নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধ ৩৭ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপিত শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এ ছাড়া জুয়েল নামে ৭ বছরের এক শিশুর অবস্থা আশঙ্কা।
নারায়ণগঞ্জের পশ্চিম তল্লা এলাকায় শুক্রবার রাত সাড়ে আটটার দিকে বায়তুস সালাত জামে মসজিদে এই ঘটনা ঘটে। এতে অর্ধশতাধিক মানুষ দগ্ধ হন। অনেকে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল বলেন, আহতদের মধ্যে প্রায় সবার অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
গুরুতর দগ্ধ ব্যক্তিদের শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নেওয়া হলে সেখানে স্বজনদের ভিড় বাড়তে থাকে। রাতে সেখানে গিয়ে দেখা যায় অনেক মানুষের জটলা। ফটক আটকানো। দগ্ধদের স্বজনদের বেশির ভাগই ভেতরে ঢুকতে পারেননি। দগ্ধদের উদ্ধার করে যারা এনেছিলেন, তাঁদের অনেকেই ভেতরে ঢুকেছিলেন। তাদের কাছ থেকেই দগ্ধদের খবর নিচ্ছিলেন উদ্বিগ্ন স্বজনেরা।
কেউ কাঁদছিলেন, আহাজারি করছিলেন। তাঁদের একজন খাদিজা বেগম বলেন, সেখানে নামাজ পড়তে গিয়ে দগ্ধ হন তাঁর ভাইয়ের ছেলে ২২ বছরের পোশাককর্মী কেনান। ভাতিজার খবর পাচ্ছেন না বলে হাউমাউ করে কান্না আর আহাজারি করছিলেন খাদিজা।
বার্ন ইউনিট সূত্র জানায়, ভেতরে দগ্ধ রোগীদের যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। দগ্ধ ব্যক্তিদের অনেকে আর্তনাদ করছেন। অনেকের শরীরের বেশিরভাগ অংশ পুড়ে গেছে।
বার্ন ইনস্টিটিউটের সহকারী পরিচালক হোসেন ইমাম সাংবাদিকদের বলেন, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি যথাযথ চিকিৎসা দেওয়ার। একটা শিশু খুবই ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশনে আছে। শিশুটির নাম জুয়েল, বয়স ৭ বছর। বাকি রোগীদের প্রায় সবারই ৩০ শতাংশের বেশি পুড়ে গেছে। তাদের সবারই মুখ ও শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। বার্ন ইউনিটের যত রকমের ব্যবস্থা আছে তার শতভাগ আমরা ব্যবহার করব। সরকার প্রধান থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সবাই খোঁজ নিচ্ছেন। শুধু এই রোগীদের জন্যই আলাদা একটা বিশেষায়িত ওয়ার্ড প্রস্তুত করা হয়েছে।
পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী ও ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, এশার ফরজ নামাজের সময় হঠাৎই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এরপরেই পুড়ে যাওয়া জামা-কাপড় আর ঝলসে যাওয়া শরীর নিয়ে মসজিদ সংলগ্ন রাস্তায় জমে থাকা পানিতে দগ্ধ মুসল্লিদের গড়াগড়ি করতে দেখেন এলাকাবাসী। তাঁদের আর্তচিৎকারে আর গোঙানিতে মুহূর্তেই ছুটে আসেন এলাকার লোকজন। রিকশা, সিএনজিসহ বিভিন্ন যানবাহনে তাঁদের হাসপাতালে নেওয়া হয়।
বিস্ফোরণে মসজিদের ভেতরে থাকা ৬টি এসির সবগুলো পুড়ে গলে গেছে। মসজিদ ভবনের স্লাইডিং জানালার কাচ উড়ে গেছে, ভেতরে ফ্যান, বিদ্যুতের তাঁর, প্যানেল বোর্ড সবকিছু পুড়ে গেছে। আগুনের খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ৫টি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আধঘণ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে তারা মনে করছে গ্যাস পাইপ লাইনের লিকেজ থেকে মসজিদের ভেতরে গ্যাস জমে যায়। পরে বৈদ্যুতিক সর্ট সার্কিট বা অন্য কোনোভাবে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি হলে সেখানে শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটে ও আগুন লেগে যায়।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে স্থানীয় ইসলামি কাফেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সামছুজ্জামান ভাসানী বলেন, বিস্ফোরণে মসজিদের ভেতরে থাকা মুসল্লিদের কেউ অক্ষত পোশাক নিয়ে বের হতে পারেননি। তিনি বলেন, এই এলাকায় দীর্ঘ দিন ধরে গ্যাসের লিকেজ সমস্যা রয়েছে। বিষয়টি তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও কোন সুরাহানা হয়নি। তিনি মনে করেন গ্যাসের লিকেজ থেকে মসজিদের ভেতরে গ্যাস জমে এই বিস্ফোরণ হয়েছে। আগুন নেভাতে পানি দেওয়ার পরে ভেতরে গ্যাসের বুদবুদ হচ্ছে।
বিস্ফোরণের পরে রাত সাড়ে ৯টার দিকে ওই মসজিদে গিয়ে দেখা যায় মেঝেতে জমে আছে ফায়ার সার্ভিসের ছিটানো পানি। সেই পানিতে বুদবুদ উঠছে। মেঝের টাইলসের ফাঁক দিয়ে বের হওয়া গ্যাস ওই বুদবুদ তৈরি করছে বলে জানালেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
মসজিদটির ঠিক পেছনের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ ডিসি অফিসের অফিস সহকারী শামীম হোসেন ওই মসজিদে দগ্ধ হয়েছেন। তাঁর মেয়ে মুসলিমা আক্তার বলেন, নামাজ শুরু হওয়ার আগে ওই এলাকায় বিদ্যুৎ চলে যায়। তখন মসজিদের জেনারেটর চলার শব্দ পান তিনি। এরপর বিদ্যুৎ আসামাত্র বিকট শব্দে বিস্ফোরণের শব্দ পান।
এই মসজিদে নিয়মিত নামাজ পড়েন পোশাক কর্মী বিল্লাল হোসেন। তিনি বলেন, মসজিদের বারান্দায় নামাজ পড়ার সময় তাঁরা প্রায়ই গ্যাসের গন্ধ পেতেন। এটা বিভিন্ন সময় তাঁরা মসজিদের কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। কিন্তু কেউ গা করেননি।
গ্যাসের লিকেজ থাকার কথা জানালেন ফায়ার সার্ভিসের নারায়ণগঞ্জ অফিসের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ্ আরেফিনও। তিনি বলেন, লিকেজ থেকে জমে থাকা গ্যাস মসজিদের ভেতরে জমে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ধারণা করা হচ্ছে, মসজিদের মেঝের নিচ দিয়ে গ্যাসের লাইন গেছে। তাঁরা পানি দেওয়ার সময় মেঝে থেকে গ্যাসের বুদবুদ উঠছিল। এসি চালানের কারণে জানালা বন্ধ থাকায় গ্যাস ভেতরে জমা হয়ে ছিল। এরপর হঠাৎ করে বিদ্যুতের স্পার্ক থেকে এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।
প্রাথমিকভাবে বিষয়টিকে দুর্ঘটনা হিসেবে মনে করছেন জেলার পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেখানে নাশকতা বা অন্য কোন কিছুর আলামত আমরা পাইনি। তবুও আমরা সিআইডি ফরেনসিক ইউনিটকে খবর দেওয়া হয়েছে।’ পুলিশ সুপার জানান, নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) জায়দুল আলম বলেন, বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধ ৩৭ জনকে ইতিমধ্যে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়েছে। অনেকেই স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা নিচ্ছেন।