ইউনিসেফের সহায়তায় কিশোরী বান্ধব স্যানিটেশন ব্যবস্থা চালু হলো ভোলার টবগী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে

0
498

আদিল হোসেন তপু, ভোলা ভোলা নিউজ ২৪ ডটনেট :উপকূলীয় জেলা ভোলা। চারদিকে নদী বেষ্টিত এই দ্বীপজেলা ভোলা সদর উপজেলার টবগী মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ১৯২৫ সালে মেঘনার কূল গেষে বাপ্তা ইউনিয়নে নির্মিত হয় প্রতিষ্ঠানটি। বিদ্যালয়টি নির্মিত হওয়ার পর থেকে উত্তর-পূর্ব বাপ্তার অবহেলিতভাবে বেড়ে উঠা শিক্ষার্থীদের আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর হিসাবে কাজ করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। নানা চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে এগিয়ে চললেও প্রতিষ্ঠানটির প্রথম থেকেই সবচেয়ে ঝুকিঁপূর্ণ ব্যবস্থা ছিলো স্বাস্থ্য সম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থা। বর্তমানে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ৭০০জন রয়েছে যার অর্ধেকের বেশি ছাত্রী।
লেখাপড়ায় সুনাম অর্জন করলেও প্রতিষ্ঠানটির স্যানিটেশন সুবিধায় বড় সমস্যা দীর্ঘদিনের। ৭’শর বেশি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিদ্যালয়ে টয়লেট মাত্র দুটি। সে দুটির অবস্থাও নাজুক ও নোংরা পরিবেশের হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থীরা টয়লেট ব্যবহার করতো না। সেই সাথে পানির ব্যবস্থা তেমন না থাকায় অনেকেই স্বাস্থ্য সম্মতভাবে হাত ধৌত করতে পারতো না। এমনকি মেয়েদের জন্য মাসিককালীন সময় কোন ব্যবস্থাপনা ছিলো না বিদ্যালয়টিতে। ফলে শিক্ষার্থীরা নানা রোগে আক্রান্ত হতো। দিন দিন অনুপস্থিতির হার বাড়ছিলো পাল্লা দিয়ে।
শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সম্মতভাবে বেড়ে তোলার লক্ষ্যে নিয়ে এগিয়ে এলো ইউনিসেফ। তাদের সহায়তায় টবগী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চালু করা হয়েছে কিশোরী বান্ধব স্যানিটেশন ব্যবস্থা (বিদ্যালয় ওয়াস ব্যবস্থার) ও হাত ধোয়ার ডিভাইস নির্মান কার্যক্রম। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা স্বাস্থ্য সম্মত স্যানিটেশন ব্যবহার করার সুযোগ পাবে। যার বাস্তবায়ন করেছে বে-সরকারি উন্নয়ন সংস্থা কোস্ট ট্রাস্ট এর সম্মন্বিত শিশুবিবাহ রোধ (আইইসিএম) প্রকল্প। বর্তমানে এই প্রকল্প মাধ্যমে পাল্টে গেছে স্কুলের চিত্র।
শিক্ষার্থীরা জানায়, আগে আমাদের টয়লেট ব্যবস্থা ছিলো অনেকটা নোংরা পরিবেশে। ছেলে কিংবা মেয়ে সবারই টয়লেট ব্যবহার করতে অসুবিধা হতো। এখন ইউনিসেফ ও কোস্ট ট্রাস্ট এর মাধ্যমে টয়েলটগুলো আধুনিকভাবে পুর্ণনির্মান করায় আমাদের অনেক ভালো হয়েছে।
স্কুলের দশম শ্রেনীর ছাত্রী মারিয়া আক্তার মুন্নী বলেন, আগে আমাদের টয়লেট অনেক নোংরা ছিলো। টয়লেটে যেতেই লাইন লেগে থাকতো। অনেকেই বাধ্য হয়ে বাথরুমে যেতোনা। আবার কেউ কেউ আশপাশের বাড়িতে যেত। বেশি সমস্যা হতো মাসিকের (পিরিয়ড) সময়। তখন অনেকে স্কুল আসা বন্ধ করে দিতো। এখন আমাদের বাথরুম অনেক সুন্দর। ওয়াস রুমের ব্যবস্থা রয়েছে। যেটা আগে ছিলো না। এখন যে কোন শিক্ষার্থী বাথরুম ব্যবহার করে সাবান দিয়ে সঠিক নিয়মে হাত ধৌত করে।
স্কুলের দশম শ্রেনীর শিক্ষার্থী পারভীন আক্তার, তামান্ন সহ আরো অনেকেই জানায়, আমাদের স্কুলে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট না থাকায় শিক্ষার্থীরা নানা রোগে আক্রান্ত হতো। বাথরুম সহ ওয়াস এর কোন ব্যবস্থা ছিলো না। ফলে অনেক সহপাঠী স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছিলো। এমনকি অনেকর বাল্য বিয়ে পর্যন্ত হয়ে গিয়েছে। শুধু মাত্র সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকার কারনে। বর্তমানে আমাদের স্কুলের ওয়াস ব্যবস্থা আগের চেয়ে অনেক উন্নত হওয়ায় আমরা স্কুলের সকল শিক্ষার্থীরা অনেক খুশী। তারা আরো জানায়, বর্তমানে মাসিকের (পিরিয়ড) সময় আমরা স্কুল থেকেই স্যানেটারী ন্যাপকিন নিয়ে তা ব্যবহার করতে পারি। এমনকি ব্যবহার এর নিয়ম কানুন আমাদের ম্যাডামরা দেখিয়ে দিয়েছে।
একই কথা বলেন স্কুলের আরেক ছাত্রী ফারজানা বেগম। স্কুলে স্বাস্থ্যসম্মত আধুনিক টয়লেট পেয়ে ভীষণ খুশি আমরা। এত সুন্দর টয়লেট পাবো কল্পনা করিনি আগে লাইন ধরে টয়লেটে যেতাম। মাসিকের কোন ব্যবস্থাপনাই ছিল না। অনেকে তখন স্যারদের না জানিয়ে বাড়ি চলে যেত। এখন আর সেটা হচ্ছে না। মাসিক আমাদের জন্য এখন কোন সমস্যাই নয়।
এখন স্কুলে ন্যাপকিনপ্যাড, সাবান সবই আছে। প্রয়োজন মতো আমরা সেগুলো ব্যবহার করি। ফারজানার মতে জেলার সব স্কুলেই মেয়েদের জন্য এমন ব্যবস্থা থাকা উচিত। তাহলে মেয়েরা লেখাপড়ায় আরো এগিয়ে যাবে।
প্রতিষ্ঠানটির নারী শিক্ষিকা পাপিয়া দাশ জানান, মাসিকের সময় ছাত্রীরা ক্লাসে আসেনা। অথবা হঠাৎ করে তারা ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যায়। এর কারণ হলো ঋতুকালীন ব্যবস্থাপনার অভাব ছিলো। বর্তমানে ইউনিসেফ ও কোস্ট ট্রাস্ট এর সহায়তায় আমরা মেয়েদের জন্য স্যানেটারী ন্যাপকিনের ব্যবস্থা করতে পেরেছি। ফলে মেয়েদের এখন আর মাসিককালীন সময়ে তেমন কোন সমস্যা হয় না।
টবগী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো: ইসমাইল বলেন, আগে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার কারনে নিয়মিত স্কুলে আসতো না। ঝড়ে পরার হার দিন দিন বেড়ে যাচ্ছিলো। ইউনিসেফ এর সহায়তায় ও কোস্ট ট্রাস্ট এর বাস্তবায়নে সুন্দর ওয়াস ব্লক ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবস্থা গড়ে তোলায় এখন স্কুলে উপস্থিতির হার বাড়ছে। আগের পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করলে এখন স্বপ্নের মতো মন হয়। সবচেয়ে বড় কথা, এখানে মেয়েদের মাসিক ব্যবস্থাপনার সব উপকরণ রয়েছে। মেয়েরা সেগুলো ব্যবহার করছে। স্কুলের শিক্ষার্থীরাই এখন টয়লেট পরিষ্কার রাখছে বলে জানান তিনি।
এখন ছেলে-মেয়েদের দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে আর নোংরা টয়লেটে যেতে হচ্ছে না। ছাত্র-ছাত্রীরা যাচ্ছে আলাদা টয়লেটে।
কোস্ট ট্রাস্ট সম্মনিত শিশু বিবাহ রোধ (আইইসিএম) প্রকল্পের সমন্বয়কারী মো: মিজানুর রহমান বলেন, ভোলা একটি উপকূলীয় জেলা হওয়ায় এখানকার তৃর্ণমূলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ওয়াশ রুম অন্ত্যত নোংরা ও একই সাথে মেয়েদের মাসিক পরির্যার কোন ব্যবস্থা নেই। তাই মেয়েরা জাতে স্কুলে এসে টয়েলেট ব্যবস্থা কিংবা স্কুলে যাতে মাসিককালীন সময় স্কুল আশা বন্ধ না করে তার জন্য আমরা ভোলা ও লালমোহনে ৪১টি স্কুল ও মাদ্রাসায় ইউনিসেফের এর সহায়তায় এই ওয়াস কার্যক্রম পরিচালনা করছি। এর মাধ্যমে আমরা মনে করি স্কুলে এসে মেয়েরা সুস্থ থাকবে ও বাল্য বিবাহ কমে আসবে।
ইউনিসেফ এর বিভাগীয় প্রধান এ এইচ তৌফিক আহমেদ জানায়, তৃর্ণমূলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না থাকায় ৮৬ শতাংশ স্কুলছাত্রী মাসিকের সময় স্কুলে তাদের ব্যবহৃত কাপড় বা স্যানিটারি প্যাড বদলাতে পারে না। ফলে বিশেষ ওই সময়ে ব্যাহত হয় তাদের লেখাপড়া। এমনকি মাসিকের কারণে ৪০ শতাংশ ছাত্রী মাসে গড়ে ৩দিন স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। এদের কেউ কেউ শতকরা ৮০ভাগ উপস্থিতি না থাকায় উপ-বৃত্তি থেকেও বি ত হয়ে বাল্যবিবাহ এর শিকার হচ্ছে তাই আমরা যাচ্ছি কোন মেয়ে যেন স্বাস্থ্যসম্মত কারনে যেন ঝড়ে না পরে।
তাই আমরা ইউনিসেফ বাংলাদেশ এর পক্ষ থেকে ওয়াস ব্লক ও স্বাস্থ্য সম্মত টয়লেট ব্যাবস্থা তৈরি করে দিচ্ছি। এই কার্যক্রমকে টেকসই করতে স্কুল কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয়দের এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি।

 

LEAVE A REPLY