্রভাব শুধু মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে সীমিত থাকবে না।

কৌঁসুলিদের পক্ষ থেকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চি সরকারের জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতি সমগ্র নীতিকে অশুভ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কৌঁসুলিরা যেসব সাক্ষ্য-প্রমাণ ও আলামতের ভিত্তিতে সামরিক বাহিনী ও সু চিকে দোষী সাব্যস্ত করার দাবি করেছেন, তার মধ্যে ২৫ আগস্টের পরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তৈরি করা ২৫ মিনিটের একটি ভিডিও ফুটেজ, প্রামাণ্যচিত্রনির্মাতা শফিউর রহমানের তৈরি করা ফুটেজ, মিয়ানমারের রাখাইনে ধারণ করা জাহেদ নামের একজনের ভিডিও ক্লিপ, জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনের তালিকাভুক্ত করা বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘন অবলম্বনে তৈরি করা একটি ক্লিপও রয়েছে। গতকাল ডেপুটি চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘রাখাইনের তুলাতুলি গ্রাম থেকে আসা এক নারীর জবানবন্দি শুনে আমাদের পক্ষে অশ্রু সংবরণ কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ, তিনি তাঁর চোখের সামনে ২০০ থেকে ২৫০ জন নারীকে নিহত এবং শিশুদের কাটাছেঁড়া করে তাদের মৃতদেহ নদীতে নিক্ষেপ করতে দেখেছেন। আমরা এমন ফুটেজ দেখেছি, যাতে প্লাস্টিকের চালের ব্যাগে লাশ ভাসছে মিয়ানমারের জলসীমায়। ৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে নেওয়া এক রোহিঙ্গা নারী তাঁর জবানবন্দিতে বলেছেন, কী করে গণধর্ষণের জন্য ২০ তরুণীকে বাছাই করা হয়েছে, এরপর খালি বাড়িতে বন্দী রেখে তাদের জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে।’

ডেপুটি প্রসিকিউটর আরও বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশনের সভাপতি কাজী রিয়াজুল হকের জবানবন্দিতে জেনেছি কী মানবিকতায় বাংলাদেশ সম্প্রতি চার লাখের বেশি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে। তাদের সহায়তার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানো।’ কাজী রিয়াজুলের মতে, বাংলাদেশে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৫০ ভাগ, অর্থাৎ প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার শিশু-কিশোর, এরপর বেশির ভাগ নারী।

 

অরোহিঙ্গা মুসলিমদের জবানবন্দি

মিয়ানমারের ওপর গঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক গণ-আদালতে গতকাল রাখাইন থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরবর্তী মান্দেলে বিভাগের মুসলমানদের ওপর পদ্ধতিগত নিপীড়ন ও বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরেছেন মিয়ানমারত্যাগী পাঁচজন অরোহিঙ্গা মুসলিম। তাঁরা তাঁদের জবানবন্দিতে বলেছেন, রোহিঙ্গা মুসলিম বলেই নয়, মিয়ানমার সরকারের জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের শিকার বর্মী আদিবাসী মুসলিমরাও হয়েছেন।

গতকাল জবানবন্দি প্রদানকারী বর্মী পাঁচ মুসলিম হলেন, চৌ উইন, তু সামাও ওরফে রাশিদা আবদুল আজিজ (৪০), মং মং ওরফে হাজি আবদুল রাজাক জাফরুদ্দিন, ২০১৩ সালে মান্দেলের মেতিলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রত্যক্ষদর্শী দুই ভাই সি তু ওরফে বারাকাত (২৫) এবং কাউন ঠ্যাক ওরফে আরাফাত (২১)। তাঁরা আশঙ্কা ব্যক্ত করেন, রোহিঙ্গাদের জাতিগত পরিচয় এবং ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ শুরুর একপর্যায়ে যেভাবে গণহত্যা শুরু হয়েছে, তাতে তাদের জীবনেও একই অবস্থা নেমে আসতে পারে। ২০১৫ সালে মিয়ানমার সরকারের পরিসংখ্যান মতে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা বাদেও চার লাখ মুসলিম রয়েছে।

উল্লেখ্য, ওই পাঁচজনের মধ্যে চৌ উইন লন্ডনে এবং বাকি চারজনই কুয়ালালামপুরে থাকেন। গতকাল শুনানিকালে মং মং উল্লেখ করেন, তিনি মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন। এবং এখানে জাতিসংঘ উদ্বাস্তু হাইকমিশন ইউএনএইচসিআর তাঁকে উদ্বাস্তুর মর্যাদা দিয়ে কার্ড দিয়েছে। এ সময় বিচারক প্যানেল থেকে প্রশ্ন করা হয়, এর আগে শুনানিতে বলা হয়েছে, মালয়েশিয়ায় তাঁরা উদ্বাস্তুর মর্যাদা পাননি। এ সময় মং মং উল্লেখ করেন, মিয়ানমারের মান্দালে থাকতে তিনি মুসলমানদের নেতা ছিলেন। সেই সুবাদে তাঁর সঙ্গে আগে থেকেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যোগাযোগ ছিল এবং তিনি উদ্বাস্তুর মর্যাদা পেয়েছেন। তবে শুনানিতে এটা পরিষ্কার হয় যে মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত রোহিঙ্গারাও সহজে উদ্বাস্তুর মর্যাদা পাচ্ছেন না। উদ্বাস্তু কার্ডের পরের ব্যবস্থা হলো অ্যাসাইলাম কার্ড পাওয়া। সেটা পেয়েছেন রাশিদা। কিন্তু ওই দুই সহোদর বারাকাত ও আরাফাত পেয়েছেন প্রত্যাগত রোহিঙ্গা হিসেবে একটি সাধারণ সনদ।

চৌ উইন লন্ডনভিত্তিক বার্মা হিউম্যান রাইটস নেটওয়ার্কের নির্বাহী পরিচালক। তিনি তাঁর জবানবন্দিতে স্পষ্ট করেন, ১৯৮২-তে নাগরিকত্ব আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকে শুধু যে রোহিঙ্গা মুসলিমরাই বৈষম্যের শিকার হন, তা নয়। চৌ উইনের বাড়ি রেঙ্গুনের শহরতলিতে, ২০০৯ সালে তিনি থাইল্যান্ড হয়ে লন্ডনে পাড়ি জমান। তাঁর আর দেশে ফেরা হয়নি।

তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গা-বহির্ভূত মুসলিমদেরও রাষ্ট্রবিহীন করার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। আর সেটারও শুরু ১৯৬৩ সালে নে উইনের সামরিক অভ্যুত্থানের পরে। তাঁর কথায়, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নীতি হলো, বার্মা হলো বুর্মনদের জন্য, অন্য কারও জন্য নয়। সে কারণে তারা ষাটের দশক থেকে দুটি আইন কার্যকর করছে। একটি লিখিত আইন, সেটি বিশ্ব জানে এবং মনে করে কিছু সমস্যা থাকলেও এই আইন চলে। কিন্তু বিশ্ব যেটা জানে না, সেটা হলো মিয়ানমারের অলিখিত আইন। এই আইন দেখা যায় না। কিন্তু এটাই শক্তিশালী। এটাই অনেক বেশি কার্যকর। ১৯৬৩ সাল থেকে তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে অলিখিত আইন দ্বারা চারটি উদ্দেশ্য হাসিল করা বজায় রাখছে। এটি হলো সামরিক, পুলিশ ও রাজনীতিতে যাতে রোহিঙ্গারা না যেতে পারে, উঁচু কোনো নির্বাহী পদে বা বড় ব্যবসা-বাণিজ্যে তারা যাতে যুক্ত হতে না পারে। ১৯৮২ সালের আইন এমনভাবে করা, যাতে মুসলিমরা বার্মা ছেড়ে যায়। তারা বিধান করেছে, বর্মি নাগরিকত্ব পেতে হলে এটা প্রমাণ করতে হবে যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পূর্বপুরুষেরা ১৮২৪ সালের আগে মিয়ানমারে এসেছেন।

উল্লেখ্য, গতকালের শুনানিতে বারবার সু চির নাগরিকত্ব যাচাইয়ের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। মি. উইন বলেন, এটা কোনোভাবেই যাচাই করা সম্ভব নয়। আবার তারা সময়ে সময়ে সরকারি আদেশ দ্বারা নতুন নতুন কার্ড পদ্ধতি চালু করে আবার তা বিলোপ করে থাকে। যেমন গত বছর থেকে তারা এনভিসি বা ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড চালু করেছে। এর লক্ষ্য হলো অরোহিঙ্গা মুসলিম যারা বাকি আছে, তাঁদের কৌশলে রাষ্ট্রবিহীন করা। ২০১৫ সালে তারা ‘হোয়াইট কার্ড’ চালু করে আবার বিলোপ করে। কারও নাগরিকত্ব বাতিলের আগে তারা একটা অজুহাত তুলবে। এরপর তারা তাকে এনভিসি দেবে। এর ফলে কারও আপনাআপনি নাগরিকত্ব যাবে। কারণ, এনভিসির কোনো মেয়াদ থাকবে না। এর অর্থ দাঁড়াবে এনভিসি কার্ডধারী মানেই তাদের কোনো নাগরিক অধিকার না থাকা। তিনি দাবি করেন, ১৯৬২ সালের পর সমগ্র মিয়ানমারের কোথাও মুসলিম বা খ্রিষ্টানরা কোনো নতুন মসজিদ বা গির্জা তৈরি করতে পারেনি। অথচ ভিক্ষুরা তাঁদের খেয়াল-খুশিমতো মঠ তৈরি করেছেন। ৫ সেপ্টেম্বর তাঁর সংগঠন বার্মা নেটওয়ার্ক ব্যাংককে প্রকাশ করা এক রিপোর্টে বলেছে, মিয়ানমারে এখন ২১টি স্থান আছে, যেখানে মুসলমানদের কোনো প্রবেশাধিকার নেই।

হাজি আবদুল রাজাক মান্দেলার বিভিন্ন স্থানে গত কয়েক বছরে সরকারি বাহিনীর মদদে কী করে মসজিদ ও মাদ্রাসা ধ্বংস বা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, স্লাইডে তার সচিত্র প্রতিবেদন তুলে ধরেন। আবার তিনি একই সঙ্গে এই তথ্যও দেন, অনেক ক্ষেত্রে সরকারি বাহিনী উসকানি দিলেও শান্তিপ্রিয় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মুসলমানদের পাশে সহানুভূতির সঙ্গে দাঁড়িয়েছেন। সাহায্য ও সহমর্মিতার হাত প্রশস্ত করেছেন। ২০১৩ সালে একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত মেতিলা হত্যাকাণ্ডে ৩০ জন মুসলিমকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পরে তিনি আত্মধর্ম সমাবেশ করার উদ্যোগ নিলে পুলিশ তার অনুমতি দিয়েও পরে তা ভণ্ডুল করে দেয়। ওই হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ওই দুই সহোদর গণ-আদালতে সাক্ষ্য দেন।

রাশিদা ২০১৪ সালে মান্দেলা থেকে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়ায় আসেন। তিনি পাওয়ার পয়েন্ট দিয়ে দেখান, মান্দেলেতে ২০০১ সালের ১৬ মে সংঘটিত এক দাঙ্গার পরে সরকার ওই অঞ্চলের ১৪টি মসজিদের মধ্যে ১১টি বন্ধ করে দেয়। এরপর মাত্র চারটি পুনরায় খোলার অনুমতি পেয়েছে। আরেকটি মসজিদকে তারা ভেষজ ওষুধের স্কুলে পরিণত করেছে। এ ছাড়া তারা বিভিন্ন সময়ে যেকোনো অজুহাতে মসজিদ বাজেয়াপ্ত করে প্রাইভেট ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেয়।

বিবাদী পক্ষের আইনজীবী বলেন, সংবিধি আসামি পক্ষের অনুপস্থিতিতে দুটি পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে। একটি হলো স্বাধীন ডিফেন্স বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা, অন্যটি হলো অভিযুক্ত ব্যক্তিরা তর্কিত বিষয়ে যেসব বক্তৃতা-বিবৃতি এবং সময়ে সময়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তার সংকলন বিবেচনায় নেওয়া। এ ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল দ্বিতীয় বিকল্প বেছে নিয়েছেন। এ পর্যায়ে বিবাদী পক্ষের আইনজীবী হিসেবে তিনি রোহিঙ্গা, কাচিন ও অন্য সংখ্যালঘুদের বিষয়ে মিয়ানমারের নেতারা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যেসব বিবৃতি দিয়েছেন, তার ভিত্তিতে মিয়ানমারের অবস্থান তুলে ধরেন। বিকেল তিনটায় ট্রাইব্যুনাল কক্ষে এমআইটিভি থেকে ধারণ করা অং সান সু চির ভাষণ শোনা হয়।

LEAVE A REPLY