লন্ডন থেকে ফিরেই খালেদা জিয়ার কক্সবাজার সফর আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি ধরে নিয়ে নিজেদের প্রস্তুতি জোরদার করছে আওয়ামী লীগ। দলটি আগে থেকে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করলেও তা গতি পায়নি। খালেদা জিয়ার এ তৎপরতার কারণে এখন নড়েচড়ে বসছে ক্ষমতাসীন দল। এখন তাদের লক্ষ্য আসন্ন ছয় সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয় পাওয়া।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে এ পরিকল্পনার কথা জানা গেছে। সূত্রগুলো বলছে, বিদেশ থেকে ফিরেই খালেদা জিয়া এভাবে মাঠে নেমে পড়বেন, এটা আওয়ামী লীগ আগে থেকে আঁচ করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করছেন, সরকার রোহিঙ্গা সংকটসহ নানা পরিস্থিতি মোকাবিলায় কয়েক মাস ধরে ব্যস্ত আছে। এই সুযোগ নেওয়ার জন্যই তড়িঘড়ি করে মাঠে নেমেছে বিএনপি। দলটির পরবর্তী পদক্ষেপ কী হয়, এখন সেটা বোঝার চেষ্টা করছে সরকার।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রাজ্জাক বলেন, বিএনপি উল্টাপাল্টা কথা বলবে। কিন্তু তারা নির্বাচনে অংশ নেবে। এ জন্যই খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে এসেই রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দেওয়ার নামে ‘শোডাউনের’ চেষ্টা চালিয়েছেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগও মাঠে আছে, নির্বাচনের প্রস্তুতিও চলছে।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে রাজনীতি
করার সুযোগ নেই। তবে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কোথাও গেলে মানুষ রাস্তায় নামবে, এটাই স্বাভাবিক। তিনি বলেন, স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে নির্বাচনী আবহ থাকাটাও স্বাভাবিক। তবে মূল বিষয় হচ্ছে মানুষ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবে কি না। এ বিষয়টি যত দিন মীমাংসা না হবে, বিএনপি তত দিন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এর মীমাংসার তৎপরতা চালিয়ে যাবে।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া লন্ডন যাওয়ার কিছুদিন পর থেকেই সরকারি দলের নেতারা বিভিন্ন বক্তৃতায় বলছিলেন, খালেদা জিয়া আর ফিরবেন না। বিএনপির মাজা ভেঙে গেছে। বিএনপির আন্দোলন এখন টেমস নদীর পারে ইত্যাদি। আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখন মনে হচ্ছে খালেদা জিয়া লন্ডনে তিন মাস অবস্থান করে নানা ছক কষেছেন। দেশে ফিরে নিজের জানান দেওয়ার তাগিদ অনুভব করেছেন।
আওয়ামী লীগের অন্তত চারজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা হয় এ বিষয়ে। তাঁরা বলেন, বাংলাদেশে এখন জোট-মহাজোটের রাজনীতি চলছে। এগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এই দুই দলের কর্মকাণ্ডের ওপর অন্য দলগুলোর তৎপরতা নির্ভর করে। বিএনপি মাঠে নেমে গেলে অন্যরাও তৎপর হয়ে উঠবে। ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলো এবং বিভিন্ন অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচনী বাতাস কিছুটা এনে দিয়েছে। আগামী বছরের শুরুতে নতুন জোট গঠন, পুরোনো জোট থেকে কারও কারও বেরিয়ে যাওয়া, নতুন করে কোনো দলের যুক্ত হওয়া—এসব শুরু হয়ে যাবে। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকেও নানা পরামর্শ ও চাপ আসতে পারে। এই হিসাব-নিকাশ করেই খালেদা জিয়া কক্সবাজার সফরের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করেছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ ফারুক খান বলেন, খালেদা জিয়ার কক্সবাজার সফরের মুখ্য উদ্দেশ্য ত্রাণ দেওয়া নয়, নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়া।
আওয়ামী লীগ অনেক আগে থেকেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে। গত বছরের অক্টোবরে দলের জাতীয় সম্মেলনের পর থেকেই নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করা হয়। গত এক বছরে বিভাগীয় ও জেলা শহরে কর্মী ও প্রতিনিধি সভা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জেলায় জেলায় সরকারি সফরে গিয়ে রাজনৈতিক সমাবেশ করেছেন এবং আগামী নির্বাচনের জন্য ভোট চেয়েছেন। কিন্তু রমজান, শোকের মাস আগস্ট, ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে সৃষ্ট সংকট, বন্যা ও রোহিঙ্গা সমস্যার কারণে নির্বাচনী প্রস্তুতিতে ভাটা পড়ে।
আগামী ডিসেম্বর মাসে রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। আগামী বছর এপ্রিলের মধ্যে গাজীপুর, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র জানায়, এর মধ্যে ছয় সিটির সম্ভাব্য প্রার্থী ঠিক করে ফেলেছে দলটি। তাঁদের কাজ করার জন্য নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
এর বাইরে গত মে মাসে সারা দেশে সদস্য সংগ্রহ অভিযান উদ্বোধন করে আওয়ামী লীগ। প্রথমদিকে কিছুটা ধীরগতি থাকলেও গত সেপ্টেম্বর থেকে এতে জোর দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণে বেশ আয়োজন করে সদস্য সংগ্রহ অভিযানের উদ্বোধন করা হয়। গত শনিবার করা হয় মৌলভীবাজারে। এ সপ্তাহে রাজশাহীতেও কর্মসূচি আছে। সেখানে কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত থেকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বিষয়েও বক্তৃতা করবেন বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।
আওয়ামী লীগ দলীয় সূত্র জানায়, জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রার্থী বাছাইয়ে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা নানা সংস্থা দিয়ে তিন মাস অন্তর অন্তর জরিপ চালাচ্ছেন। নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবেই—এটা ধরে নিয়ে প্রস্তুতি নিতে মাঠপর্যায়ের নেতাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।