ভোলা নিউজ ২৪ ডট নেটঃ ৫ জুলাই লুঝনিকি স্টেডিয়ামে শিরোপাটা উঁচিয়ে ধরবেন কে? সেই পরম সৌভাগ্য হবে কোন দলের অধিনায়কের? মাথার ওপর শিরোপাটা তুলে বিশ্বজয়ের হাসি ফুটবলে তাঁর মুখে। আর ঠিক তখনই হয়তো প্রৌঢ় কোনো ফুটবলামোদীর স্মৃতিতে ভেসে উঠবেন হিলদারালদো লুইস বেলিনি।
ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের পাঁড় সমর্থক না হলে নাম দিয়ে তাঁকে না-ও চিনতে পারেন। কিন্তু বিশ্বকাপ ইতিহাসের একটি পাতায় বেলিনি অমর। তাঁর আগে আর কেউ শিরোপাটা মাথার ওপর উঁচিয়ে ধরেনি।
একবার কল্পনা করুন, গোটা পৃথিবী আপনাকে দেখছে। মাঠে মঞ্চমতো একটি জায়গার মধ্যমণি হিসেবে দাঁড়ানো আপনার হাতে তুলে দেওয়া হলো বিশ্বকাপ। পরম মমতায় শিরোপাটা দুই হাতে নিয়ে তা তুলে ধরলেন মাথার ওপরে, আর মুখে বিশ্বজয়ের হাসি। সেই কবে থেকে বিশ্বকাপ মানেই তো শেষ দৃশ্যে এই চিরায়ত উদ্যাপন।
কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয় প্রথম কবে থেকে এই উদ্যাপন?
তথ্যপ্রযুক্তির এই সময়ে প্রশ্নটার জবাব খুঁজে বের করা তেমন কঠিন কোনো কাজ নয়। খুব বেশি ঘাঁটাঘাঁটি নয়, প্রতিটি টুর্নামেন্টে শিরোপা জয়ের ছবিগুলো দেখলেই খটকাটা চোখে পড়ে। ত্রিশে হোসে নাসাজ্জির রেকর্ডটা কেউ কখনো ভাঙতে পারবে না। বিশ্বকাপজয়ী প্রথম অধিনায়ক বলে কথা! চৌত্রিশে উমবের্তো ক্যালিগারিস, আটত্রিশে জিউসেপ্পে মিয়াজ্জা, পঞ্চাশে ওবদুলো ভ্যারেলা আর চুয়ান্নতে ফ্রিৎজ ওয়াল্টার—এঁরা সবাই বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক। কিন্তু শিরোপা মাথার ওপরে তুলে কাউকেই উচ্ছ্বাসে ভেসে যেতে দেখা যায়নি। এমন কোনো ছবি নেই।
ছবি আছে আটান্নর। বেলিনির হাতে বিশ্বকাপ (জুলে রিমে ট্রফি), উঁচিয়ে ধরেছেন মাথার ওপর। চোখে-মুখে গর্বের হাসি। ২৯ জুন, ১৯৫৮ সালে সুইডেনের রাসুন্ডা স্টেডিয়ামের সেই ছবিটা বিশ্বকাপের ইতিহাসে সাবেকি প্রথা ভেঙে গড়েছে নতুন প্রথা—শিরোপা মাথার ওপর উঁচিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সার্থক উদ্যাপন। অবাক করা বিষয় হলো, এই উদ্যাপন পূর্বপরিকল্পিত ছিল না!
বেঁচে থাকতে বেলিনি নিজেই বলে গেছেন এ সম্বন্ধে। শিরোপা তিনি হাতে নেওয়ার পর চিত্রগ্রাহকেরা তা উঁচিয়ে ধরতে বলেছিলেন, ‘ছবি তুলতে যেন পরিষ্কার ফ্রেম পাওয়া যায়।’ বেলিনির ভাষায়, ‘এ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা ছিল না। চিত্রগ্রাহকেরা আমাকে শিরোপাটা উঁচিয়ে ধরতে বলেছিলেন।’
ব্রাজিল অধিনায়কও বাধ্য ছেলের মতো চিত্রগ্রাহকদের কথা রেখেছিলেন। পরে তা হয়ে গেল বিশ্বকাপের ‘ট্রেডমার্ক’ উদ্যাপন। তারপর ১৪টি বিশ্বকাপের শেষ দৃশ্যে থেকে গেছে এই একই রকম উদ্যাপন। শুধু মানুষ পাল্টেছে, কিন্তু শিরোপাটা থেকে গেছে মাথার ওপরেই।
বেলিনি পরের বিশ্বকাপও জিতেছেন। কিন্তু শিরোপাটা উঁচিয়ে ধরতে পারেননি। সেবার ব্রাজিলের অধিনায়ক ছিলেন মাউরো রামোস। বেলিনির অন্তরঙ্গ বন্ধু। দুজনই ডিফেন্ডার। খেলতেন একই পজিশনে (সেন্টারব্যাক)। দলে একজন আরেকজনের কাছে জায়গা হারালেও দুজনের বন্ধুত্বে কখনো চিড় ধরেনি। আর তাই, এ কথা বলাই যায়, ব্রাজিল তাঁদের ইতিহাসে প্রথম দুটি বিশ্বকাপ জিতেছে দুই বন্ধুর নেতৃত্বে। ’৬২ চিলি টুর্নামেন্টে মাউরোও তাঁর বন্ধুকে অনুসরণ করে উঁচিয়ে ধরেছিলেন শিরোপা। এভাবে ‘৬৬-তে ববি মুর, ’৭০-এ কার্লোস আলবার্তো, ’৭৪-এ বেকেনবাওয়ার, ’৭৮-এ ড্যানিয়েল প্যাসারেল্লা, ’৮২-তে দিনো জফ, ’৮৬-তে ম্যারাডোনা—২০১৪-তে ফিলিপ লাম।
বেলিনি ব্রাজিলের ইতিহাসে অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার হলেও পেলে-গারিঞ্চা দূর অস্ত, কার্লোস আলবার্তো কিংবা দিদিদের মতো তারকাখ্যাতি পাননি। ব্রাজিলে নিল্টন স্যান্টোস ও দালমা স্যান্টোস ছাড়া বাদবাকি ডিফেন্ডারদের ক্ষেত্রে এটাই বুঝি নিয়তি! রবার্তো কার্লোস, কাফু, লুসিও হয়তো ব্যতিক্রম, কিন্তু সেটা একুশ শতকে। সেই যুগের ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে আক্রমণই ছিল শেষ কথা। ডিফেন্ডাররা যেন শুধুই খেলার সাথি!
তবে বেলেনি ব্রাজিলিয়ানদের হৃদয়ে অমরত্ব পেয়েছেন। চার বছর আগে তাঁকে চিরকালের মতো হারানোর পর ব্রাজিলের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফ বলেছিলেন, ‘১৯৫৮ বিশ্বকাপে ট্রফিটা উঁচিয়ে ধরে ব্রাজিলিয়ানদের হৃদয়ে চিরকালীন ঠাঁই করে নিয়েছেন বেলেনি। এরপর প্রতিটি বিশ্বকাপেই তাঁর সেই মুহূর্তের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।’
নির্ভেজাল ডিফেন্ডার বলতে যা বোঝায়, বেলিনি ছিলেন ঠিক তাই। উচ্চতা এবং শক্ত-সামর্থ্য শরীর কাজে লাগিয়ে সেই সময় ব্রাজিলিয়ান রক্ষণভাগের অতন্দ্রপ্রহরী হয়ে উঠেছিলেন। ছিল দুর্দান্ত নেতৃত্বগুণও। ’৫৮ টুর্নামেন্টে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে পেলে-গারিঞ্চার বিশ্বকাপ অভিষেক হতো না যদি, বেলিনি ও নিল্টন স্যান্টোস মিলে ব্রাজিল কোচ ভিসেন্তে ফিওলাকে রাজি না করাতেন। এই দুই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন খেলোয়াড়ের কথা শুনেই পেলে-গারিঞ্চাকে খেলান ফিওলা। বাকিটা সবাই জানেন।
কিন্তু বেলিনির মৃত্যুর আসল কারণটা কি সবাই জানে? ২০১৪ সালের ২০ মার্চ সাও পাওলোর পার্থিব সব লেনা-দেনা চুকিয়ে দেন বেলিনি। তখন মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল আলঝেইমার্স। তাঁর এ রোগ ছিল সত্য, কিন্তু এটাই মৃত্যুর কারণ, এ কথাটি সত্য নয়। মৃত্যুর আগে গবেষণার জন্য নিজের মগজ দান করে গিয়েছিলেন বেলিনি। গবেষকেরা পরীক্ষা করে দেখেছেন তিনি ক্রনিক ট্রমাটিক এনসেফ্যালোপ্যাথি (সিটিই) রোগে ভুগেছেন। মস্তিষ্কে ক্রমাগত আঘাত পেলে এ রোগটা হয় এবং লক্ষণগুলোও আলঝেইমার্সের মতোই।
বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোপ্যাথোলজিস্ট ডা. অ্যান ম্যাকের মতে, চতুর্থ মাত্রার সিটিই রোগে ভুগেছেন বেলিনি। এটা আসলে রোগটির সবচেয়ে ভয়াবহ মাত্রা। এসব ক্ষেত্রে মানুষ চরম ভুলোমনা হয়ে পড়ে। বেলিনির জীবনসঙ্গী গিজেলদা চার বছর আগে জানিয়েছিলেন, তাঁর স্বামীকে ২০ বছর আগে থেকেই সবকিছু ভুলে যাওয়ার রোগে পেয়েছিল। ২০০৬ সালের দিকে তা আরও প্রকট হয়ে ওঠে। একবার তাঁকে বাজারে পাঠিয়েছিলেন গিজেলদা। কিন্তু বেলিনি বাড়ি ফিরেছিলেন খালি হাতে!
এখানেই শেষ নয়। ব্রাজিলিয়ান সংবাদমাধ্যম ‘ও গ্লোবো’কে গিজেলদা জানিয়েছিলেন, ফুটবল ছাড়ার অনেক পরে বেলিনি একদিন ট্যাক্সি ভাড়া করে সাও পাওলো যাওয়ার মনস্থ করলেন। সেখানে একটি দলের হয়ে কয়েক দশক আগে তিনি খেলতেন। কিন্তু ভুলোমনা বেলিনির তখন মনে হয়েছিল, তিনি খেলা ছাড়েননি, অনুশীলনে যাওয়া দরকার!
মারাকানা স্টেডিয়ামের ফটকের সামনে বেলিনির একটি মূর্তি আছে। যদিও তাঁর মুখাবয়বের সঙ্গে সেই মূর্তির চেহারার কোনো মিল নেই। কিন্তু জুলে রিমে ট্রফি উঁচিয়ে ধরা সেই মূর্তি যেকোনো ব্রাজিলিয়ানের কাছেই অতিচেনা—বেলিনি। মানুষ আজও তাঁকে ভালোবাসে। তাঁকে মনে রেখেছে, বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরা শেখানোর জন্য।