ভোলা নিউজ ২৪ ডটনেট ।।রোহিঙ্গা মুসলিম। তারা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত সংখ্যালঘু। তাদের কোনো নাগরিকত্ব নেই। ফলে তারা রাষ্ট্রহীন, অনাকাঙ্ক্ষিত। অষ্টম শতাব্দী থেকে মিয়ানমারের রাখাইনে তাদের পূর্ব-পুরুষদের বসবাসের ইতিহাস আছে। তারপরও তারা নাগরিকত্বহীন। আগে রাখাইনের নাম ছিল আরাকান। সেখানেই ১১ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম গাদাগাদি হয়ে অনিশ্চিত জীবন-যাপন করেন। এ রাজ্যটি মুসলিম প্রধান বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া। বৌদ্ধ প্রধান দেশ মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দেয় না। তাদেরকে অন্য কেউ স্বীকৃতি দেয় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তাদেরকে অবৈধ হিসেবে আখ্যায়িত করতে শুরু করে। তাদেরকে বাঙালি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে আখ্যায়িত করতে থাকে। মিয়ানমারের এই ধারা ক্রমশ জোরালো হতে থাকে। এর ফলে রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমরা বর্ণবাদী যুগের মতো অমানবিক পরিস্থিতির মুখে পড়েন। তাদের অবাধ চলাচলের স্বাধীনতা দেয়া হয় না। তাদের কোনো শিক্ষার অধিকার নেই। উল্টো সরকারের বিভিন্ন বাহিনী তাদেরকে ধাপে ধাপে দেশ থেকে বের করে দিতে থাকে। হত্যা করতে থাকে। গত এক বছরে রোহিঙ্গা গ্রামগুলোর ওপরে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংসতা নিষ্ঠুরতম ও তীব্র আকার ধারণ করেছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পক্ষে যারা কথা বলছেন, তারা বলছেন এটা একটি গণহত্যা। লন্ডনের অনলাইন টেলিগ্রাফে এসব কথা লিখেছেন সাংবাদিক নিকোলা স্মিথ ও চারলোটি ক্রোল। এতে তারা আরো লিখেছেন, জাতিসংঘ পর্যন্ত রিপোর্ট করেছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী জাতি নির্মূল করছে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এই অমানবিক আচরণে মিয়ানমারের বেসামরিক নেত্রী, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চির ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে গেছে। এক সময় তাকে মানবাধিকারের প্রতীক হিসেবে দেখা হতো বিশ্বজুড়ে। বিশেষ করে পশ্চিমা দুনিয়ার কাছে তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রিয়। অর্জন করেছিলেন অসংখ্য মানুষের ভালবাসা। কিন্তু তা হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। এখন তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষোভ, নিন্দার মুখোমুখি। বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলো তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের সেনারা রাখাইনে গণধর্ষণ, হত্যা, অগ্নিসংযোগ করছে। শিশুদেরকে মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিচ্ছে। এরপর তাদেরকে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে নদীর পানিতে না হয় আগুনে। এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারেননি সু চি। দৃশ্যত তিনি প্রকাশ্যে সেনাবাহিনীর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছেন। তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলছেন, রোহিঙ্গারা অবৈধভাবে মিয়ানমারের সীমান্তে প্রবেশ করে বসবাস করছে। এর ফলে তার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মালালা ইউসুফজাই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। সু চির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন এই ট্র্যাজেডির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মুখ খুলতে। ২৫শে আগস্ট শুরু হওয়া সেনাবাহিনীর নৃশংস অভিযানের পর মাত্র দু’সপ্তাহের মধ্যে কমপক্ষে এক লাখ ২৫ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে উপচেপড়া শিবিরগুলোতে আশ্রয় খুঁজছেন। দেশে তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। গুলি করা হচ্ছে। তাই তিল ধারণের ঠাঁই নেই বাংলাদেশের এমন আশ্রয় শিবিরগুলোতে ছুটছেন তারা। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এ মাসের শুরুতে বলেছে, তাদের অভিযানে কমপক্ষে ৪০০ মানুষ নিহত হয়েছে। তবে মানবাধিকার বিষয়ক কর্মীদের দাবি এ সংখ্যা অনেক বেশি। তাদের হিসাব মতে এ সংখ্যা কমপক্ষে এক হাজার। তার চেয়েও বেশি বলে তাদের বিশ্বাস। রাখাইনে অবস্থানকারী আড়াই লাখ অধিবাসীর কাছে জাতিসংঘের বিভিন্ন এজেন্সি জরুরি ভিত্তিতে যে খাদ্য, পানি ও ওষুধ পৌঁছে দেয় তাদের সেই কার্যক্রম আপাতত বন্ধ করে দিয়েছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। ওইসব রোহিঙ্গার জন্য খাদ্য, পানি ও ওষুধে ভীষণ প্রয়োজন বেঁচে থাকার জন্য। কিন্তু মিয়ানমার জাতিসংঘের এজেন্সিগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ায় নিহতের সংখ্যা অনেক বাড়বে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলমান নিষ্পেষণের ফলে অবশ্যই সশস্ত্র প্রতিরোধ (যদিও অসংগঠিত) গড়তে ভূমিকা রাখবে। সেনাবাহিনীর ‘ক্লিয়ারিং অপারেশনস’-এর ফলে এর আগে ২০১৬ সালের অক্টোবরে এবং এবার বাণের পানির মতো মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। সেনাবাহিনী বলছে, তারা ওই অভিযান চালাচ্ছে উগ্রপন্থি, যারা আরাকান রোহিঙ্গা সলভেশন আর্মি নামে পরিচিত, তাদের বিরুদ্ধে। এই গ্রুপটি পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ৩০টি পোস্টে হামলা চালিয়েছিল। রোহিঙ্গা অধিকারকর্মীদের দাবি, এসব উগ্রপন্থি প্রধানত যুবক শ্রেণীর। সরকারের বেপরোয়া নিষ্পেষনের চাপে তারা এমন পথে নামতে বাধ্য হয়েছে। সেপ্টেম্বরের প্রথমদিকে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে ‘বার্মা হিউম্যান রাইটস নেটওয়ার্ক’। এতে ২০১২ সাল থেকে মিয়ানমারের মুসলিমদের ওপর পর্যায়ক্রমিক নির্যাতনের ক্রমবর্ধমান ঘটনাকে ডকুমেন্ট বা প্রামাণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এর মাধ্যমে মিয়ানমার ‘মুসলিম মুক্ত এলাকা’ সৃষ্টির চেষ্টা করছে বলে বলা হয় ওই রিপোর্টে। বলা হয়, কাউকে আইডি কার্ড দেয়া হয় না। ইসলামিক যেসব পবিত্র দিনে ছুটি থাকে তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কট্টর জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধরা যখন মুসলিম বিরোধী অবস্থান জোরালো করে তখন যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, সরকারি নিষ্পেষণ যেন তারই প্রতিচ্ছবি। এখন পর্যন্ত আরাকান রোহিঙ্গা সলভেশন আর্মি’কে বর্ণনা করা হচ্ছে উচ্ছৃঙ্খল একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী হিসেবে। তাদের কাছে রয়েছে ছুরি, লাঠি ও কিছু বিস্ফোরক পদার্থ। অন্যদিকে রয়েছে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনী ও বিপুল সংখ্যক বৌদ্ধ। তবে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে নৃশংসতার বিরুদ্ধে মুসলিম বিশ্বের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভকেও দেখা হচ্ছে অন্যভাবে। বলা হচ্ছে, মিয়ানমারের ভিতরে যেসব উগ্রপন্থি বা জঙ্গি সৃষ্টি হচ্ছে বলে আশঙ্কা রয়েছে তাকে আরো জটিল করে তুলতে পারে এ ঘটনা। আশঙ্কা করা হচ্ছে, তারা আন্তর্জাতিক জিহাদী গোষ্ঠীগুলোর সমর্থন পেয়ে যেতে পারে। এরই মধ্যে ইয়েমেনের আল-কায়েদার অনুসারীরা মিয়ানমারের এই নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার ডাক দিয়েছে। অন্যদিকে আফগানিস্তানের তালেবানরা মুসলিমদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। তারা বলেছে, মিয়ানমারে নির্যাতিত মুসলিমদের সামর্থ্য অনুযায়ী সহায়তা করতে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিষয়ে কাজ করছে এমন একটি মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপ ফোরটিফাই রাইটসের পরিচালক ম্যাথিউ স্মিথ বলেছেন, এমন ঘটনার বিস্তার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তিনি বলেন, নিশ্চিত করে বলা যায়, আন্তর্জাতিক যেসব উগ্র সংগঠন আছে তারা রাখাইনের এই পরিস্থিতিতে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করবে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার একটিই উত্তম পন্থা রয়েছে। তা হলো বেসামরিক মানুষের অধিকার সুরক্ষিত করা। কিন্তু মিয়ানমার করছে তার ঠিক উল্টোটা।